কনে দেখা অন্ধকার

Canada Tribal sউম্মে ফারহানা মৌ: ‘কনে দেখা আলো’ শব্দগুচ্ছ কবে প্রথম শুনেছি মনে নেই এখন আর। শুনতে বেশ রোমান্টিক শোনালেও আসলে কনে দেখা বিষয়টি খুব রোমান্টিক নয়, বরং বেশ পুরুষতান্ত্রিক শক্তি প্রদর্শনের ব্যাপার সেটা বুঝতে পেরেছি কৈশোর পেরোবার আগেই।

নিজে বিয়ে করেছি কোর্টে গিয়ে, তবু যখন স্বামীর মা-বাবা আমাদের বাসায় প্রথম এলেন, আমাদের বাড়ির লোকের ব্যস্ততা দেখে অদ্ভূত এক বিব্রতকর অনুভূতি হচ্ছিল; তাঁরা এসেছিলেন ছেলে নিজে বিয়ে করে ফেলেছে জেনে সেই বিয়েকে স্বীকৃতি দিতে, তাতেই আমার এই অবস্থা। যদি দেখে গিয়ে বিচার করে হ্যাঁ কিংবা না বলার এখতিয়ার তাঁদের থাকত তাহলে পুরো বিষয়টা আমার পরিবারের জন্য যতটা দুশ্চিন্তার হত, তাঁদের পরিবারের জন্য ততটাই ক্ষমতা দেখাবার ব্যাপারে পরিণত হতো সেটা বলাই বাহুল্য।

ছোটবেলা মামার জন্য পাত্রী দেখতে বহু জায়গায় গিয়েছি। বুঝিনি পাত্রপক্ষ হিসেবে একটা পরিবারকে কত ভয়ংকর পরীক্ষায় ফেলে দিচ্ছি।আমার মামা শহরের সকল বিবাহযোগ্যা কন্যাদের বাসায় বসে চা আর বাসায় বানানো সেমাই আর কৃষ্ণা কেবিনের মিষ্টি খেতে খেতে মেয়েদের দেখেছেন, আরর মা-খালারা মেয়েদের প্রশ্নবানে জর্জরিত করেছেন আর অবশেষে মামা বিয়ে করেছেন নদীর ওপাড়ের এক গ্রামের মেয়েকে।

এই যে ময়মনসিংহ শহরের ঘনবসতি এলাকায় মেয়ের চাচা বা জ্যাঠার বাড়ির বসবার ঘরে মেয়েদের রূপগুণের ব্যর্থ প্রদর্শনী, তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কি তা আমরা জানি না, খবরও নেইনি। কে জানে সেই মেয়েদের মায়েদের কত প্রশ্ন শুনতে হয়েছে পড়শিদের কাছ থেকে, “কি গো অমুকের মা, তুমার মাইয়ারে যে দেখবার আইলো হেইদিন, পছন্দ অইসেনি? কিছু জানাইসে না অহন তরি? ক্যা, অমুক ত দ্যাখতে শুনতে বালাই, ল্যাহাপড়াও করসে… কি আর করবা, মন ছুডু কইরো না,বিয়া শাদী আল্লার হাতঅ, গাং থাকলে পাড় আসে, মাইয়া থাকলে বিয়া আসে, এরচে বালা পাত্র পাইবা, দেইখ্যনে”।

হয়তো আড়ালে বলেছেন অন্য কথা, পাত্রের তুলনায় পাত্রীর অযোগ্যতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার করে গবেষণা করে ক্ষান্ত হয়েছেন তাঁরা। এই মফঃস্বল শহরে ‘৮৮ কি ৯০ সালের দিকে এ অতি সাধারণ স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু স্বাভাবিক বলেই কি তা সহনীয়?

যাই হোক, সেটা গত শতাব্দীর কথা। তখন ফেইসবুক বা স্কাইপ ছিলনা। কিন্তু এখন এই ২০১৫ যখন প্রাইমারি লেভেলে পড়া বাচ্চাদের কাছেও ইন্টারনেট রয়েছে, কেন সাজিয়ে গুছিয়ে মেয়েকে বসবার ঘরে একগাদা লোকের সামনে ইন্টারভিউ দিতে বসাতে হবে তা আমার মোটা মাথায় ঢুকছে না।

কিন্তু আমি দেখলাম এখনও এটা আমি ছাড়া সকলের কাছেই স্বাভাবিক ঘটনা। আমার এক বোনকে (কাজিন) দেখতে এসে ছেলের দুলাভাই প্রথম যে প্রশ্ন করলেন তা হলো, ‘স্বাস্থ্যের এই অবস্থা ক্যান?’ ভদ্র(?!)লোক নিজে ওভারওয়েট, তার সু(?!)স্বাস্থ্যের রহস্য বোঝা গেল ডাইনিং টেবিলে। একটু আগে ছেলের বাবার রেজাল্ট সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন যে, আজকাল গোল্ডেন এ প্লাস ছাড়া কোন রেজাল্টই ভাল না, আর্টসে হলেও না আর ছেলের বাপ মা তাদের ছেলেমেয়েদের ভাল ফলাফলের কীর্তন গাইতে শুরু করলেন।

FB_IMG_1431803590252
উম্মে ফারহানা মৌ

আমার বলতে ইচ্ছা করলো, ‘আপনি কি জামাকাপড়ের উপর দিয়ে স্ক্যান করছিলেন আমার বোনের গায়ের কোথায় কতটূকু মাংস আছে? কোরবানির গরু কিনতে আসছেন নাকি ভাই?’ মুখে বললাম, ‘দুলাভাই, আপনি রেজাল্টের বিষয়ে ট্রেন্ড জানেন, আর স্বাস্থ্যের বিষয়ে জানেন না? আজকাল জিরো ফিগারই স্টাইল’।

আমার কথায় সকলে হাসলেও আমার মুখের ভেতরে তেতো স্বাদ। ছেলের মা মেয়ের ফুপুকে বললেন, “খাওয়াইবাইন”। আমার বলতে ইচ্ছা হলো, “আন্টি আপনার কি ধারণা মেয়েকে আমরা খাওয়াই না?” বললাম না কারণ এতে সম্বন্ধ ভেস্তে যেতে পারে। স্বাস্থ্য কেন ভাল হয়, আর খারাপ হয়, সেই প্রসঙ্গ উঠে গেল, ছেলে খুব বিজ্ঞের মতন বলল, “মেটাবলিজম বলে একটা টার্ম আছে, যার মেটাবলিজম বেশি সে কম মোটা হয়, আর যাদের মেটাবলিজম কম, তাঁরা কম খেলেও মোটা হয়ে যায়”।

আমার বলতে ইচ্ছা করল, “ভাইয়া তোমার কি ধারণা এখানে তুমি একাই শিক্ষিত? আমরা কেউ মেটাবলিজম মানে জানি না?” এরপর দুলাভাই মেয়েকে উঠে দাঁড়াতে বললেন, এই পর্যায়ে আমার স্বামী উঠে চলে গেলেন ভেতরের ঘরে। দুলাভাই তার নিজের স্ত্রীকে পাশে দাঁড়াতে বললেন। মহিলা আগেই বুঝেছিলেন যে দুই ইঞ্চি উঁচু স্যান্ডেলেও তিনি আমার খালি পায়ে দাঁড়ানো বোনের সমান লম্বা হতে পারবেন না, তাই তিনি দাঁড়াতে চাইছিলেন না, কিন্তু স্বামীর পীড়াপীড়িতে দাঁড়াতে হলো, বউকে মাপিয়ে পারলেন না তাই শাশুড়িকে মাপালেন, মহিলা স্যান্ডেল পায়ে মোটামুটি পাত্রীর কাছাকাছি পৌঁছালেও উনারা সিদ্ধান্ত দিলেন, ‘সমানই’।

আমি কিনা মোটা মাথা, বললাম, “আন্টির পায়ে ত স্যান্ডেল”।

“না না, ওইটা ফ্ল্যাট স্যান্ডেল”। মনে মনে বললাম, “মূর্খের দল, তোরাই খুশি থাক”।

আমার কপালের টিপ দেখে ছেলের মা বললেন, “আর কোন টিপ আছিল না আপনের? আমি ত দেইখা মনে করছি হিন্দু”। মহিলা নিজে গা ভর্তি গয়না আর ঠোঁটে মেরিলিন মনরোর মতন লাল শেডের লিপস্টিক পরে এসেছেন।

আমার মনে হলো বলি, “আন্টি আপনার বাংলা শুনেও আপনাকে হিন্দু মনে হয়, আরবি বা ফার্সি ভাষায় কথা বলতে পারেন না কেন?”

মুখ চুন করে জবাব দিলাম, “এটা ত লাল না” যদিও লাল টিপ আমি হামেশাই পরি। তাঁদের তিন বছরের মেয়েটির কপালেও কাল টিপ পরা, লাল টিপে গুনাহ হয় আর কাল টিপে হয় না এমন আজিব ধারণা যেসকল বাঙালি মুসলমানেরা তৈরি করেন তাঁদের এটা বলে লাভ নেই যে মাত্র কয়েকশ বছর আগে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা সকলেই হিন্দু কি বৌদ্ধ কি কুল ভিল সাঁওতাল ছিলেন।

খেতে বসে দুলাভাই বাদে সকলেই খাবার নষ্ট করলেন। আমি যদ্দূর জানি হাদীসে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ছোটবেলা আম্মা আর নানী থালার বাইরে ভাত পড়লে তুলে খাওয়াতেন। তাই বড় হতে হতে এমন অভ্যাস হয়েছে যে একটা খাদ্যকণাও থালার বাইরে পড়ে না। কিন্তু উনাদের ধর্মানুভুতি দেখলাম রঙিন টিপের বিরুদ্ধেই সীমাবদ্ধ। খাদ্যের অপচয়ে উনাদের ধর্মানুভুতি আহত হয় না।

তাঁদের পুত্রকন্যাদের ভাল ফলের ভজন কীর্তনে অতীষ্ঠ হয়ে মেয়ের মাও খানিক পরে সুন্দর করে বললেন যে, তাঁর পুত্র এবং আর পরিবারের অন্যান্য পুত্রকন্যারা  কে কতগুলো লেটার মার্কস আর স্টার মার্কস নিয়ে কোন কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। কিন্তু কুয়ার ব্যাঙ কুয়াকেই পুরো দুনিয়া ভাবে। শহরের এক প্রান্তের এক এলাকায়, যার আশে পাশে প্রায় পুরোটাই গ্রাম, সেখানে নিজের সন্তানদের ভাল ছাত্রত্বের খ্যাতির গর্বে মা- বাপের মাটিতে আর পা পড়ে না।

কিন্তু কে জানে, হয়তো ওই কুয়াতেই আমার বোনকে বাকি জীবন কাটাতে হবে। বিয়েটা হয়ে গেলে এসব বিষোদগার আমাকে দারুণ অস্বস্তিতেও ফেলে দিতে পারে। কিন্তু ভরসার বিষয় এই যে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করা ছেলে বা তাঁর আত্মীয়রা আমার এই লেখা কোনদিন পড়বেন না।

কনে দেখা আলো যে আলোকে বলে সেটা গোধূলি লগ্নের আলো। এই আলো মিলিয়ে যাবার পর ধীরে ধীরে অন্ধকার হতে থাকে। ‘স্ত্রীর পত্রে’র ওই লাইনগুলো কি মনে পড়ে যেখানে মৃণাল তাকে দেখতে আসার দিনের কথা লিখছিলেন? মনে করিয়ে দিই “বাবার বুক দুরুদুরু করতে লাগল, মা দূর্গানাম জপ করতে লাগলেন। শহরের দেবতাকে পাড়াগাঁয়ের পূজারি কী দিয়ে সন্তুষ্ট করবে! মেয়ের রূপের উপর ভরসা; কিন্তু রূপের গুমর তো মেয়ের মধ্যে নেই, যে ব্যক্তি দেখতে এসেছে সে তাকে যে দামই দেবে সেই তার দাম। তাইতো হাজার রূপেগুণেও মেয়েমানুষের সংকোচ কিছুতে ঘোচে না।

সমস্ত বাড়ির, এমনকি, সমস্ত পাড়ার এই আতঙ্ক আমার বুকের মধ্যে পাথরের মতো চেপে বসল। সেদিনকার আকাশের যত আলো এবং জগতের সকল শক্তি যেন বারো বছরের একটি পাড়াগেঁয়ে মেয়েকে দুইজন পরীক্ষকের দুই জোড়া চোখের সামনে তুলে ধরবার জন্য পেয়াদাগিরি করছিল – আমার কোথাও লুকোবার জায়গা ছিলনা”  

আমার বোনকে দেখতে এসেছে রাতে, রডলাইটের আলোয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গেছে। আমার মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে এখনও এত আঁধার কেন?  

আমার বোনের অনুভূতি আমি জানি না। কিন্তু আমার পুরোটা সময় মনে হচ্ছিল, ধরণী দ্বিধা হও, আমি তোমার ভেতরে আশ্রয় নিই। সেদিনের পর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হয় – এই কনে দেখা আর দেখানোর প্রথা চিরতরে বিলুপ্ত হোক। আমি আমার কোন ভাইয়ের জন্য বা ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে পরীক্ষক হয়ে যেতে চাই না, আমার কোন বোনকে বা মেয়েকে, ননদকে বা ভাগ্নি ভাতিঝিকে পাত্রপক্ষের সামনে উপস্থিত করতে চাই না। দূর হোক কনে দেখা অন্ধকার প্রথা।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.