স্তন নিয়ে ভাবনার শেষ কোথায়?

Breast Cameroonসুমু হক: স্তন নিয়ে মেয়েদের বিড়ম্বনার সূত্রপাত ঠিক কবে, তার কোনো লিখিত ইতিহাস জানা নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু দেখি একেক সময় একেক দেশে, একেককালে, পৃথিবীর বেশিরভাগ সংস্কৃতিতেই স্তন নিয়ে বিব্রত হয়ে থেকেছে তারা।

কখনো খুব ছোট, আবার কখনো খুব বড় স্তন নিয়ে অসুখী হয়ে ক্রমাগত সেই দোষস্খলনের চেষ্টায় অস্থির হয়ে থেকেছি আমরা।

ভাবনার যে বিষয়, সেটি হলো কোন ক্ষেত্রেই এই স্তন নিয়ে হীনমন্যতা থাকা উচিত না। শারীরিক সুবিধে-অসুবিধে এমনকি নিদেন পক্ষে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সুবিধে-অসুবিধে সংক্রান্ত নয়। নয় এমনকি একটি মেয়ের ব্যক্তিগত পছন্দের কারণে।

প্রায় সব ক্ষেত্রেই যে মাপকাঠি দিয়ে নারীর স্তনের সৌন্দর্যের বিচার করা হয়, তা হ’লো পুরুষের চোখ, পুরুষের চোখে তার স্তনের আকর্ষণ কি বিকর্ষণ।

পুরুষের চোখে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতে আর নয়তো তাদের কামনার হাত থেকে বাঁচাতে যুগে যুগে নিত্য নতুন পদ্ধতিতে নিজেদের নাকাল করে এসেছি আমরাতা সে মধ্য যুগের ইউরোপের করসেটই হোক কি আজকের দিনের ডিজাইনার ব্রা অথবা আরো চূড়ান্ত প্লাস্টিক সার্জনের ছুরির নিচে গিয়ে কেটে ছিঁড়ে হলেও সেই আকর্ষণীয়, অলীক স্তনের অধিকারি হবার চেষ্টা।

আর তার পাশাপাশি সমান্তরাল ধারায় চলেছে নারীদেহের এই মাংসপিণ্ড দু’টোকে ঢেকে রেখে এমনকি নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে হলেও পুরুষের লালসার হাত থেকে বাঁচিয়ে তার সতীত্ব রক্ষার প্রয়াস।

পশ্চিমের দেশগুলোতে টডলারস অ্যান্ড টিয়ারাস এর মতন বিবমিষাকর রিয়ালিটি শোগুলো যখন প্রচন্ড জনপ্রিয়তা পায়, নারী তো ছাড়, নিছক শিশুদেরকেও সেক্স সিম্বল বানিয়ে তোলার রাজনীতি আর লক্ষ কোটি টাকার বিউটি ইন্ডাস্ট্রির জয় হয়।

নিজের প্রকৃতিদত্ত দেহ, স্বাভাবিক সৌন্দর্য এবং সর্বোপরি মেধা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলার চাইতে অনেক মায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হুয়ে ওঠে মেয়েটির জন্যে ট্রেনিং ব্রা’র ব্যবস্থা করা।

আর এর উল্টো পিঠে দেখি কোন কোন সমাজে নারীর স্তনকে তার আকর্ষণ ক্ষমতার অনিবার্য অংশ জেনে একশ্রেণীর মায়েদের সেই স্তন ঢেকে রাখা এবং এমনকি নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা।

কখনো সে চেষ্টা চলে নারীকে পর্দার ভেতর ঢেকে রাখার মাধ্যমে আবার কখনো বা বিশেষ কিছু তথাকথিত ঐতিহ্যের নামেকাটা ছেঁড়া করে হলেও নারীর শারীরিক সৌন্দর্য আর যৌনতাকে কুড়িতেই বিনাশ করে দিয়ে।

জেনিটাল মিউটিলেশনের কথা আমরা কম-বেশি সবাই শুনেছি।

সেরকমই আরেকটি বর্বর প্রথা হ’লো ক্যামেরুনের “ব্রেস্ট আয়রনিং” অর্থাৎ স্তনকে ইস্ত্রি করে সমান করে দেয়া।

ইস্ত্রি দিয়ে স্তন পিষে দেয়া” ক্যামেরুনের একটি প্রথা যেখানে বাচ্চা মেয়েদের বুকে গরম জিনিসপত্র, যেমন লোহার হাতা কি নোড়া দিয়ে চেপে তাদের স্তনকে সমান করে দেয়ার চেষ্টা চালানো হয়। উদ্দেশ্য একটাই, পুরুষের চোখে কম আকর্ষণীয় হওয়ায় তাদের প্রথম যৌন সম্পর্কগুলো যাতে ঘটে অপেক্ষাকৃত দেরিতে। বাবা-মারা ভয়ে থাকেন যে কোন পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়ে সন্তান-সম্ভবা হয়ে পড়বে মেয়েটি।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই কাজটি করে থাকেন পরিবারের মেয়েরা, হয় বাড়িতেই আর নয়তো কোন ওঝা কি গ্রাম্য চিকিৎসকের সহায়তায়। প্রক্রিয়াটি শুরু হয় মেয়েটি কৈশোরে পা রাখতে না রাখতেই, কোন কোন ক্ষেত্রে এমনকি মাত্র আট বছর বয়সেই। এর ফলে মেয়েটি সম্মুখীন হয় নানারকম শারীরিক জটিলতার। ক্ষতিগ্রস্ত ব্রেস্ট টিস্যু, সিস্ট, ক্যান্সার এবং বাচ্চাকে স্তনদানের ক্ষেত্রে জটিলতা তো দেখা দেয়ই, সাথে রয়েছে অসংখ্য মানসিক  জটিলতা। ২০১১ তে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০ জনে একজন ক্যামেরূনিয়ান মেয়ে এই প্রথার শিকার হয়ে থাকে।

ক্যামেরুন ছাড়াও পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকা, বেনিন, চাঁদ, আইভরি কোস্ট, গিনি বিসাউ, গিনি কোনাক্রি, কেনিয়া, টোগো এবং জিম্বাবুয়েতে প্রচলিত রয়েছে এ প্রথা।

দেহ যখন নারীর, তখন সেই দেহের আকর্ষণে পুরুষ যদি তার প্রতি আগ্রাসী হয়ে ওঠে, তাহলে সেটা ঐ মেয়েটিরই দোষ, পুরুষটির নয়। সুতরাং জেনিটাল মিউটিলেশনের মতই, নারীর স্তনের প্রতি পুরুষের আকর্ষণের দায়ও নিতে হয় নারীকেই।

পৃথিবীর সব দেশেই কম বেশি এটাই যখন নিয়ম তখন এখানেও বা তার ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন!

পুরুষের স্বভাবকে যখন দোষ দেয়াই যাবে না, তার চেয়ে নারীর স্তনের বিকাশ ঘটার আগেই তাকে পিষে দেয়াই ভালো!

পরিবারের নারীরা তাই সেচ্ছায় এগিয়ে আসেন সদ্য কিশোরী এমনকি শৈশব না পেরোনো শিশুটির স্তনগুলো লোহার হাতা, চামচ, বাশের লাঠি, পাথর এমনকি হাতুড়ি গরম করে তা দিয়ে পিষে দিতে।

এর শারীরিক প্রতিক্রিয়া তো আছেই তার চেয়েও ভয়ংকর হ’লো সুদূরপ্রসারী মানসিক প্রতিক্রিয়া।

নিজের স্তনকে আকর্ষণের কেন্দ্রভাবার ধারণা একদিক যেমন এই প্রথার শিকার হওয়া মেয়েটর মনে হীনমন্যতার জন্ম দেয়, অন্যদিকে তেমনি প্রতিহত হলে তার ভবিষ্যতে স্বাভাবিক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা।

চলুন, শোনা যাক এই প্রথার শিকার হওয়া একজন তরুণীর নিজের কন্ঠেই তার অভিজ্ঞতার কথা।

“আমার বয়স তখন আট, মা বললেন, “জামাটা খোলো, তোমার কি এর মধ্যেই বুক বেড়ে গেছে? তোমার বয়সী একটা মেয়ের যখন এমন বাড়ন্ত বুক হয়, পুরুষেরা নজর দেয়!” তখনও ঠিক বুঝিনি কি করছেন তিনি। প্রতিদিন, কখনো কখনো এমনকি তিন বেলাতেই একটা গরম হাতা দিয়ে তিনি পিষে দিতেন আমার বুক। বলতেন, “তোমার ভালোর জন্যেই এসব করা”।

সে ছিলো এক দুঃস্বপ্নের মত। আমি লক্ষ্য করেছি, যত তিনি আমার স্তনগুলো পিষে দিতে চান, ততই তারা বাড়তে থাকে। একদিন যখন তিনি দেখলেন যে তে কোন কাজ হচ্ছে না, তিনি এবার নিয়ে এলেন একটা পাথর। সে যেন নরক-যন্ত্রণা। মনে হচ্ছিলো সমস্ত শরীরে যেন আগুন ধরে গেছে। একজন গাইডেন্স কাউন্সেলরকে আমি সব খুলে বললে তিনি মাকে বোঝাবার চেষ্টা করেন, যাতে এমনটা তিনি আর না করেন।

আমি এই ভেবে খুশি হয়েছিলাম, যে এবার বুঝি এসব বন্ধ হবে।  কিন্তু তিনি আবারও সেই একই কাজ করলেন, এবার ব্যবহার করলেন গরম করা ফলের বীজ।চললো মালিশের পর মালিশ। আমি নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে এলাম মাসীর বাড়ি। কখনো কখনো বোঝার চেষ্টা করি, মা এমন কেন করেছিলেন। আয়নায় নিজেকে দেখলেভীষণ যন্ত্রণা হয়!” বলছে ১৯ বছরের এক তরুণী।

মনে পড়ছে কেমন ঢাকার রাস্তাঘাট হাটবাজারে ভিড়ের ভেতর অজস্র পুরুষের হাত অক্টোপাস হয়ে জড়িয়ে ধরে, লাঞ্ছিত করে হাজার হাজার শিশু,কিশোরী, তরুণী এমনকি মধ্যবয়সী নারীর স্তন।

অন্তত ক্যামেরুনের এই মায়েরা এই সম্ভাবনাকে স্বীকার করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা তো করে নিচ্ছেন! মন্দ কী!

আমার বাড়ন্ত গড়নের কারণে কৈশোরে মা কখনো সোজা হয়ে হাঁটতে দেননি, কুঁজো হয়ে চলার সেই অভ্যেস খুব সম্ভবত আজো খানিকটা রয়ে গেছে আমার।

ঢাকার রাস্তাঘাটে ভিড়ের মাঝে তবুও নিস্তার মেলেনি সবসময়।

কিন্তু আজ এই তরুণীর ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সামনে নিজের সামান্য অস্বস্তিকে তুচ্ছ মনে হ’লো ভীষণ।

খুব জানতে ইচ্ছে করছে, যদি কোন একদিন স্বাভাবিক শারীরিক সম্পর্কে যায় মেয়েটি, কি প্রতিক্রয়া হবে তার পুরুষ সঙ্গীটির?

যে সমাজ একদিকে নারীর আর সবকিছুকে ছাপিয়ে তার স্তনকেই করে তোলে তার সৌন্দর্যের একমাত্র মাপকাঠি, সেই সমাজে বেড়ে ওঠা একজন পুরুষই বা কিভাবে দেখবে এই ক্ষতবিক্ষত স্তনের যন্ত্রণায় স্তব্ধ হয়ে থাকা তরুণীটির শারীরিক উদ্ভাস?

খুব জানতে ইচ্ছে করে, যে সমাজ ক্রমাগত নারী শরীরকে ধিক্কার দেয়, তার যৌন আকাংখাগুলোর অবদমন ঘটিয়ে চলে, এই নারীদের সঙ্গী হওয়া পুরুষগুলোর জন্যে তবে সে সমাজের কি বিধান?

লিখতে লিখতেই চোখ চলে গেলো টেলিভিশনের পর্দায় ভিক্টোরিয়াস সিক্রেটের অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপনে। উচ্ছল একদল সুন্দরী মোহময়ীর ভঙ্গীতে মেলে ধরেছে তাদের ছাঁচ বসিয়ে কাটা নিখুত শরীর, ৯৯% রক্তমাংসের মানবীর দেহের গঠনের সাথে যার কোন মিল নেই।

ভাবছি, স্তন নিয়ে বিড়ম্বিত সেই মায়ের হীনমন্য কিশোরী মেয়েটির লজ্জা আর এই অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপনের লাস্যময়ী সুন্দরীর মাঝের যে ব্যবধান, সেই শুণ্যতার ঠিক কোনখানে আমি।

আমার দেহ কিংবা এর কোন একটি অংশ সুন্দর কি না, কে তবে মেপে দেবে সেই আদর্শ?

আমার স্তনের সৌন্দর্য কিংবা আদৌ এর অস্তিত্ব থাকবে কিনা, কে তবে ঠিক করে দেবে সেই বিধান?

আমার স্তন, আদৌ তোমরা আমার তো!

কৃতজ্ঞতাঃ ভাইস ম্যাগাজিন

শেয়ার করুন: