সুপ্রীতি ধর: “নিদ্রাহীন জননীর রাত্রি যাপন; চরিত্রগুলো বদলায় কিন্ত এই যাপিত জীবন বদলায় না, সময়ের হেরফের ঘটে, দেশের সীমানা ভিন্ন হয় কিন্ত জননী থাকে অপেক্ষায়/
চারদিকের কোলাহল অপসৃত হয়; মনের কোনে সন্তানের পদধ্বনি বাজে, নিজের গায়ের চাদরকে মনে হয় সন্তানের জন্যে নিরাপত্তার বর্ম; জননীরা থাকে ঘুমের ভেতরে নিদ্রাহীন…………অগ্রজ আলী রীয়াজ ভাইয়ের এই কথাটির রেশ ধরেই মনে পড়ে গেল, আমাদের জন্য মায়েদের আকুতির কথা।
আমরা যারা সোভিয়েত ইউনিয়নে তখন পড়তে যেতাম, সবার মা-বাবার সাথেই যোগাযোগ থাকতো সেখানকার ছাত্র সংগঠনের নেতাদের। তাদের কাছে আমাদের মা-বাবারা চিঠি লিখতেন, জানতে চাইতেন আমাদের কষ্টের কথা, ভালো থাকার কথা, তারাও সময় নিয়ে, বেশ গুছিয়ে সেইসব চিঠির উত্তর লিখতেন। কোনদিন হয়তো এই বন্ধনগুলোর দেখা-সাক্ষাতই হয়নি, কিন্তু অদৃশ্য থেকেও বেশ দৃশ্যমান ছিল সেসব সম্পর্ক। অভিভাবকসুলভ আদর পেতাম বড় ভাই-বোনদের কাছ থেকে।
সবে কৈশোর উত্তীর্ণ আমরা পা বাড়িয়েছি সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ভাষার এক দেশে। শুধুই তাই নয়, ভাষার মধ্যেও আরেক ভাষা, ইউরোপ-এশিয়ার সংস্কৃতির মিশেল হলেও বেশ ঠাসা সেই বুনন, সেখানে নিজেদের খাপ-খাওয়াতে গিয়ে কত চোখের সমুদ্র বইয়ে দিয়েছি, সেইসব গল্পের শেষ নেই। আক্ষরিক অর্থেই চোখের জলে ভিজিয়ে ভিজিয়ে চিঠি লিখতাম মাকে, বাড়িতে ফেলে যাওয়া ছোট ছোট বিচ্ছুবাহিনীকে। প্রত্যুত্তরে মায়ের থাকতো আদরমাখা, উপদেশমাখা, সান্ত্বনামূলক সব কথা, আর বিচ্ছুরা লিখতো, তাদের দাবি-দাওয়ার কথা। আবারও চোখের জল ফেলতে ফেলতে সেই চিঠি দিনভর পড়তাম, সকালে রোদের আলোয়, রাতে কৃত্রিম আলোয়। এমনকি অনেক সময় বালিশের নিচে রেখে দেয়া সেই চিঠিতে রাতের অন্ধকারেও হাত বুলাতাম। আরেকটা নতুন চিঠি না আসা পর্যন্ত এই একটি চিঠিই মনে হতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
তখন ডিজিটাল যুগের ধারেকাছেও ছিলাম না আমরা। একটা চিঠি পৌঁছাতে সময় নিতে ১৩ থেকে ২২ দিন, এ কারণে মাকে বলেছিলাম যেন সে দুদিন বা তিনদিন পর পর চিঠি পাঠায়, যেন আমি একটা নির্দ্দিষ্ট সময় পর পর সেগুলো পাই। আমার চিঠি পাঠানোর মূল্য ছিল অনেক কম, কিন্তু দেশে তো তা ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। তারপরও মা লিখতো। চিঠিতে নাক লাগিয়ে আমি মায়ের গন্ধ খুঁজতাম।
কিন্তু যতো দিন যাচ্ছিল সেই দেশটিতে, এক চিঠি থেকে আরেক চিঠির মধ্যবর্তী সময়সীমা কেবলই বাড়ছিল। মাঝে মাঝে বেশ অনেকদিন হয়ে যেত মায়ের চিঠির উত্তর দিতে, মায়ের তখন সেকী চিন্তা। ততদিনে মস্কো থেকে ধমকমিশ্রিত কিছু চিঠিও চলে আসতো আমার ঠিকানায়। আমি হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছি, মাকে বলেছি যে, ইউক্রেনের ১০টি শহরে যাচ্ছি। মায়ের কী ধারণা আছে যে, সেই দূরত্ব কতটুকু? দশটি শহর মানে কতদিনের সফর? না, চিন্তাতেও নেই।
প্রথম বছরটা আমি ছিলাম আরমেনিয়ার রাজধানী ইরেভানে। এক বছর পরই সেখান থেকে লেনিনগ্রাদে (বর্তমানের সেন্ট পিটার্সবুর্গ) স্থানান্তর হলাম। প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিয়েছি এই শহর বদলাতে গিয়ে। তারও দুবছর পর যখন আরমেনিয়াতে ভয়াবহ ভূমিকম্প হলো, ক্ষতিগ্রস্ত শহরটির নাম ছিল লেনিনাকান। টিভিতে খবর শুনে মায়ের নাকি নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। মা আমার আরমেনিয়া আর লেনিনগ্রাদ (লেনিনাকান) গুলিয়ে ফেলেছে। একেই বলে মায়ের মন।
সোভিয়েত থেকে কেউ দেশে আসা মানেই আমাদের সবার কাড়ি কাড়ি চিঠি বহন করে নিয়ে আসা। সেইসাথে ছোটখাটো সব গিফট। যে আসতো, তার ওপর দায়িত্ব থাকতো, সেই চিঠিগুলো পোস্ট করা। আর সেই চিঠিতে থাকতো পত্রবাহকের ঠিকানা, যে ঠিকানায় মা-বাবারা যত্নের সাথে পৌঁছে দিতেন জিন্স, মশল্লা বা আচার। একবার আমি ৫৫ কেজি বহন করে নিয়ে গেছিলাম। সেই যুগে এরোফ্লোটেই এটা সম্ভব ছিল। কোনটাই ফেলার উপায় ছিল না, মা দিয়েছেন। দেয়ার সময় বলে গেছেন, ‘তোমরা সবাই মিলে-মিশে খেও, একটু বেশি করে দিয়েছি।’
পর পর তিনটা বছর ভীষণ অসুস্থ ছিলাম। শীত এলেই চোখের কোণে অঞ্জনি উঠতো, চোখের ভিতরে ইনজেকশন দিয়ে তা সাময়িকভাবে কমানো হতো, আর ছিল পেটে ব্যথা। একে তো বিদেশ, তার ওপর বয়স কম, অসুস্থতার কথা কিছু কিছু জানাই মাকে, বেশিরভাগটাই জানানো হয় না। তখনই জেনে গিয়েছিলাম, এতোদূর থেকে এসব জানিয়ে লাভ নেই। আর যেদেশে অসুস্থতা নিয়ে আমার চিন্তা করারই তেমন কিছু নেই, সেখানে দূরে থাকা মাকে অস্থির করে লাভ কী? তো, একবার অনেকদিন আমার কোনো সাড়া না পেয়ে মা চিঠি লিখে যায় একের পর এক। আমি তখন অপারেশন টেবিলে, খবর পাই, চারটা চিঠি এসেছে মায়ের। ভাবলাম, চিঠিগুলো না পড়ে অপারেশনে গিয়ে পড়ে যদি আর ফিরে না আসি! কিন্তু সেই চিঠিগুলো তখন আর পড়ার অবকাশ আমার ছিল না। কিন্তু ফিরে এসেছিলাম, মায়ের উদ্বেগমাখা চিঠিগুলোই হয়তো আমার দ্রুত আরোগ্য লাভের পথ ত্বরান্বিত করেছিল, কে জানে! একটু সুস্থ হয়েই তখন দেশে আসি, মায়ের কাছে।
১৯৯০ থেকে ৯৫, মাঝে পাঁচটি বছর মাকে ছেড়ে আমি, বা আমাকে ছেড়ে মা, এভাবেই কাটিয়েছি। ৯৪ এর শেষের দিকে জানতে পারি মায়ের বড় অপারেশনের কথা, আর এটাও জানতে পারি যে, মা আমাকে দেখতে চেয়েছে। মনের কোণে জমানো সব ক্ষোভ উবে গিয়ে পথ খুঁজতে থাকি দেশে আসার। ততদিনে আমার কোলে আরেক মা। সেবার দেশে আসার পিছনে কারণই ছিল ‘মা’। সেই মা যখন ২০১০ সালে আমাকে ছেড়ে যায়, তখনও মনস্থির করে ফেলি, আর তো কোন পিছুটান আমার নেই, তবে কেন পড়ে থাকা এই পোড়ার দেশে! কিন্তু যাবো বললেই তো আর যাওয়া হয় না। জীবনের রুদ্ধ পথগুলো একের পর এক খুলে এগিয়ে যেতে থাকি মোক্ষম সময়টির অপেক্ষায়। এখনও কী শেষ হয়েছে সেই অপেক্ষা? হয়তো হয়েছে, হয়তো হয়নি।
নিজে মা হওয়ার দুর্ভাগ্য-সৌভাগ্য দুটোই আমার হয়েছে। সন্তান থাকার যে যন্ত্রণা, তা সে বুঝবে না, যার নেই। যার আছে, সেই কেবল জানে, এই থাকাটা একইসাথে কত কষ্টের এবং আনন্দের। কষ্টটাই বেশি।
আমি এখন অপেক্ষায় থাকি আমার দূরে থাকা সন্তানের একটা ফোনকল, একটা হোয়াটসআপ মেসেজ, ভাইবার কল বা ফেসবুক মেসেজের।
এখন যুগ সহজ হয়েছে, যোগাযোগ এখন এক তুড়িতেই সম্ভব। কিন্তু অস্থিরতা কী কমেছে! কমেনি, বরং বেড়েছে আগের তুলনায়। এখন প্রতি মূহূর্তের গতিবিধি জানা হয়ে যায় বলেই রাত নির্ঘুম হয়েছে আরও বেশি সংখ্যায়। ফোন করে কথা বলতে বলতে মেয়েকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে তারপরই শান্ত হই। যা নাকি মেয়ের ভাষায় ‘গোয়েন্দাগিরি’ নাম পেয়েছে। হোক, তবুও চিন্তার ভাঁজ পরা কপালে কিছুটা হলেও শান্তি খেলা করে। যুগ পাল্টায়, কিন্তু পাল্টায় না মায়েদের দু:শ্চিন্তার পালা……প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তা ছড়িয়ে যায় নতুন রূপে, নতুন ধরনে। (চলবে)