অর্থনৈতিক মুক্তিই নারীর মুক্তি নয়

Thoughtsফারজানা নীলা: স্বাধীনতা বলতে কি বুঝায়?  অতি অবশ্যই অন্য কারো উপর নির্ভর না হয়ে সম্পূর্ণভাবে নিজের উপর নির্ভর হওয়াকে স্বাধীনতা বলে। জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল কিছু নিজেই যখন সংস্থান করতে পারবে তখন একজন মানুষকে স্বাধীন বলা যায়। যেমন জীবন ধারণের জন্য অন্ন বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা এবং শিক্ষার প্রয়োজন। এর জন্য প্রয়োজন অর্থ। অর্থের সংকুলান কেউ যদি নিজের উপার্জনে করতে পারে তবেই সে ব্যক্তি স্বাধীন। অর্থাৎ আর্থিকভাবে স্বনির্ভর।

সময়ের পরিবর্তনে এখন নারীরাও স্বনির্ভর হচ্ছে। পড়ালেখা শিখে চাকরি করছে, অর্থ উপার্জন করছে।  উচ্চ শিক্ষার হার যত বাড়ছে আমাদের দেশে, সেই অনুপাতে হয়ত স্বনির্ভর হওয়ার হার বাড়ছে না। তবে কম করে হলেও অনেকেই অর্থ উপার্জন করে স্বনির্ভর হচ্ছে। বিভিন্ন অফিসে অনেক উচ্চবেতনের নারী কর্মচারি দেখি। দেখে ভাল লাগে ভেবে যে, মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা কি নারীদের সত্যিকার অর্থে এগিয়ে নিচ্ছে? 

কথা হচ্ছিল দেশে একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত উচ্চবেতন ভোগী এক নারীর সাথে। স্বচ্ছলভাবে জীবন ধারণ করার জন্য যত অর্থের প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি সে উপার্জন করে। সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে, এবং জানতে পারলাম সে স্বামী থেকে প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা হাত খরচের জন্য নেয়, একটু অবাক হলাম, যথেষ্ট পরিমাণ হাতে টাকা থাকা সত্ত্বেও কেন সে এমন নিয়ম করে স্বামী থেকে টাকা নেবে?

আমি বলছি না যে স্বামী থেকে টাকা নেওয়া অপরাধ। কখনই অপরাধ নয়, আপনজনদের থেকে আমরা টাকা পয়সা নেবো, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা যদি হয় প্রয়োজন ছাড়া নিয়ম মোতাবেক,  তবে সেটি কি দৃষ্টিকটু নয়? ভাবলাম হয়তো মেয়েটি তার পরিবারের জন্য অনেক খরচ করে তাই এমন নিয়ম করে টাকা নেয়। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বলল, আমি আয় করলে কি স্বামী আমাকে টাকা দেবে না? স্বামীর দায়িত্ব স্ত্রীর ভরণপোষণ  দেওয়া। স্ত্রীর আয় থাকুক আর না থাকুক

 দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করার মতো রুচি হলো না আর। বুঝে নিলাম নারী যতই আয় করুক না কেন যেহেতু স্বামীর দায়িত্ব স্ত্রীর ভরণপোষণ দেওয়া, সুতরাং স্ত্রী যথেষ্ট আয় করলেও তাকে টাকা দিয়ে যেতে হবে।

এমন উদাহরণ আমাদের দেশের মেয়েদের মধ্যে অহরহ। আমাদের মানসিকতা এভাবেই তৈরি। জন্ম থেকে আমরা শিখে আসছি যে মেয়েরা ছেলেদের উপর নির্ভরশীল। আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয় যে ছেলেরা সংসারের হাল ধরবে, যাবতীয় সকল খরচ এবং সকলের খরচ সে বহন করবে।

সমাজ আমাদের শেখায় না যে নারীকেও পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। যদিও এখন মেয়েরা পড়ালেখা শিখে অর্থ উপার্জন করছে, কিন্তু যেভাবে একজন ছেলের কাছ থেকে সংসারের ভরণপোষণ আশা করে সেভাবে মেয়েদের কাছ থেকে আশা করে না। একজন নারী ছেলেদের মতো সংসারের সকল দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেবে এমন চিন্তা খুব কমসংখ্যক পরিবারই করে। বাদ বাকি সবাই এটাই ভাবে দায়িত্ব সব ছেলেদের, মেয়েরা যদি আয় করে তবে সেটা বোনাস। অথবা মেয়েদের আয় অনেকটা নারী সম্মান বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে মনে করা হয়। সম্মান অবশ্যই বাড়ে, তবে দায়িত্বহীন সম্মান।    

যদি কোন পরিবারের সকল দায়িত্ব একজন নারী  বহন করে তবে সমাজ খুব একটা বাহবা দেয়  না। বরং উলটো বাঁকা স্বরে কথা বলে। “মেয়ের টাকায় খায়” বলে নোংরা মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। অর্থাৎ সমাজ আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে পরিবারের দায়িত্ব ছেলেরাই বহন করবে, নারী যদি পারে তবে আংশিক দায়িত্ব নিবে, তবে পুরোপুরি এবং সঠিক দায়িত্ব পুরুষকেই নিতে হবে।

এরই বর্ধিত নিয়ম হিসেবে দেখি, যে ছেলে যখন বিয়ে করবে তখন স্ত্রীরও দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে, স্ত্রী আয় করুক আর না করুক। কিন্তু এমন নিয়ম নেই যে নারীদেরও স্বামীদের দায়িত্ব নিতে হবে। স্বামীর যেমন কর্তব্য স্ত্রীর ভরণপোষণ নেওয়া, তেমনি স্ত্রীরও কর্তব্য স্বামীর দায়িত্ব নেওয়া। কিন্তু এমন কোন কিছু সমাজ মেয়েদের থেকে আশা করে না, বা করতে চায়ও না।

আমি বলছি না যে স্ত্রী আয় করলে স্বামী তার দায়িত্ব নিবে না। স্বামী তার দায়িত্ব অবশ্যই পালন করবে। কিন্তু স্ত্রীর অঢেল থাকা সত্ত্বেও যদি অহেতুক অতিরিক্ত টাকা দেওয়া হয় সেটা যে একজন অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নারীর জন্য যে অপমান, সেটা বুঝার মতো বোধ নারীদের নেই।

নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আত্মসম্মান বোধে বলিষ্ঠ হচ্ছে কম। যথেষ্ট আয় করা সত্ত্বেও এমন নারীরা মাস শেষে স্বামী থেকে বেতন নেওয়ার মত টাকা নেয় তখন তারা নিজেরাই প্রমাণ করে দিচ্ছে তাদের দায়িত্ব অন্যদের নিতে হয়। তারা নিজের দায়িত্ব নিতে পারে না। এর মধ্য দিয়ে সমাজ যা এতোদিন আমাদের শিখিয়ে এসেছে যে নারী দুর্বল , তার দায়িত্ব নিজে নিতে পারে না সেটা নারী নিজেই প্রমাণ করে দেয়।

আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন না হলে  স্বাবলম্বী নারী শুধু বাহ্যিকভাবেই স্বাধীন হবে। “আমি সক্ষম আমার নিজের সব ধরনের দায়িত্ব নিতে” , এই বোধ যতদিন না মেয়েদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে ততদিন নারীদের  মানসিকতার দীনতাও ঘুছবে না

নারীর যোগ্যতা আছে নিজের সকল দায়িত্ব নিজেই বহন করার, এই বোধের বিকাশ না ঘটলে নারী সর্বদাই উপরোক্ত বর্ণিত নারীর মতই থেকে যাবে, “আমি আয় করলে কি স্বামী আমাকে দিবে না?”

খুব অল্প সংখ্যক নারী নিজেদের প্রমান করেছে তারা আসলেই স্বাধীন, নিজের দায়িত্ব নিজেরা নিতে সক্ষম এমনকি পুরো পরিবারের দায়িত্বও। তারা নিজেদের স্বামীর দায়িত্ব মনে করে না। সংখ্যায় কম কিন্তু এরাই আমাদের সমাজে নারী মুক্তির উপযুক্ত উদাহরণ।

নারীর  প্রকৃত মুক্তি তখনই হবে যখন সে এটি বিশ্বাস করা শুরু করবে, স্বামী যদি স্ত্রীর দায়িত্ব নিতে পারে তবে স্ত্রীও পারে স্বামীর দায়িত্ব নিতে। নারীর নিজেকে আগে মানুষ হিসেবে সর্বোপরি সক্ষম মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে। নারী স্বাধীন মানে কিন্তু এই না যে সে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারী মুক্তির মূলভিত্তি কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন হয়ে যদি নিজের দায়িত্ব অন্যের উপর চাপিয়ে দেই, বা অন্যের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা নিয়ম বলে মেনে নেয় তবে এটা নারী মুক্তি নয়।         

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.