তামান্না ইসলাম: ফেসবুক জিনিসটাকে আমার অনেকটা মানুষের বাড়ির ড্রয়িং রুম মনে হয়। সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা, সাধ্যমত সুন্দর দামী রুচিশীল আসবাবপত্র, পেইন্টিং, শো পিস। নিয়মিত ঝাড়া মোছা, তকতকে, ঝকঝকে।
কারো বাড়ির ড্রয়িং রুম দেখে রান্না ঘরের এঁটো, ঝুটা, আঁশটে গন্ধ, জমে থাকা আধোয়া থালা বাসনের পাহাড় সম্পর্কে যেমন ধারণা করা যায় না, তেমন কারো ড্রয়িং রুমে দু’এক ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে সে বাসার বেডরুমে কি ঝড় বইছে আগের রাতে বা সকাল থেকে তার আভাস পাওয়া যায় না বেশীর ভাগ সময়ই। পুরোটাই একটা খোলস, একটা আবরণ, সুখী সুখী আবরণ। ভিতরটাকে লুকিয়ে রেখে শুধু মাত্র সুখী খোলসের নিত্য নতুন রূপের প্রদর্শনী।
ছবিতে, স্ট্যাটাসে ঘুরে ফিরে একই ঘোষণা, “আমি অনেক ভালো আছি।” নতুন বাড়ি, গাড়ি, শাড়ি, ভ্যাকেশন, নিজের, পরিবারের সাফল্য, রোমান্সের ছড়াছড়ি দেখে মনে হতেই পারে জীবনটা একদম ষোল আনা পারফেক্ট, কোথাও কোন ঘাটতি নেই।
ফেসবুকে যত ধরনের ফেসমাস্ক দেখি তার মধ্যে এগুলোকে আমার সবচেয়ে নিরীহ মাস্ক মনে হয়। যে পোস্ট দেয় সে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি পায়, হয়ত ক্ষণিকের জন্য নিজেকে সুখীও ভাবে, যারা পোস্ট পড়ে, তারা কেউ বিরক্ত হয়, হয়তো কারো বুকে জ্বালা ধরে, কারো হয়তো কোনো অ্যাকশন, রিঅ্যাকশন হয় না। তারপরেও মানুষ এগুলো দেখে।
দেখা হলে জিজ্ঞ্যেস করে “…বেড়াতে গিয়েছিলে না?” কিংবা “ওই রান্নার রেসিপিটা দিও তো।” তাই বলছি, এগুলো নিরীহ মাস্ক, অন্তত মানুষের সম্পর্কে কোন টানাপোড়ন তৈরি করে না।
আরেকদল আছে, খুব অন্তর্মুখী স্বভাবের। নিরীহ মানুষ, মনের মতো মানুষ না হলে আড্ডা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। কিন্তু ফেসবুকে এসে তাদের মনের দুয়ার খুলে দেয়। তখন দেখা যায় তাদের ভিতরের চিন্তা ভাবনার তোলপাড়।
কেউ বা বিদ্রোহী, কেউ নাস্তিক, কেউ আস্তিক, কেউ মুক্তমনা, কেউ সমাজ বিরোধী। যারা এদের কাছের মানুষ না, শুধুই পরিচিত আর শুধু ফেসবুক ফ্রেন্ড, তাদের অনেক সময় অবাক লাগে, ফেসবুকের মাধ্যমে একদম আনকোরা নতুন মানুষও আবিষ্কার করেছি অনেক সময়। এটাও এক ধরনের মাস্ক, ক্ষেত্র বিশেষে রিস্কি।
একজন মানুষ সম্পর্কে ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেলে গ্যারান্টি দেওয়া যায় না সেই নতুন চেহারাটা সব সময় ভালো লাগবেই। তবে ভালো লাগলে দারুণ ভালোও লেগে যেতে পারে। খানিকটা নো রিস্ক নো গেইন অবস্থা।
তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, যখন একজন মানুষের অনেকগুলো মাস্ক থাকে আর প্রয়োজন অনুযায়ী সে একেকটা মাস্ক ব্যবহার করে। যে মানুষের সাথে পরিচয়ই বলতে গেলে ভারচুয়ালি, তাদের যদি অনেক মাস্ক থাকে আর তারা প্রথমে ব্যবহার করে সুন্দর মাস্ক, তারপরে অসুন্দর, সেটা একটা বিরাট ধাক্কা।
এই ভারচুয়াল জগত এখন আমাদের জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে, আমরা যতই এটাকে অস্বীকার করতে চাই না কেন, এটা এখন আমাদের মনোজগতে, আমাদের জীবনে একটা বিরাট ভূমিকা রাখে। তাই ভারচুয়ালি গড়ে উঠা বন্ধুত্ব বা সম্পর্কগুলোকে খুব তুচ্ছ ভাবা যায় না। অচেনা, স্বল্প চেনা বা একেবারেই না দেখা মানুষের সাথেও কথা বলতে বলতে গড়ে উঠে বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা। আর তারপরে সেই মানুষগুলো যখন এক লহমায় তাদের মাস্ক বদলে ফেলে একটা কুৎসিত চেহারা নেয়, তখন সেই শ্রদ্ধা, বন্ধুত্বের সম্পর্ক ধসে পড়ে।
একটা বন্ধুত্ব তৈরি হতে অনেক দিন সময় লাগে, কিন্তু ভেঙ্গে পড়তে লাগে একদিন বা একটি ঘটনা।