উইমেন চ্যাপ্টার: কালের কণ্ঠ পত্রিকার একটা খবরের শিরোনাম: “বগুড়ায় হিন্দু কিশোরী ধর্ষণ, একজন গ্রেফতার”। এটা পড়েই চমকে উঠলাম, নতুন ট্রেন্ড চালু হলো নাকি? আগে তো কখনও শিরোনামে ‘হিন্দু’ শব্দটা উল্লেখ হতে দেখিনি। পরক্ষণেই মনে হলো, আদিবাসী মেয়ে ধর্ষণের শিকার, এমন অনেক শিরোনাম আগে পড়েছি, কিন্তু নিজেদের ঘাড়ে না আসা পর্যন্ত বুঝতে পারি না, বন্দুকের নল কতটা ভারী ঠেকে। তার মানে, হিন্দুরাও এখন ওই আদিবাসীদের মতোনই জাদুঘরে যাওয়ার অপেক্ষায়। সংখ্যালঘু হতে হতে এখন ‘শিরোনামযোগ্য’ হয়ে উঠেছে তারা। বাহ বাহ, উন্নতি ঘটেছে হিন্দুদের।
এই শিরোনাম থেকে এটা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক যে, আজকাল ধর্ষণের মাঝেও হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঢুকে পড়েছে, তাই হয়তো উল্লেখ করে দেয়া প্রয়োজন হয় মানুষের সুবিধার্থে। যেমনটি হয় দুর্ঘটনার নিউজের ক্ষেত্রে যে, ‘পাঁচজন নারী ও একটি শিশুসহ নয়জন নিহত’। পুরুষ এখানে মুখ্য, অন্যরা গৌণ।
কোনো মুসলিম মেয়ে ধর্ষিত হলে তো সেখানে উল্লেখ করা হয় না যে, মুসলিম নারী ধর্ষিত। নাকি এটা মুসলিম দেশ বলে! সংবিধান অনুযায়ী দেশটা কেবল একটা সম্প্রদায়েরই বলে! আর যে সাংবাদিক বা সাংবাদিকরা এরকম একটা নিউজ করলেন, তাদেরও বলি, ভাই, আপনারা পারেনও বটে!!!!
মৌলবাদীদের থেকে আপনাদের দূরত্ব গ থেকে ঘ এর দূরত্বের মতোনই। সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিতে সিদ্ধহস্ত আপনারা, তাও আবার ভণ্ডামি করে, প্রগতিশীলতার মুখোশ পড়ে। আপনাদের থেকে দৃশ্যমান ওই মৌলবাদী জঙ্গিরাও অনেক শ্রেয়। অন্তত আপনাদের মতো প্রগতিশীলতার মুখোশ পড়ে বাঁশ মারে না তারা। তারা যা করে বলে-কয়েই করে।
অথচ দেশে কোথাও মন্দির বা মূর্তি ভাঙচুর হলে, তখন মুখে কুলুপ আঁটে অনেক মিডিয়া হাউস, এটা যেন কোনো খবরই না। কিছু বললে অমনি বলা শুরু করে, এতে করে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াতে পারে, অস্থিতিশীলতা বাড়তে পারে, ব্লা ব্লা ব্লা। হিন্দুদের ভিটেমাটি ছাড়া করলেও সাংবাদিকদের কাছে তা মামুলি খবর হয়ে যায়। তখন বলবে, ভিটে ছাড়া হচ্ছে তো আরও অনেকেই। শুধু হিন্দুদেরটাই নিউজ?
না, নিউজ না। হিন্দু বলেন, আদিবাসী বলেন, বা অন্য কোনো সংখ্যালঘুই বলেন, এরা আসলে এই দেশের নাগরিকই না। কোনরকমে আশ্রয় দিয়ে রেখেছেন আপনারা, তাই তারা কৃতজ্ঞ। এই যে তাদের মেয়েটাকে রাতভর নির্যাতন করলো সরকারি দলের নামধারী কয়েকজন মিলে, সকালে আবার ‘নিরাপদে’ তাকে বাড়িতেও পৌঁছে দেয়া হলো, তাতেও হিন্দুরা ধন্য। এমন নিরাপত্তা তো এই সরকারই দেবে। ধর্ষকরা যে মেয়েটিকে মেরে পুঁতে ফেলেনি তাই কত ভাগ্য। এটা যেন আরেক পূর্ণিমার কেস।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর ছোট্ট কিশোরী মেয়ে পূর্ণিমা যখন নির্যাতনের শিকার হলো, বর্তমান সরকার তখন বিরোধী দলে। তাদের তখন অনেক মায়া পড়েছিল পূর্ণিমার প্রতি। তাইতো কেউ তাকে মেয়ে বানিয়ে ফেলেছিল, অনেক অনেক ফান্ডও এসেছিল সেই মেয়েটির নামে। আর মেয়েটিও এই বাড়ি- ওই বাড়ি ঘুরতে ঘুরতেই সময় পাড়ি দিল। এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বাসাতেও সে ছিল বছর দেড়েক। কিন্তু বাড়ি বাড়ি ঘোরা হয়েছে ঠিকই, মেয়েটির মানসিক পরিচর্যা হয়নি। যে ট্রমার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছিল ওইটুকুন বয়সে, সেখান থেকে কম উত্তরণই হয়েছে তার।
এই প্রসঙ্গে পূর্ণিমাকে টেনে আনাটা হয়তো যৌক্তিক হয়নি। কিন্তু আনা হলো এইজন্যই যে, হিন্দু মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে রাষ্ট্র, মিডিয়া সবাই কেমন যেন একটা শিহরণ অনুভব করে, এবং তা প্রকাশেও তারা কুণ্ঠিত হয় না। এমনিতেই নারী হলো গণিমতের মাল, সেখানে হিন্দু নারী তো আরও বেশি। আদিবাসী বিষয়টার সাথে আবার একটা দখলের রাজনীতি জড়িত, যেমন হিন্দু নারীর সাথে জড়িত জান্নাত বা বেহেশত বা স্বর্গ। হিন্দু ধর্মটাও তেমনই। কোনোভাবে কাউকে এই ধর্ম থেকে চ্যুত করা মানেই নিশ্চিত বেহেশত। তাই যত বেশি নারী ভাগাও, নারীকে ধর্ষণ করো, আর ফলাও করে প্রচার করো সেইসব ‘কাহিনী’। এতে করে আলগা সহানুভূতি অনুভব না করলেও, শরীরের কোথাও যেন শিহরণ অনুভব করবে, এটা হলফ করেই বলা যায়।
দেশজুড়ে যখন ধর্ষণের মহোৎসব চলছে, তখন ধর্ম কারও বর্ম হয়ে উঠবে না। সবাইকেই তা কমবেশি ছুঁয়ে যাবে অচিরেই। সেদিন দেখলাম, মা-মেয়েকে ধর্ষণ করে সেই ভিডিও বাজারে ছাড়া হয়েছে। কী বীভৎস, কুৎসিত মানসিকতা! টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণ করা হলো, তার প্রতিবাদ-বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালিয়ে খুন করলো তিনজনকে। তাদের অপরাধ ছিল যে, তারা এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন।
এই অপরাধে পুলিশকে শুধু ক্লোজ করা হয়েছে। হওয়া উচিত ছিল, খুনের মামলা। কিন্তু হয়নি। আসলেই অদ্ভুত উটের পিঠ চলেছে স্বদেশ……..এবং এই সরকারেরই আমলে।