কন্যা কবে জ্বালাবে মশাল?

20151017_191955সালেহা ইয়াসমীন লাইলী: হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডের বারান্দার বেডে সদ্যজাত শিশুটি গায়ে মোচড় দিয়ে গোঙাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে তার গলার আওয়াজ বসে গেছে। ঠোঁট-মুখ শুকিয়ে কুঁচকে গেছে। চোখ ‍দুটিও ফুলে উঠেছে। তবুও এতোটুকু সৌন্দর্য কমেনি শিশুটির।

হাসপাতালটিতে সেদিন অপারেশন করে জন্ম নেয়া শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর চেহারা নিয়ে জন্মেছে সে। কিন্তু তাকে পছন্দ হয়নি তার বাবা-মায়ের। তাই জন্মের ১০ ঘন্টা পার হয়ে গেলেও মা তাকে বুকের দুধ খাওয়ায়নি। বাবা তো আদর করে স্পর্শ করেইনি, বরং তাকে নিজের সন্তান বলে মেনে নিতে না পেরে দূরে বসে চোখের জল ফেলছে। স্বজনরাও তার দিকে সন্দেহ নিয়ে তাকাচ্ছে।

জন্মের সাথে সাথে কি দোষ করে ফেলেছে শিশুটি? অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে নার্স যখন পরিবারের লোকজনের কোলে দিতে যাবে, অপেক্ষমান কেউ তাকে কোলে নিতে হাত বাড়ায়নি। নার্স যার দিকেই গেছে সেই সরে দাঁড়িয়েছে। শিশুটিকে কেউ নিজের বলে মেনে নিতে চায়নি। বরং তার ৩০ মিনিট আগে জন্ম নেয়া আরেক শিশুকে নিজের বলে দাবি করেছে দু’দুজন মা-বাবা।

20151017_192102কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে গত ১৭ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১১টায় ডাক্তার অমিত কুমার বোস মা সুফিয়া বেগমের পেট কেটে বের করে আনে এই কন্যা শিশুটিকে। সিনিয়র নার্স রহিমা, তিনি নিজের হাতে বাচ্চাটিকে নরম কাপড়ে পেঁচিয়ে মায়ের চোখের সামনে ধরে বলেছেন, ‘খুব সুন্দর একটি মেয়ে হয়েছে আপনার’। মা সেদিকে তাকাতেই রহিমা আদর করে মায়ের গালের সাথে মেয়ের গাল ঘষে ইন্টার্নি নার্সের কোলে তুলে দেন শিশুটিকে। ইন্টার্নি নার্স দরজা ঠেলে বেরিয়ে এসে ‘সুফিয়া বেগমের মেয়ে হয়েছে’ বলে ডাকাডাকি করলে কেউ সেদিকে তাকায়নি। অপারেশন থিয়েটারে থাকা কাজলী বেগমের স্বজনরা তখনও উম্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছে কখন তারা নিজেদের বাচ্চাকে দেখতে পাবে।

সুফিয়া বেগমের স্বামী গোলাম মোস্তফাকে ডেকে পাঠালে তিনি এসে বলেন, তার তো ছেলে সন্তান হয়েছে। এই মেয়ে তো তার নয়। কিছুক্ষণ আগে তিনি ‘বাচ্চা বুঝিয়া পাইলাম’ বলে সই করে এই দরজার বাইরে থেকে এক ছেলে শিশুকে নিয়ে গেছে।

ততক্ষণে সেলাই শেষ করে অপারেশন থিয়েটার থেকে কাজলী বেগমকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে ওয়ার্ড বয় ও নার্সরা। সুফিয়া বেগমের তখনও সেলাইয়ের কাজ শেষ হয়নি। তখনই ভুল ভাঙ্গে নার্সদের।

সিনিয়র নার্স রহিমা বাহিরে এসে মোস্তফাকে যখন বলেন, ‘আপনি যে বাচ্চাকে নিয়েছেন সে কাজলী বেগমের। ডাক্তার আগে কাজলী বেগমের অপারেশন করেছে। ভুলে আপনি সেই বাচ্চাকে নিয়েছেন। বাচ্চাকে কাজলীর স্বজনদের কাছে দিন। আর আপনার মেয়েকে নিন।’

মোস্তফা মানতে নারাজ। ‘তবে কেন নার্স আমার সই নিয়ে বাচ্চাকে দিয়েছে।’ ছেলে বাচ্চা হয়েছে বলে খুশিতে অনেক উচ্ছসিত ছিল মোস্তফা। তার তিন মেয়ে সন্তান আছে। একটি ছেলে সন্তান হবে এমন আশা থেকে আবারো সন্তান নিয়েছে সুফিয়া-মোস্তফা। ছেলে সন্তান হয়েছে শুনে চক চক করে উঠেছে মোস্তফার চোখ। দ্রুত বাচ্চা কোলে নিয়ে বুকের ওমে চেপে ধরেছে খানিকক্ষণ। তারপর শ্যালিকা সেলিনার কোলে দিয়ে হাসপাতালের ভর্তির কাগজে ‘বাচ্চা ‍বুঝিয়া পাইলাম’ লিখে দিয়ে শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বিউটির কাছে বাচ্চাকে নিযে গেছে। একবার সুস্থতাও চেক করিয়েছে। তখনও মা সুফিয়া অপারেশন থিয়েটারেই ছিল।

এতো পরে নার্স এসব কী বলছে? কেন তার ছেলে সন্তানকে আর কাউকে দিতে হবে? তিনি তা করবেন না। এতো আশার ছেলে, ভরসার ছেলে, বংশের বাতি জ্বালানো ছেলে, কাঁধে নিয়ে শেষ বিদায় দেয়া ছেলে, তাকে পেয়ে কেন অন্যের হাতে দিতে হবে? তিনি দেবেন না মোটেও।

অবশেষে ডাক্তার অমিত কুমার বোস সুফিয়ার সেলাই শেষ করে বাইরে বেরিয়ে আসেন। এসে মোস্তফাকে বোঝাতে থাকেন। ‘এক সাথে দুই টেবিলে দুজন মাকে নেয়া হয়েছিল। প্রথমে  কাজলীকে অ্যানাস্থেসিয়া করে তার অপারেশন করে বেবি বের করা হয়। এর মাঝে সুফিয়াকে অ্যানাস্থেসিয়া দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। প্রথম বেবিটা কাজলীর, পরেরটা সুফিয়ার। ইন্টার্ন নার্স ভালোভাবে চেক না করে বেবি আপনার কোলে দিয়ে সই নিয়েছে। আর আপনি কাজলীর ভর্তি ফরমে সই করেছেন। এটা আপনারও ভুল।’

এর মধ্যে কাজলীর স্বামী ইয়াসীন আলী এসে ছেলে বাচ্চাটিকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। গোলাম মোস্তফাও সেদিকে তাকিয়ে আছে। আর মেয়ে শিশুটি তখনও নার্সের কোলে। কেউ তাকে নিচ্ছে না। ততক্ষণে হাসপাতালের অন্যান্য ডাক্তার, আবাসিক চিকিৎসক, তত্বাবধায়ক, নার্স, অন্যান্য রোগীর অভিভাবক এসে জটলা করে ধরেছে। সবাই বোঝানোর চেষ্টা করছে মোস্তফাকে আসলে ভুলটা তারই হয়েছে। মোস্তফা বিশ্বাস করতে পারে না বা চায় না।

তিনি লিখিত অভিযোগ করেছেন তত্বাবধায়কের বরাবর। তিন সদস্য বিশিষ্ট একটা তদন্ত কমিটিও হয়েছে। তিন দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেবে কমিটি। প্রয়োজনে ডিএনএ টেস্ট করেও নিশ্চিত করার কথা বলেছে ডাক্তাররা।

মেয়ে বাচ্চাটিকে অনেকটা জোর করে সুফিয়ার পাশে শুয়ে দিয়েছে নার্স। কিন্তু মা তাকে বুকের পাশে নেয়নি। তার মুখে দুধও দেয়নি। সুফিয়া ফ্যাল ফ্যাল করে দূরের বারান্দার বেঞ্চে বসে থাকা স্বামীকে কাঁদতে দেখছে। কোলের পাশে শুয়ে থাকা শিশুটির কান্না তাকে স্পর্শ করছে না মোটেও।

মোস্তফা কাউকে বিশ্বাস করছেন না। তিনি ছেলে চান। কারণ এই ছেলে যে তার স্বপ্ন। মেয়ে নয়। ডাক্তারকে আর বিশ্বাস করেন না তিনি। প্রশ্ন করে মোস্তফা, ডিএনএ রিপোর্ট কি ডাক্তার দেবে? তাহলে এই টেস্ট করে লাভ কি?

লেথক সাংবাদিক

     

 

শেয়ার করুন:

35 বছর আগে এমন একটা দিন আমার ও হয়েছিলো লোকের কাছে শোনা । শুধু সে দিন বাবা মা কেউ কান্না করেনী আমি নাকি ১ ঘন্টা মতো প্রচন্ড কেঁদেছিলাম কেউ আমাকে কোলে তুলে নেয়নি। আমার অপরাধ তিন বোনের পরে আবার মেয়ে। যদিও পরে কোন দিন সেটা কেউ বুঝতে দেয়নি। আমার কোন নাম রাখা হয়নি ৬ মাস অব্দি। সব কিছুকে মলিন করে আসায় নামটা রাখা হলো মলিনা। বড় হওয়ার পর অনেক বার লোকের কাছে কথা গুলো যখন শুনতাম বুকের ভিতর কোথায় যেন চাপা একটা কষ্ট পেতাম, যা আজও পাই। আজ এতো বছর পর লেখাটা পড়ে মনে হচ্ছে , এতোটুকু কি পরিবর্তন হয়েছে আমাদের মানসিকতার? কবে আমাদের মেয়ে না ভেবে মানুষ ভাববে এই সমাজ????? তোমার জন্য অনেক শুভ কামনা রইল বাবু সোনা।