বৃষ্টিতে একাকিনী
এই ভেজা জুনে, বৃষ্টির পর
আনত হয়ে আছে ঘাস,
ভিজে জবজবে হয়ে আছে
উঠোনের তারে শুকোতে দেয়া শাড়ি।
শাড়ির ভেতর যে থাকে
বাড়ির ভেতর, জানালায়
সে কেমন আনত হয়ে আছে;
হয়ে আছে অধোবদন।
ভেজা জুন, একাকিনীর বাড়ির দ্বারে
বেশিক্ষণ ঝরো না আর;
শাড়ি ভিজে কাঁপছে
এইবার তুমি তাকে রোদ্রে শুকাও।
রূপকথা নয়
কোথায় রংধনু সে হিসেব তোমার
আমি আছি চাঁড়ালের দেশে;
তবুও এ দেশ আমার।
বাঁশঝাড়ে মাঝরাতে কেঁদে ওঠে যে পাখি
সে আমার অনাত্মীয় নয়,
জাল ফেলে আশাহত ফিরে আসে যে
সে আমার খেলার সাথী,
তার অভুক্ত সংসারে আছে আমার স্বজন।
আমাকে দিও না দোহাই
নগরের কবি, তোমার সুনাম আমার
স্বপ্নের সাথী নয়।
বলতে পারো, স্বাতী তারা
যে কি না দূরে আছে,
যে কি-না কিছু নয় রাজার কাছে,
জনপদে সে-ই এক বন্ধুর নাম;
আকালে সে গল্প জুগিয়েছে।
মঞ্চ তোমার হোক,
দুধে ভেজা পদাবলী নিয়ে তুমি
রাজার দরবার রাঙাও।
আমরা কুলি ও কামিন জন,
আমার ভাই লিমনের পঙ্গুত্বের দিনেও
ভয়বন্দী সবাই গোল হয়ে বসে
শুনছি তোমার রাজশংসা বচন।
দূরে থাকা নগর কবি, চণ্ডালেরা জেনেছে
বাঁশঝাড়ে কেঁদে ওঠা ঘুঘু পাখি
সে তোমার নয়;
তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায়
যে গল্প জন্ম নিচ্ছে তা তোমার নয়।
আমাদের ঘরে ঘরে বেড়ে উঠছে যে
কালিয়া মোহন্ত, কংকা মাঝি আর
ঘাড়ত্যাড়া কৈবর্ত যুবক
এরা কেউ মগধ বা বৈশালীর রাজকবি নয়,
এরা সব চণ্ডাল, লিমনের ভাই;
রাজাকে জানিও একদিন এরাই সব রপকথা লিখবে।
সে
এরা সব নামহীন মৃত মানুষ,
কেউ ‘তিনি’, কেউ ‘সে’ এবং
কেউ- ‘কেউ না’ বলে কিছু নেই;
এখানে সবাই ‘সে’।
কে এই ‘সে’?
‘সে’ এক উহ্য মানুষ বললো একজন।
কেউ জানালো উহু,
এমনটি হতেই পারে না;
যাপিত রসে ‘উহ্য’ শব্দে কেতা আছে বটে,
তবু তা সকলের কাছে নয়।
কেউ কেউ এমন আছেন-
যারা অকারণ ভেসে যান
অপরিচিত বাস যাত্রীর হাসির মূর্ছনায়;
অনাহারে মরে যাওয়া এক পিতার খবর
দৈনিক কাগজে পড়ে খাবার প্লেট দূরে
ঠেলে অভুক্ত কাটান সারা রাত; আবার
এমন একটি যুবককে জানি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে গুলিতে নিহত ছাত্র
আবু বকরের কথা, ছেলেকে ঢাকায় পড়ার খরচ যোগাতে
ওর মায়ের মাথায় নারিকেল তেল না দেয়ার গল্প পড়ে
সে যুবক শিশুর মতো কেঁদেছে; কেঁদে কেঁদে
হেঁচকির মতো হয়ে বুজে এসেছে তার গলা;
অথচ কৃষাণের ছেলে বকর ও তার মা-কে
খবর মারফত-ই চিনেছিলো ‘সে’।
সুতরাং ‘সে’ মানে শুধুই ‘উহ্য মানুষ’
কথাটায় কারো কারো ঘোর আপত্তি।
যুদ্ধের ময়দানের ফিলিস্তিনি,
ইরাকের ঘাঁটিতে মার্কিন সৈন্য
কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে পরে থাকা ইহুদি
আজ তারা শুধুই – মৃত মানুষের সারি,
সে অথবা উহ্য মানুষ
এমনটি তো মেনে নিতে পারছে না অনেকেই;
এমতাবস্থায় একটি যর্থাথ শব্দের জন্য
কবিদের কাছে যাবার পক্ষে মত দিয়েছে কেউ,
কিন্তু কেউ আবার জোড়ালো গলায় বললো:
শুধুই শব্দ দিয়ে পরিচয়ের এ সংকট
কবি কি মেটাতে পারবে?
আর যদি তা হয়-ও, কবির দেয়া শব্দ
রাজনীতিবিদেরা মেনেই বা নেবে কেন?
আর্তি
আলুথালু চুলে তুমি আর দাঁড়িও না নজরে আমার;
যে গিয়েছে বসুধরা বোনটি তোমার,
যে গিয়েছে তরুণীর প্রেম ছিপছিপে শ্যামলা যুবক,
যে গিয়েছে মা তোমাকে অনাথা করে,
তোমাকে বিধবা করে যে গিয়েছে স্বামী,
সকলে তারা আজ এই আলুথালু চুলের মধ্যে
অতৃপ্ত আত্মা হয়ে আমার দিকে চায়।
তুমি হে অনাথা, বিধবা বোন,
বুক খালি হওয়া মা, দয়া করো,
তোমাকে বইতে পারছি না আর।
আমার দিনের খাওয়ায়, রাতের ঘুমে,
সঙ্গম সময়ের কোমল মধুরতায়
তোমরা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছো।
এই যে তুমি, মরা পায়ে কী সুন্দর রুপার নুপূর,
পোড়া নাকে কালচে বর্ণের মনোহর নাকফুল,
তোমরা সরে যাও আমার সামনে থেকে;
আমি আর সইতে পারছি না
অনাথার এলোচুলে তোমাদের ত্রস্ত ছোটাছুটি,
আর আমি বইতে পারছি না
তোমাদের বুকের মধ্যে বাতাস না পাওয়ার ভার।
আমার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে,
বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে,
হৃদপিণ্ডের রক্ত উঠে আসছে দুচোখে আমার;
আমি ছাইয়ের মধ্যে হয়ে যাচ্ছি পোড়া নাকফুল,
ইট-সুড়কির কবরে আমি হয়ে যাচ্ছি রূপালি পায়েল,
আমাকে বাঁচাও।
যে দিকে তাকাও সায়র
এই সুবর্ণ দুপুর,
আমের মুকুলে, বকুলের কলি ফুলে
দোলা দিয়ে চলা এই চঞ্চল হাওয়া
সহসা এমন আসমানী গজব হয়ে
কেনো আজ নেমে আসে দাওয়ায়?
যে করেছে পূত জীবন-যাপন
তাকেই লানৎ ঢেলে বলো হে বাতেনী চোখ,
কোন সত্যের তুমি করো রচনা?
পূজারির নিবেদিত কলব দমে দমে মাটির দেবীরে ডেকে,
তারই পায়ে যে খুঁজে পায় এইটুকু প্রাণের রসদ
তাকে, সেই ভক্তের হৃদয়েরে হেতুহীন বাণে
বিদ্ধ করার তবু তুমি রাখো আস্পর্ধা?
সুবর্ণ দুপুরের মায়া মাড়িয়ে,
ফালা ফালা করে নিরীহ পূজারীর জগত-সংসার
যে গায়েবী লানৎ আজ নেমে এলো সূত্রহীন
বলো হে বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী ও জগতের আইন
কোন কানুনে লেখা আছে তার সূত্র ও সমাধান?
হাসির দিনের কবিতা
মগজের মধ্যে তুমি বসে আছো বিষন্ন শ্রীমুখ
শব্দে শব্দে ডেকে যাচ্ছো একাকী কোকিল।
তীব্র বর্ণময় রোদে কী সুন্দর ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া,
রাধাচূড়া তার পাশে শহরকে হাসায়;
এমন হাসির দিনে রিকশায় তুমি একাকী পাখি
কাকে খোঁজো রোদে ও ফুলে?
বৃন্ত থকে ঝরে পড়া ফুল,
দিগন্ত থেকে ঝরে পড়া রোদ তোমার সঙ্গে ছিল,
মন ভরা প্রশ্ন নিয়ে সঙ্গে ছিল বটে ভাড়াটে রিকশাওয়ালা;
তাই বলে, এমনি দুঃসাহস তোমার রোদের পথে
তুমি ঢুকে যেতে চাও মানুষের হৃদয়ের ভেতর!
নিভৃতে চুপিসারে রয়ে যেতে চাও তাদের প্রেমে!
চন্দ্রহার
কেনো এতো আকুলি বিকুলি তার মন?
কে সে, ছড়িয়ে আছে এই রোদে,
দুপুর কেন খালি কথা বলে উঠে বারবার?
কী কথা কে জানে!
কে জানে সে কী হাহাকার এই বাতাস
এনেছে বয়ে!
ঢেউটিনের চালে এসে
বসেছে কবুতর; উঠানের পূবের গাছে
বেলা বারোটায় ডাকছে কাক;
ঘরে শুধু আনচান,
দেউড়িতে কেউ নেই,
না আছে খরের গাদায় কোনো কাজ।
দুপুর গড়িয়ে যাক,
চিরতরে ঝরে যাক গাছের পাতার মত;
এমন অকারণ রোদন দুপুর ফিরে না
আসুক আর টিনেরচালে, আতা গাছের
পাতায় পাতায়।
এই সে রোদ, কথা বলে চলে গেলে পরে
উঠোন একা কান্না-কান্না হয়ে থাকে;
কে তখন বাড়ির সামনের পথ দিয়ে
তাড়াতাড়ি আড়াআড়ি চলে যেতে গিয়ে
অন্তত দাঁড়াবে খানেক দেউড়ির কোণায়!
ঝিঁঝিঁ পোকারা থামিয়ে দিলে মধ্যাহ্নের গান
বিকেলে বাঁশঝারে ফিরে এলে ডাহুক পাখি
সন্ধ্যায় কুপিবাতি ধরানোর সময়
আবারো এমন রোদন এলে মনে,
কে তাকে গড়িয়ে দেবে
নাই দেশের এক মোহন চন্দ্রহার!