
এড়িয়ে চলার মূল কারণটাই হল আমি হতাশাবাদীদের দলে না। আরেকটা কারণ সম্ভবত, আমি জীবনের বৃহত্তর অংশে যে গুটিকয়েক ছেলের সংস্পর্শে এসেছি, তাদের বেশীর ভাগই ছেলেদের সম্পর্কে আমার মনে বেশ উঁচুমানের ধারণা তৈরি করে দিয়েছিল। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে সামগ্রিক অভিজ্ঞতা খুব তিক্ত না। এবং আরেকটি বিরাট কারণ, পলায়ন প্রবৃত্তি। যতক্ষণ আমি নিজে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত না হচ্ছি, ততক্ষণ কী দরকার ঝামেলায় পড়ার? ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়াতে কেই বা চায়? নিজে সুখে আছি, বড় কোন ঝামেলায় পড়ি নাই, ছোটখাটো তথাকথিত বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে উপেক্ষা করলেই তো হয়। একটাই জীবন, হেসে খেলে কাটাতে পারাটাই উদ্দেশ্য।
যতই এড়িয়ে চলি না কেন, নিজের মনে নারী অধিকার নিয়ে আমি যে একদম ভাবতাম না, সেটাও ঠিক না। নারী-পুরুষের সম্পর্ক, অধিকার এই সব নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নারী আর পুরুষ একজন আরেকজনের সম্পূরক। অনেকটা পাজলের মতো। পাজলের একটা পিস বাদ পরে গেলেই সেটাকে আর মেলানো যাবে না। নারী এবং পুরুষের যে স্ব স্ব শক্তি আছে, সেটাকে পুরোপুরি কাজে না লাগালে, পারস্পরিক শ্রদ্ধা না থাকলে সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব না। বিশ্বাসটা এখনো আছে। তবে এই বিশ্বাসের মধ্য বিরাট একটা কিন্তু ধরা পরেছে আমার চোখে, যেই কিন্তুটার কারণেই আজ লিখতে বসা।
আমি লেখালেখি শুরু করার পর আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছি, আমার দেখা জগতটা আসলে কত ক্ষুদ্র ছিল। মেয়েদের জঘণ্য অভিজ্ঞতাগুলোর কোন ভগ্নাংশও আমাকে মোকাবিলা করতে হয়নি। একারণেই নারীবাদীদের কষ্টটা আমি কোনদিন বুঝতে পারিনি। ধীরে ধীরে মেয়েদের নিজ মুখে বলা ঘটনা থেকে বা তাদের সাথে সরাসরি কথা বলে বুঝতে পেরেছি যে কী কঠিন জীবন পার করছে অনেকেই। প্রতিদিন রাস্তা ঘাটে, দোকানে, স্কুলে , কলেজে, নিজের সংসারে, কর্ম ক্ষেত্রে, ইন্টারনেটের ভারচুয়াল জগতে কতভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে মেয়েরা।
আমার যেই পাজল থিয়োরি ছিল, সেই পাজলের কোন অংশ পুরুষ করবে, কোন অংশ নারী, সেটা ঠিক করবে পুরুষ। কৃতিত্ব নিবে পুরুষ। ছোট, বা অসম্মানজনক ভাগটা নারীকে দিয়ে নিজের পছন্দ মত অংশটা নিবে পুরুষ। এই ভাগাভাগিতে একদল মানুষ যদি সাড়া জীবন ঠকে আসে, তাদের মনে যদি বিদ্বেষের পাহাড় জমে, তাদেরকে কি দোষ দেওয়া যায়? যারা প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত, তারা যদি কেঁচো দেখে সাপ ভাবে, সবাইকে অবিশ্বাস করে তবুও তাদের দোষ দেওয়া যায় না।
সব পুরুষ যে সরাসরি নারী নির্যাতন করে, বা নারীকে সম অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানায়, নারীকে পণ্য হিসাবে গণ্য করে তা না। একটা বিরাট অংশ নারী এবং পুরুষ আছে যাদের সেই পুরানো আমির মতো পলায়ন প্রবৃত্তি আছে। ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়াতে রাজি না। এদের নিস্পৃহতা তবু তেমন বড় কোন ক্ষতি করে না, তার চেয়েও বড় সমস্যা তৈরি করে আরেক দল।
নারী স্বাধীনতা, নারীর অধিকার, সম্মান এক কথায় নারীবাদকে একদল আজকাল আধুনিকতার সিম্বল হিসাবে ব্যবহার করে। মুখে তাদের বড় বড় বুলি। উদারপন্থী, নারী স্বাধীনতার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এটা তাদের আধুনিকতা, উচ্চ শিক্ষার পরিচয় বহন করে, সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করে। কিন্তু জায়গামত তাদেরকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ধর্ষিত নারী বিচার চাইলে, এরা বলে “প্রমাণ কি?’ লাঞ্ছিত নারীকে আড়ালে বুদ্ধি দেয় “আপোষ করে নাও না, এতো ছোটখাটো ব্যাপারে মাথা ঘামালে চলে?” এই দলে অনেক তথাকথিত আধুনিক নারীও পরে। নারীবাদী দেখলে পালিয়ে যায় তা না, মুখে একটু আধটু নারীবাদের বুলিও আছে, তা না হলে আধুনিক হওয়া যায় না যে। আমার ইছছা করে টেনে এদের মুখোশটা খুলে দেই, যেন ভুল করে কোন দিন কোন বিপদ্গ্রস্থ নারী এদের শরণাপন্ন না হয়।
আশে পাশে যেসব মেয়েরা নারী অধিকার নিয়ে লিখছে, তাদের বিভিন্ন তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শুনি, কত যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তারা। শোষিতের প্রতি শোষকের চিরায়ত প্রতিরোধ। শুধু প্রতিরোধের ধরনটাই যা পরিবর্তন হয়েছে, এই টুকুই পার্থক্য। ইনবক্সে নোংরা ভাষায় আক্রমণ, হুমকি, টাইমলাইনে আক্রমণ, দল বেধে আজে বাজে ভাষায় আলোচনা আরও কত রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ভারচুয়াল সমস্যা, ভারবাল এবিউসের মুখোমুখি হয় এই সব মেয়েরা। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে, সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে একটা মেয়েকে বাজে কথা বলে দেওয়া, যাতে করে তার উপরে এটা প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। ফেসবুকের কল্যাণে এই কাজটা এখন যে কারো হাতের মুঠোয়।
এসব দেখে দেখে আমার মনে হয়, এগুলো আর কিছু না, এই সব সোচ্চার মেয়েদের কণ্ঠরোধের অপচেষ্টা। কয়জনের কণ্ঠ রোধ করবেন আপনারা? কোন মেয়ে নারীবাদী হয়ে জন্মায় না। সব মেয়েই ছেলেদের মত একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন চায়, নির্মল শৈশব, দুরন্ত কৈশোর , পড়ালেখা চাকরী, প্রেম, বিয়ে, সন্তান, সংসার, ক্যারিয়ার। কিন্তু সমাজ তাদের সাথে যখন সুবিচার করে না, তখন তাদের উপায় কি সোচ্চার হওয়া ছাড়া?
যেসব মেয়ে দিনের পর দিন নীরবে নিভৃতে শারীরিক হয়রানির শিকার হচ্ছে, যাদেরকে মৌখিকভাবে হয়রানি করছে, কাছের মানুষরা কি পারবেন তাদের সবার গলা টিপে ধরতে?
………. ……………
পুরুষ পতি কহে
নারী অবলা,
সম যদি হতে চাও
দিব টিপে গলা।
বাঁকা হাসি, মধু কথা
থাকে যেন নত মাথা ,
আমার এই চরণে।
হাসো , খেলো , রাঁধো বারো ,
ঘুরে এসো পার্লারও,
এর বেশী চেয়ো নাকো
ওইটুক জীবনে ।।
যৌবনে চাই হট
মিষ্টিও চলবে,
আর কিছু হতে গেলে
ডাণ্ডাটা পরবে।
প্রোগ্রাম করেছি যা রোবট মগজে ,
ভুল যদি হয় তবে গলা টিপে দিব যে।