চলেন সবাই গণ-আত্মহত্যা করি

Vatসুমন্দভাষিণী: ‘ভ্যাট দিব না, গুলি কর’……এই শ্লোগানটিই এখন ঘুরছে মানুষের মুখে মুখে, ব্যানারে-ফেস্টুনে। কয়েকজনকে দেখলাম, এরই মধ্যে গুলিতে ঝাঁঝরাও হয়ে গেছে। তাদের অপরাধ, শিক্ষা নিতে গিয়ে তারা ভ্যাট দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

আশ্চর্য এই দেশ, এই দেশের সরকার। শিক্ষা কবে থেকে পণ্য হলো যে, এর জন্য ভোক্তাকে ভ্যাট দিতে হবে? সংবিধানে কী লেখা আছে? মৌলিক অধিকার পাওয়ার জন্য কোনো ভ্যাট নির্দ্দিষ্ট আছে কী? কোনো দেশে আছে? থাকতে পারে, আমার জ্ঞানের পরিধি সীমিত, তাই জানা নেই।

কিন্তু আমার দেশ, যা কিনা অচিরেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে, উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে বলে শুনি, সেখানে শিক্ষা অর্জন করতে গিয়ে কেন বাড়তি টাকা গুনতে হবে বাবা-মায়ের? ছেলেমেয়ে এখন সংসারের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ক্রমেই। ভুল বললাম, আমাদের বেঁচে থাকাটাই একটা বোঝা।

যে দেশ তার নাগরিকদের সমান শিক্ষার সুযোগ করে দিতে পারে না, যে দেশে মেধার অপচয় ঘটছে প্রতিনিয়ত, যেখানে ন্যুনতম মেধা কিনতে হচ্ছে জমি-বাড়ি বিক্রির বিনিময়ে, সেখানে এই বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দিয়ে সরকার আসলে কী হাসিল করতে চাইছে, বোঝা দায়।

নিরাপত্তাহীনতা যেখানে আমাদের প্রাত্যহিক সঙ্গী, নিজ ঘরেও যেখানে ঘুম আসে না ভয়ে-আতংকে, কী বলতে কী বলে ফেলি আর ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার হই, রাস্তাঘাটে চাপাতির ভয়, সন্তান স্কুলে যায় না বাবা-মায়ের আতংকের বলি হয়ে, স্বাভাবিক জীবন বলতে যেখানে আসলে কিছুই নেই, বিশ্বাস নেই আজ অতি পরিচিতদেরও, কী বলবো সেখানে? কী নিয়ে আর প্রতিবাদ হবে আমাদের?

শিক্ষার স্বাভাবিক অধিকারের জন্য আজ ছেলেমেয়েগুলো পথে নেমেছে, আর ওদের দিকে ছুটছে গুলি, এ কোথায় বাস করছি আমরা?

বলি কী যে, আমাদের সাধারণদের পথ বাতলে দিন সরকার বাহাদুর, আমরা এখন কী করবো? কোথায় যাবো? দিন দিন সবকিছুর দাম বাড়ছে, আমাদের দাম যে কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে, সেটা জানেন? আমাদের পেটে ভাত নেই, আমাদের কথার কোনো মূল্য নেই, জীবনের মূল্য নেই, আমরা কি নিজেদের এইদেশের নাগরিক ভাবতে পারি আর?

প্রিয় সরকার, আপনাদের কোটি টাকার গাড়ি আসে ভ্যাট ও শুল্কমুক্ত। সংসদে কতগুলো অপদার্থ বসেন আমাদের করের টাকায়। এই কর জোগাড় করতে গিয়ে আমরা রাত-দিন একাকার করে ফেলছি।

শোষণ-শাসনের তোরজোড়ে সাধারণের যে নাভিশ্বাস, তা কী বুঝতে পারছেন আপনি? যেদিন সব ভেঙ্গেচুরে বেরিয়ে আসবে, সব ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাবে, সেদিন হয়তো দেরিই হয়ে যাবে। তখনও সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হবে এই আমাদেরই। আমাদের যে কোনো অভিভাবক নেই।

পাশের দেশের দিকে তাকালে অনেকটা লজ্জিত হতে হয়, একইসঙ্গে হতাশও। একই রক্ত, একই আবহাওয়া-সংস্কৃতি, তারপরও কত ছন্দ, কত গতি এখানকার জীবনে। সবাই যার যার কাজখানি সুন্দর মতোন করে যাচ্ছে, কোথাও কোনো হা-পিত্যেশ নেই, কাউকে ঠকানোর ধান্ধাবাজি নেই। কাজ করে যে বুয়া, সেও সময়মতোন আসে, তার কাজটা করে দিয়ে চলে যায়, একদম প্রফেশনাল। এই কাজটা তার কাছে অন্নদাতা, সে এর অমান্য করে না।

অথচ আমরা? একেবারে আগা থেকে পাশতলা পর্যন্ত সব জোচ্চর, সব দুর্নীতিবাজ। সবাই শুধু নিজেরটুকু বুঝতে পারে। কীভাবে কম কাজ করে বা ফাকিঁ দিয়ে সর্বোচ্চটুকু পেতে পারি, সেই ভাবনা মাথায়।

আজ তিনদিন ধরে কেবলই ভাবছি, কিভাবে চলবো আমরা সাধারণেরা? বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, গ্যাসের দাম বেড়েছে, জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বগামী, পরিবহন খরচও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। এখন শিক্ষাও কিনতে হবে বাড়তি ভ্যাট দিয়ে, আগেও এর দাম বাড়াই ছিল। তাহলে এই আমি অতি সাধারণ যারা, মাসশেষে সামান্য কটা টাকায় চলি, আমাদের কী হবে?

আমরা কি সবাই গণ আত্মহত্যা করবো এখন? সরকার কি তাই চায়? আমিই যদি না চলতে পারি, তাহলে আমার চেয়েও যারা বিত্তহীন হয়ে আছে, তাদের কী হবে?

আমরা কী তাহলে চুরিবিদ্যা শিখবো? বলুন সরকার বাহাদুর, আমাদের ছেলেপিলেদের সামনে কোন রাস্তা খোলা থাকলো তাহলে? প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী পাশ করে বেরুচ্ছে, ওদের সামনে কোনো কর্মসংস্থানের হাতছানি নেই, রাস্তার মোড়ে মোড়ে বেকার যুবকদের হল্লা বাড়ছে, ভিড় বাড়ছে। অপরাধ তো এমনিই বাড়বে, এটা রুখবে কে? সবমিলিয়ে এই অসহনীয় অবস্থার অবসান কীভাবে হবে, আমার সোজা মাথায় ঢুকছে না।

 

শেয়ার করুন: