লক্ষ্মী মেয়ের সংজ্ঞা কী?

Meye 7তামান্না ইসলাম: ছোটবেলা থেকে আমার আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবাই আমাকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রিয় ছাত্রী। মায়ের বান্ধবীরা বলতেন “কী লক্ষ্মী মেয়ে”। এর একটা অন্যতম কারণ ছিল, আমি খুব নিচু স্বরে কথা বলি, কোনরকম তর্ক-বিতর্ক করি না। এই সব যে ইচ্ছা করে করতাম তা না, গলার স্বর এবং স্বভাব প্রকৃতি প্রদত্ত, সেই সাথে প্রশংসাগুলো নিশ্চয়ই পরোক্ষভাবে হলেও উৎসাহ জুগাতো।

এই হলো আমাদের সমাজে শেখানো তথাকথিত “লক্ষ্মী মেয়ের” সংজ্ঞা। সাত চড়ে রা করবে না, তর্ক থেকে শত হাত দূরে থাকবে। গুরুজন বিশেষ করে পুরুষ শাসন অন্ততপক্ষে আধিপত্য মেনে নিবে নির্বিবাদে। এগুলো আমাদের মাথার মধ্যে ছোটবেলা থেকে গেঁথে দেওয়া হয়। এই ব্যাপার গুলো আমার মাথায় আসে নাই অনেকদিনই।

স্কুল এবং কলেজে পড়েছি গার্লস স্কুলে, গার্লস কলেজে। সেখানে সবাই মেয়ে, তাই কোন বৈষম্য আলাদাভাবে টের পেতাম না। বড় হয়েছি মোটামুটি আধুনিক, উদারপন্থী বাবা-মায়ের কাছে, তাই বাসাতেও যে বিরাট কোন পার্থক্য বুঝতে পেরেছি, তা না। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্নগুলো মাথায় আসেনি।

লক্ষ্মী মেয়ে হয়েই আমি খুশী ছিলাম, সেটাই ছিল আমার অহংকার।

ইউনিভারসিটিতে গিয়ে প্রথম ছেলেদের সাথে একসাথে পড়াশোনা করার সুযোগ পেলাম। আস্তে আস্তে জীবনের বাস্তবতাগুলো সামনে আসতে শুরু করলো। একটা মেয়ে ততদিনই লক্ষ্মী, যতদিন সে ছেলেদের পিছনের কাতারে থাকতে রাজী।

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের “বউ বউ টাইপ” মেয়েরা সবার প্রিয় পাত্রী, সবার কাঙ্ক্ষিত।  মেয়েরা রাঁধবে, সাজবে, বাচ্চা পালবে, সংসার সামলাবে। পড়ালেখা, চাকরির সুযোগ পাচ্ছে এই তো এক বিরাট সুযোগ, পড়ালেখা করে চাকরি করতে রোজ রোজ ঘরের বাইরে যেতে পারবে, সংসার থেকে ছুটি পাবে, সংসারের রুটি-রুজিতে অংশগ্রহণ করবে, এই তো কত বড় সৌভাগ্য এবং সম্মান।

মেয়ে, তুমি এর চেয়ে বেশী এগিও না, এটাই তোমার সীমানা। পড়ালেখা থেকে শুরু করে, যেকোনো প্রতিযোগিতায় কোনো মেয়ে যদি ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে যায়, সেটা মেনে নিতে সবার বড় বেশী কষ্ট হয়। ইউনিভার্সিটির শীর্ষ স্থানে  থাকা মেয়েকে তার প্রতিযোগী ছেলেদের কাছে শুনতে হয়, শিক্ষকদের অনুগ্রহে সে মেয়ে ভাল ফলাফল করেছে, তার নিজের যোগ্যতায় নয়। প্রতিবাদ করা তো পরের ব্যাপার, ছেলেদের চেয়ে ভালো ফলাফল করাটাই এক ধরনের অপরাধ, চিরায়ত প্রথা ভাঙ্গার অপরাধ।

পুরুষ আধিপত্যের এই প্রথা  ভেঙ্গে ফেলার সাথে সাথে ভেঙ্গে পরে সেই লক্ষ্মী মেয়ে ইমেজ। যে কোনো প্রতিযোগিতায় ঈর্ষা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু ছেলে এবং মেয়ের প্রতিযোগিতায় ঈর্ষার বাইরে আরেকটা ব্যাপার কাজ করে প্রবলভাবে, সেটা হলো, হীনমন্যতা।

শক্তিশালী, সফল মেয়েদের সামনে চিরকালের বিজয়ী পুরুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে,  তার আধিপত্যের সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যাওয়ার আতঙ্কে ভুগে। তাদেরও মাথার মধ্যে ছোটবেলা থেকে গেঁথে দেওয়া আছে “তুমি পুরুষ, তুমিই শ্রেষ্ঠ। একটা মেয়ে তোমার চেয়ে এগিয়ে গেল, তুমি কেমন পুরুষ?” “লক্ষ্মী মেয়ে” “চির লক্ষ্মী নারী” খেতাবের মোড়কে মুড়ে যতদিন মেয়েদেরকে পদানত রাখা যায়, ততদিনই তাদের সাম্রাজ্য, ক্ষমতার দাপট টিকে থাকবে।

আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে, এই ২০ বছরে দেশের অবস্থার কি কোনো উন্নতি হয়েছে এ বিষয়ে? আমার বিশ্বাস, হয়নি। ভারচুয়াল জগতের কল্যাণে দেশের শিক্ষিত সমাজের সবার সাথে সবার মোটামুটি যোগাযোগ আছে। বিভিন্ন ইন্টারনেট গ্রুপের কারণে, ব্লগের কারণে দিন-রাত চলে অহরহ আলোচনা, সমালোচনা, মন্তব্য।  এসব  থেকে দেশের সামগ্রিক শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মন মানসিকতার গড়ন সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।  যেসব গ্রুপে ছেলেমেয়ে উভয়ই বিদ্যমান, সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় পুরুষ আধিপত্য।

যতক্ষণ মেয়েরা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে “প্রিন্সেস তোকে খুব সুন্দর লাগছে।” “ভাইয়া আপনার লেখাটা মন ছুঁয়ে গেল”,  ততক্ষণ ঠিক। কিন্তু এটাই তাদের সীমানা। নিজের মতামত বেশী দেওয়া যাবে না। “লক্ষ্মী মেয়েদের” কোন স্বতন্ত্র মতামত থাকতে নেই। তাদেরকে থাকতে হবে  সব সময় “প্যাসিভ ক্যারেক্টার” হয়ে।

মেয়েদের শক্ত, স্বতন্ত্র মতামত কারো ভালো লাগে না, মেয়েদেরকে তো খালি মেয়েলিপনাই মানায় আর সেই মেয়েলিপনার সংজ্ঞায় স্বতন্ত্র মতামত অন্তর্ভুক্ত নয়। মেয়েরা ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে লেখালেখি করবে, নিজেদের সুবিধা অসুবিধার কথা বলবে, সমাজের বড় বড় সমস্যা নিয়ে ভাববে, কি দরকার এসবের?

আবার সেই আধিপত্যের সাম্রাজ্য ভাঙ্গার হুমকি, নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্ক। যাও মেয়ে তুমি পিছনের কাতারে, দর্শক আর শ্রোতার সারিতে, হাত তালি দাও, চোখের জল ফেল, বড় জোর খুশীতে হাসো, দাঁত কেলাও, কিন্তু খবরদার সামনের সারিতে আসার দুঃসাহস করো না, পুরুষের সাথে চিন্তা ভাবনায়, জ্ঞানে সমান সমান হতে চেও না।

আমাদের ছোট বেলায় মাথায় গেঁথে দেওয়া সেই “লক্ষ্মী মেয়ে” ইমেজের সাথে আমরা কিছু বাই প্রডাক্টও পাই।  তর্ক বিতর্ক না করে করে, আমাদের হৃদপিণ্ডটা থাকে দুর্বল, কারো সাথে তর্কে জড়াতে  গেলে একশবার ভাবি, তারপরেও বুক কাঁপে। বহুদিনের অভ্যাসে অশ্রু গ্রন্থিগুলো থাকে ঢিলা।  যেকোনো সমালোচনায় কেঁদে বুক ভাসাই, তারপর সে অপমান সইতে না পেরে অভিমানে ত্যাগ করি নিজের আসন। যদিও জানি, এসবই পাতানো খেলা, অবুঝ ছোটবেলার পাওয়া সেই “লক্ষ্মী মেয়ে” খেতাবকে বড় বেলায় যেন ধরে রাখতে চাই, তাই এই প্ররোচনা, আমার সফলতা যার মনে হীনমন্যতা তৈরি করে, তারই পাতা ফাঁদে পরে তাকে জেতার সুযোগ করে দেই নিজের এই মানসিক দুর্বলতার কারণে। আমরা যতোই নিজেদেরকে এই প্রতিযোগিতা থেকে প্রত্যাখ্যান করবো, গুটিয়ে নেবো, ততোই সুবিধা প্রথাগত আধিপত্যবাদি পুরুষদের।

সফল মেয়ে তোমাকে বলছি, “লক্ষ্মী  মেয়ের” ইমেজ ভেঙ্গে বেরিয়ে এসো, নাহলে তোমার বহু কষ্টে অর্জিত এই সফলতা কোনদিনও শীর্ষে পৌঁছাতে পারবে না।

শেয়ার করুন: