পতাকা আর জায়নামায কি এক?

সুপ্রীতি ধর:

জাতীয় পতাকার একপাশে জুতা রাখা আছে, জুতাটা লেগে আছে পতাকার শরীরে, আর সেই পতাকার ওপর দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন একজন, এমনই একটি ছবি ভাইরাল হয়ে ঘুরছে অনলাইনে। তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে এর পক্ষে-বিপক্ষে। তবে যারা পতাকার সম্মান রক্ষার্থে এই ঘটনার বিরোধিতা করছেন, তাদের সংখ্যার চেয়ে ধার্মিক মুসলমানের সংখ্যাই বেশি, যারা পতাকা আর জায়নামাযের পবিত্রতা এক করে এই ঘটনার যৌক্তিকতা বর্ণনা করছেন।

আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন পান থেকে চুন খসলেই, যারা দেশপ্রেমে গদগদ হতেও সময় নেন না, সেই তারাও এখন মুখে কুলুপ এঁটেছেন। কারণ ওই লোকটি পতাকা মাটিতে বিছিয়ে তার ওপর পা রেখে নামাজ আদায় করছেন। এতে করে কোনো অন্যায় তারা দেখছেন না, পতাকা আর জায়নামায দুটোই পবিত্র। তাহলে আমার এই দেশের পতাকা কি ইসলামের পতাকা? মুসলমানরা চাইলেই এটিকে জায়নামায বানিয়ে যেখানে-সেখানে বিছিয়ে নামাজ পড়ে ফেলতে পারবেন? ধিক, এই ধর্মান্ধ জাতিকে, ধিক এই চেতনাধারীদের।

কিন্তু জায়নামায মাটিতে বিছিয়েই নামাজ পড়তে হয়, অন্যদিকে পতাকাকে যে মাটিতে নামানো যায় না, এর ওপর পা রাখা যায় না, সেই কথা এসব ধর্মান্ধ মুসলমানদের কে বোঝাবে? কার ঘাড়ে কয়টা মাথা? বললেই তো ধর ধর করে তেড়ে আসবে, জাতীয়তাবাদ শিখিয়ে দেবে আপাদমস্তক।  

পতাকা এবং জায়নামায দুটোই পবিত্র। কিন্তু দুটো ভিন্ন জাতের পবিত্রতা। একটির সাথে ধর্ম জড়িত, অপরটির সাথে একটা দেশ, একটা দেশের সার্বভৌমত্ব, সম্মান। পতাকা উপরে তুলে ধরতে হয় একটা জাতির, আর জায়নামায তুলে ধরার কিছু নেই।

তুলনা হিসেবে তারা যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে পতাকার রং দিয়ে বিকিনি, জুতা, মোজার ছবিও শেয়ার করছে। আরে আহাম্মকের দল, পতাকা আর পতাকার রং ব্যবহার তো এক না। পতাকা হয় একটা নির্দ্দিষ্ট রং আর সাইজ অনুসারে বানানোর পর, তখন এটি একটি দেশের প্রতীক হয়ে উঠে, লাল-সবুজ কাপড়ের টুকরা মাত্রই ‘পতাকা’ নয়। আমরা মেয়েরা তো লাল-সবুজ রং মিলিয়ে শাড়ি-জামা পরি ২৬শে মার্চ বা ১৬ই ডিসেম্বরে, সেগুলো নিশ্চয়ই পতাকা নয়। যখন আমি একটা লাল-সবুজ টুকরাকেও পতাকার মর্যাদা দেবো, মাথায় বাঁধবো, গলায় ঝুলাবো, সেটির মর্যাদা আমাকে রাখতেই হবে।

দেশের সংবিধান অনুযায়ীও পতাকা ব্যবহারের কিছু নিয়ম-কানুন আছে। সেগুলো জেনে তারপর তর্ক করতে আসাই শ্রেয়। স্বাধীনতা আর ধর্মকে গুলিয়ে ফেলা উচিত না কারও। যার যার ধর্ম তার তার কাছে, কিন্তু পতাকা সবার। নিচে বিধিমালাগুলো তুলে দিলাম, পড়ে দেখুন আর পতাকার মর্যাদা নিয়ে তর্ক করার আগে নিজের ‘ধর্মান্ধ’ অনুভূতিকে দূরে রেখে আসুন।  

জাতীয় পতাকা বিধিমালা-১৯৭২ (সংশোধিত ২০১০)- এ জাতীয় পতাকা ব্যবহারের বিধি-বিধান অনুযায়ী:

(১) সর্বদা পতাকার প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করিতে হইবে।
(২) পতাকা দ্বারা মোটরযান, রেলগাড়ি অথবা নৌযানের খোল, সম্মুখভাগ অথবা পশ্চাদ্ভাগ কোন অবস্থাতেই আচ্ছাদিত করা যাইবে না।

(১৪) কবরস্থানে ‘জাতীয় পতাকা’ নিচু করা যাইবে না বা ভূমি স্পর্শ করান যাইবে না।
(১৫) ‘পতাকা’ কোন ব্যক্তি বা জড় বস্ত্তর দিকে নিম্নমুখী করা যাইবে না।
(১৬) ‘পতাকা’ কখনই উহার নিচের কোন বস্ত্ত যেমন: মেঝে, পানি বা পণ্যদ্রব্য স্পর্শ করিবে না।
(১৭) ‘পতাকা’ কখনই আনুভূমিকভাবে বা সমতলে বহন করা যাইবে না, সর্বদাই। ঊর্ধ্বে এবং মুক্তভাবে থাকিবে।
(১৮) ‘বাংলাদেশের পতাকা’ কোন কিছুর আচ্ছাদন হিসাবে ব্যবহার করা যাইবে না, তবে শর্ত থাকে যে, কোন বিশিষ্ট ব্যক্তি যাঁহাকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদা বা পূর্ণ আনুষ্ঠানিকতাসহ সমাধিস্থ করা হয়, তাঁহার শবযানে পতাকা আচ্ছাদনের অনুমোদন প্রদান করা যাইতে পারে।
(১৯) ‘পতাকা’ এমনভাবে উত্তোলন, প্রদর্শন, ব্যবহার বা সংরক্ষণ করা যাইবে না, যাহাতে উহা সহজেই ছিঁড়িয়া যাইতে পারে বা যে কোনভাবে ময়লা বা নষ্ট হইতে পারে।
(২০) কোন কিছু গ্রহণ, ধারণ, বহন বা বিলি করিবার নিমিত্ত ‘পতাকা’ ব্যবহার করা যাইবে না।
(২১) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আরোপিত কোন শর্তাবলী (যদি থাকে)এবং লিখিত অনুমোদন ব্যতীত, কোন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্বোধন, পেশা বা অন্য যে কোন উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের ‘পতাকা’ কোন ট্রেড মার্ক, ডিজাইন, শিরোনাম অথবা কোন প্যাটেন্ট হিসাবে ব্যবহার করা যাইবে না।
(২২) যেক্ষেত্রে ‘পতাকা’র অবস্থা এমন হয় যে, উহা আর ব্যবহার করা না যায়, সেক্ষেত্রে উহা মর্যাদা পূর্ণভাবে, বিশেষ করিয়া সমাধিস্থ করিয়া, নিষ্পত্তি করিতে হইবে।
(২৩) ‘পতাকা’ দ্রুততার সহিত উত্তোলন করিতে হইবে এবং সসম্মানে নামাইতে হইবে।

আরো উল্লেখ করা হয়েছে, যেক্ষেত্রে ‘পতাকা’র অবস্থা এমন হয় যে, তা আর ব্যবহার করা না যায়, সেক্ষেত্রে তা মর্যাদাপূর্ণভাবে, বিশেষ করে সমাধিস্থ করে নিষ্পত্তি করতে হবে। 

10409014_10204450092399364_7363089978882691603_n
যে ছবিটা নিয়ে এতো বিতর্ক

একজনের লেখা থেকে উদ্ধৃত: ‘দীর্ঘদিনের বহু ত্যাগ আর শত সংগ্রামের পটভূমির মধ্যে দিয়ে অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে শুরু করে স্বশস্ত্র মুক্তিযুদ্বের মাধ্যমে লাখ প্রাণের বিনিময়ে  ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর জন্ম হয়েছিল এই দেশটির। রাষ্ট্রের পরিচয় তথা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে পেয়েছিল একটি জাতীয় পতাকা। সেই পতাকার ছায়াতলে সাত কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ  তিয়াল্লিশ বছরে এখন প্রায় পনেরো  কোটি। যেটিকে নিজ দেশের পরিচয় হিসেবে গৌরবের ব্যবহার করে আসছে জনগণ। সবার উচিত তথা কর্তব্য হলো এর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সম্মান, মর্যাদা প্রদর্শন করা। কিন্তু প্রায় সময়ে দেখা যায় এই জাতীয় পতাকার প্রতি  সম্মান, মর্যাদা প্রদর্শন করতে গিয়ে এর যথাযথ ব্যবহার করা হয় না এবং এই লক্ষে আইন থাকলেও বাস্তবে সেইসব আইনের প্রয়োগ বা ব্যবহার খুবই কম’।

প্রায় সময়ে দেখা যাচ্ছে, কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে যত্রতত্র জাতীয় পতাকার ব্যবহার। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা, সমাবেশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি -বেসরকারি ক্লাব,সমিতি, সংঘ, সংস্থা,সংঘঠন, প্রতিষ্ঠানে  বিভিন্ন কর্মসূচিতে ও নানান আয়োজনে এই জাতীয় পতাকা বিধিমালার লঙ্ঘন ছড়াছড়ি চোখে পরে। বিভিন্নভাবে যেসব পতাকা ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোর আকার, বর্গাকার, দৈর্ঘ্য প্রস্থের, কালার  কোনটাই ঠিক নাই। কখন, কোথায়, কিভাবে, কি কারণে, ব্যবহার করা উচিৎ সে সম্পর্কে  তারা একেবারেই অজ্ঞ। যারা পতাকা বানায় (দর্জি) তারাও মনে হয় জানে না, আইনে পতাকার আকার ও রঙের ব্যাপারে কী বলা হয়েছে!

লাখ লাখ শহীদের রক্তে রাঙানো ওই পতাকায় কেউ আর পা রাখবে না আশা করি। তা তিনি নামাজই পড়ুন, আর যাই করুন। নামাজ খোলা মাঠেও পরা যায়, সেখানে জায়নামায আবশ্যকীয় নয়। কিন্তু পতাকা, পতাকাই, আমার দেশ মানেই পতাকা, পতাকা মানেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া আমার বাবা এবং লাখো শহীদের রক্ত।  

 

শেয়ার করুন: