আমরাও পারি

Free 1তামান্না ইসলাম: অনেক দিন আগের ঘটনা…… মনটা বেশ খারাপ হয়ে আছে। আমি একটা টিমে নতুন এসেছি। আমার অধীনে একটি মেয়ে আছে, যে আট বছর ধরে এই একই টিমে আছে। আমি যখন প্রথম এই কোম্পানিতে চাকরি শুরু করি, ও তার কিছুদিন পরেই জয়েন করে। হাসি খুশী তরতাজা একটা অল্পবয়সী মেয়ে। প্রাণ শক্তিতে ভরপুর। মিষ্টি একটি মুখ। দেখলে বাচ্চা মেয়ে বলে ভুল হয়। কিছুদিন পরে মেয়েটির বিয়ে হল। স্বামী অন্য শহরে কাজ করে।

নিজের চাকরির সুবিধা-অসুবিধা উপেক্ষা করে সে স্বামীর সাথে থাকতে শুরু করলো আর ওখান থেকেই চাকরি করত। খুব জরুরি দরকার হলে মাঝে মাঝে আসা যাওয়া করত। একে একে দুটি  সন্তান হলো। মাঝে অনেক দিন আমি এই টিমে ছিলাম না। নতুন করে এসে দেখি, এই কয়েক বছরে ওর শরীর ভেঙ্গেছে। মুখ থেকে কিশোরী লাবণ্য তো উধাওই, বরং মেছতার দাগ। আমার সামনে দাঁড়ানো একটা মাঝবয়সী জীবন যুদ্ধে হাবুডুবু খাওয়া নারী।  বিশ্বাস হয় না মাঝে মাত্র আটটি বছরের ব্যাবধান।

এতো গেল চেহারা, শরীর, হয়তো তেমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না। কিন্তু যেটা আমাকে সবচেয়ে কষ্ট দিয়েছে, মেয়েটা কাজে কর্মে তেমন উন্নতি করতে পারেনি। প্রায় যেখানে ছিল শুরু থেকে, সেখানেই থেমে আছে। ওর সঙ্গের ছেলেরা, এমন কি অবিবাহিত মেয়েরাও এগিয়ে গেছে বহুদূর। আমি মেনে নিতে পারি না, ওর ক্ষমতা আছে, শুধুমাত্র সুযোগের অভাব।

ওর সাথে কথা বললাম। “তুমি তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ভাবছ?” ” উন্নতি করতে চাও না?”

আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে সে বলল ” আমার বাচ্চা দুইটা খুব ছোট।  এখন বেশী দায়িত্ব নিতে পারবো না।” “ওরা যখন বড় হবে তখন চিন্তা করবো।”

আমি কি বলবো? এটা তো আমার জীবনের চিত্র, আমার আশে পাশের হাজার হাজার মেয়ের জীবনের গল্প, সে হোক  বাঙ্গালী, চাইনিজ বা আমেরিকান। একটা জেদ চেপে গেলো, “আর কতো দিন আমরা এভাবে মার খাব?”

ওকে বোঝাতে শুরু করলাম। “তোমার বস এটা বুঝবে, এমনকি আমি তোমার  বসের বস ও  হয়তো বুঝব ।” “কিন্তু কোম্পানি বুঝবে না।” “বছরের পর বছর একই জায়গায় থেমে থাকলে প্রশ্ন উঠবেই তোমার যোগ্যতা নিয়ে। “

এইবার মেয়েটির কণ্ঠে বিষণ্ণতা “আমি বুঝতে পারছি।”

আমি ওকে বললাম। “আমি তোমাকে সুযোগ দিতে চাই।” “তোমাকে আরেকটু বেশি দায়িত্ব দিবো, আমি নিজে তোমাকে কাজ শিখাবো। এক বছরে না হলেও আস দেখি দুই বছরে কিছুটা আগানো যায় কিনা। ” তারপরে ওকে আরও কিছু টিপস দিলাম।

এইবার সে কিছুটা সাহস পেল। “আমি আরেক্টু  চিন্তা করে তোমাকে জানাই, আমার কাছে আইডিয়াটা ভাল মনে হচ্ছে।”

“তোমার  বাচ্চাদের বয়স কতো? “

“তিন আর পাঁচ।”

এই বার ওকে আমি আরও সাহস দিলাম “আমারও দুইটা বাচ্চা। আমি পেরেছি, তাই আমি জানি তুমিও পারবে।” “তুমি তোমার স্বামীর সাথে কথা বলো, তাকে বাসার কাজে দায়িত্ব নিতে হবে।” “তোমার নিজের মনকেও প্রস্তুত করো, আরও বেশী কাজ করতে হবে, প্ল্যানিং আর অর্গানাইজেশন দুটোই খুব জরুরি।”

ও চিন্তা করে জানাবে বলে ফোন রাখল। আমি বসে বসে ভাবছি, আর কতো দিন, আর কতো মেয়ের জীবনে আমি একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি দেখব? আমার মা থেকে শুরু করে, আমি নিজে, বান্ধবী, সহকর্মী, আমার মেয়ে, তার মেয়ে …?  কবে শেষ?

আপনার অধীনের মেয়েটিকে সুযোগ দিন এগিয়ে যেতে, নিজেকে প্রমাণ করতে, আপনার চারপাশের মেয়েদেরকে সাহস দিন। উপযুক্ত সুযোগ পেলে আমরাও পারি।

শেয়ার করুন: