সারপ্রাইজ – Revisited

Ros Alo 2নাফিসা তানজীম: উপসংহারের আগে——ঘরের ভেতরে নিয়মিত বিরতিতে আর্তনাদ চলছে। আর আমি একটু পর পর চমকে চমকে উঠছি। চিৎকার শুনলে মনে হবে কেউ হয় কারো পেটে চাকু ঢুকিয়ে দিয়েছে। নাহয় কারো শরীরের ওপর দিয়ে ট্রাক চলে গেছে। চিন্তার কিছু নাই। গত মাসেই বাণিজ্যমেলা থেকে এত শখ করে কেনা ৪২ ইঞ্চি টিভিতে এখন ক্রিকেট খেলা চলছে। যে খেলা দেখলে আমার হাই উঠতে থাকে। টিভির রিমোটও আমার কাছে। রিমোটের ব্যাটারিও ঠিক আছে। স্টার প্লাসে আমার প্রিয় “সাথ নিভানা সাথিয়া”ও শুরু হয়ে গেছে। তবু চ্যানেল বদলানোর ক্ষমতা নেই আমার। “সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সব ক্ষমতা দেন না” – কথাটা প্রায়ই শুনি। খুব সত্য কথা। “রিনি, সাউন্ডটা বাড়াওতো” আদেশ শুনে ভলিউম বাড়ালাম। মনে পড়ে গেল কদিন আগের কথা।

কদিন আগে যা ঘটেছিলো:

আমি একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াই। মাত্র মর্নিং শিফটের ছুটি হয়েছে। ডে শিফট শুরু হবে।বিভিন্ন রঙের সুন্দর সুন্দর গাড়িতে করে গার্জিয়ানরা বাচ্চাদের নিতে আসছে। টিচার্স রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঠিক করে ফেললাম রেজওয়ানকে সামনের বছর কোন রঙের গাড়িটা কিনতে বলবো। এমন সময় বেংগলির টিচার তামান্না আপা এসে বললেন,

“কি রিনি আপা, প্রতিদিন দুইবার করে প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করছেন; মন খারাপ নাকি?”

: হুঁ।

: ঈদের বোনাস কি দুলাভাইয়ের ফ্যামিলির ঈদের গিফট কিনতে পুরো খরচ হয়ে যাচ্ছে?

: তার চেয়েও খারাপ অবস্থা। রেজওয়ানের দেশের বাড়িতে, মানে আমার শ্বশুরবাড়িতে ঈদ করতে হবে।

:  ও নো। আপনার অবস্থাতো পুরাই কেরোসিন। বিয়ের পর এবারই প্রথম শ্বশুরবাড়িতে ঈদ করবেন নাকি?

: আরে না। বিয়ের পর দুই বছর ধরেতো দুই ঈদই শ্বশুরবাড়িতে করি। তাই প্রতিবার ঈদের আগে মন খারাপ লাগে। বাবার বাড়িতে ঈদ করার সেই আনন্দতো আর পাই না।

:  শ্বশুরবাড়িতে ঈদ করা আসলেও যন্ত্রণা, আপা! শ্বশুর-শাশুড়ি থেকে শুরু করে দেবর-ননদ-তাদের বাচ্চা-কাচ্চা সবার জন্য জামা-কাপড়তো কিনতে হয়ই, তারপর দুই-একটা ছিঁচকে এসে বলে, “ভাবী, এটা কী দিলেন? আপনি এত খ্যাত কেন?” সারা রাত জেগে রান্না-বান্না কর, ঘর গুছাও। সকালেও সেজে-গুজে বের হওয়ার উপায় নাই। একটু পর পর অপরিচিত আত্মীয়-স্বজন আসবে। তাদের খাওয়াও। রান্নাঘরেই দিন শেষ।

: একদম সরিষার তেলের মত খাঁটি কথা বলেছেন, আপা। ঈদের সময় কোথায় সেজে-গুজে বন্ধু-বান্ধবের সাথে ঘুরবো, তা না। রান্না করো, টেবিল সাজাও, গেস্টকে খাওয়াও। একটু মন খুলে কথা বলার মত কেউ নেই। জামাইতো রান্নাঘরের ধারে-কাছে আসবেনা। মা-বউয়ের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে সে তার আত্মীয়-বন্ধু নিয়ে মাস্তি করে বেড়াবে। আর শাশুড়ির সাথে কথা বলার উপায় আছে, বলেন? উনি একজন জীবন্ত টাইম মেশিন। যেকোন প্রসঙ্গে অতীতে চলে যান। এমনিতে কাল তিন প্রকার হলেও উনার কাছে মনে হয় কাল একটাই – অতীতকাল। “ঘর-সংসার কেমন চলছে? অবশ্য তোমাদের কি আর সংসারের কাজ করতে হয়? সবতো কাজের মানুষের ওপর দিয়ে চালাও। সংসার করতাম আমরা। দশ ভাই-বোনের ফ্যামিলির বড় বউ ছিলাম। সবার জন্য তিনবেলা ফ্রেশ রান্না করতে হতো। তোমাদের মত ফ্রিজে রেখে তিনদিনের বাসি খাবার খাওয়ানোর উপায় ছিলো না।“নতুন একটা আইটেম রান্না করবেন? “এটা কী? বিরিয়ানি মশলা? ফাঁকি মশলা দিয়ে বিরিয়ানি রান্না হয়? বিরিয়ানি রান্না করতাম আমরা। সবগুলো দেবর-ননদের বিয়ের বিরিয়ানি আমি নিজের হাতে রান্না করেছি। কয়লার চুলায় বড় ডেকচি চাপিয়ে দমে দিয়ে কাচ্চি বিরিয়ানি। আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষ সেই বিরিয়ানি চেটে-পুটে খেতো, বুঝলে?” প্যারা! জীবনটা একেবারে প্যারাগ্রাফ মনে হয় তখন!

: শ্বশুরবাড়ি থেকে ঈদের ড্রেস গিফট করে নাই?

: ওরে আপা, সেটাও আরেকটা পেইন। আমাকে টাকা দিলে আমি নিজে পছন্দ-মত কিনে নিতাম। তার কি উপায় আছে? শাশুড়ি সব বউদের ঈদ উপলক্ষে শাড়ি দেয়। শাড়িতো আমি তেমন একটা পরিই না। কিন্তু শাশুড়ির এক কথা। বউ মানুষ ঈদের দিনে শাড়ি না পরলে আত্মীয়রা খারাপ বলবে। ঈদের দিনে শাড়ি পরে গরমের মধ্যে রান্না-বান্না-অতিথি আপ্যায়ন করা লাগবে। চিন্তা করেন অবস্থা! তারও ওপর সেই শাড়ি যদি আমার নিজের পছন্দমত কিনতে দিত। ফ্যাশন হাউজের ডিজাইনারের করা শাড়ি কিনতাম। নাহ, শাশুড়ি নিজে তার পছন্দ অনুযায়ী অদ্ভুত রঙ আর অদ্ভুত সব ডিজাইনের শাড়ি গিফট করে। সেই শাড়ি পরে স্কুলে আসলে কলিগদের সামনে প্রেস্টিজ বলে আর কিছু থাকবে না। নিজের হাতে বউয়ের গিফট না কিনলে আমার শাশুড়ির নাকি মন ভরে না। কী বলব, এসবের জন্যই মন খারাপ। স্কুল থেকে আর এক্সট্রা ছুটিও নেবো না ভাবছি। শ্বশুরবাড়ি থেকে ছুটি নষ্ট করার মানে হয় না।

: ভালো সিদ্ধান্ত। যাচ্ছেন কবে? টিকিট পেয়েছেন?

: আরে আপা, সিনেপ্লেক্সের টিকিটই পাওয়া যায় না, এ তো বাসের টিকিট। কোত্থাও নাই। আপনার দুলাভাইয়ের পরিচিত একজন আছে বাস মালিক সমিতির কী যেন। তাকে বলা হয়েছে। সে বলেছে, “প্লেনের টিকিট ম্যানেজ করে দিতে পারব, বাসেরটা বলতে পারি না।“ তাও ম্যানেজ করে দেবে বলেছে…আরে, বলতে না বলতেই এসএমএস। একটা মিনিট আপা, একটু চেক করে দেখি।

এসএমএসটা পড়েই “ইয়েস” বলে চিৎকার দিলাম আমি। চিৎকার শুনে তামান্না আপা অবাক।

: টিকিট পেয়েছেন?

: রেজওয়ান এসএমএস করেছে। টিকিট পাওয়া যায় নাই।

: তাহলে খুশি কেন?

: খুশি হবো না? টিকিট পাই নাই। যেতে হবে না। এখনতো কেউ আমাকে দোষ দিতে পারবে না কেন ঈদ করতে শ্বশুরবাড়ি যাই নাই। টিকিট পাওয়া যায় নাই। আমার কিছু করার নাই। দাঁড়ান, এক্সট্রা আরো সাতদিন ছুটি নেবো। বান্ধবীদের আথে ঘুরবো। ঈদের পরে সব শপিং মলে ডিসকাউন্ট দেয়। ডিসকাউন্টে শপিং করবো। ঘরে বসে আরাম করে হিন্দি সিরিয়াল দেখবো। রিসেন্ট বের হওয়া বলিউডের সিনেমাগুলো দেখা হয় নাই। সবকয়টা দেখে শেষ করবো। কী যে ভালো লাগছে, তামান্না আপা!

ছুটির দরখাস্ত দিতে দেরি হলো না একটুও। “খুব কষ্ট পেয়েছি, আসার অনেক ইচ্ছা ছিল!” – এমন ভাব করে শ্বশুর-শাশুড়িকে জানালাম। সবাই খুব মন খারাপ করলো। স্বাভাবিক। আমি যখন বাবার বাড়িতে ঈদ করতে পারি না, তখন আমারও খুব মন খারাপ হয়। তবে ছুটির কথা কাউকে বললাম না। ছুটিটা পেলে সারপ্রাইজ দেবো রেজওয়ানকে। ভাব করবো – আহা! ঈদে বাবা-মাকে পেলে না তো কী হয়েছে? বউ তো তোমার কাছে আছে।

আজকে অফিসে এসে শুনি, ছুটি পেয়ে এছি। রেজওয়ানের ফোন পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “সারপ্রাইজ আছে একটা।“ রেজওয়ান বলল, সেও সারপ্রাইজ দেবে। মনটাই ভালো হয়ে গেল। অনেকদিন পর ছুটি পেলাম। বিয়ের পর প্রথমবারের মত একদম নিজের মত করে ঈদ করতে পারবো। বাসায় ঢুকে কাব্যিক সুরে বললাম, “সাত দিনের ছুটি পেয়েছি, রেজওয়ান! সারপ্রাইজ!”

সঙ্গে সঙ্গে দরজার আড়াল থেকে “ভউ” করে চিৎকার করে উঠলো আমার ছোট ননদ। চমকে তিন হাত পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। “সারপ্রাইজ!” ননদের সাথে দেখি পিচ্চি দেবরও এসেছে! “রিনি। কেমন আছ মা?” সেকি! এ তো আমার শাশুড়ির গলা। ওইতো, পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলছেন, “যেতে পারছো না দেখে এতো মন খারাপ করলে, খারাপ লাগলো। চলে এলাম। সবাই ঈদে ঢাকা ছাড়ে, আমরা না হয় ঢাকায় এলাম। এটা অবশ্য তোমার শ্বশুরের বুদ্ধি। অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক।“

রেজওয়ান খুশি খুশি গলায় গদগদ হয়ে বলল, “চমকে গেলে তো? খুশি হয়েছো না?”

: হ্যাঁ, খুব খুশি হয়েছি। নতুন টিভি কেনার সময়েও আমার এত আনন্দ লাগে নাই।

ননদ বলল, “ভাবী, সাত দিন ছুটি পেয়েছো, আমাদের কিন্তু ফ্যান্টাসি কিংডম, ফিউচার পার্ক সব ঘুরতে নিয়ে যাবে।“

:অবশ্যই। তোমাদের তো পাসপোর্ট নাই। থাকলে ডিজনিল্যান্ডেও ঘুরিয়ে আনতাম।“

শাশুড়ি আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “আমি কয়েকদিন আগে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলেছি। তোমাকেও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। অ্যাক্সেপ্ট কোরো। আসলে শাশুড়ি-বউয়ের সম্পর্কটা তো খুব ফ্রেন্ডলি হওয়া উচিত, কী বলো?”

: জ্বি।

: কাল ভোর থেকে চলো আমরা দুই বন্ধু মিলে তাহলে ঈদের রান্নার প্রিপারেশান শুরু করি। এবার তোমার শ্বশুর নিজ হাতে বাজার করবে বলেছে। সে দুর্দান্ত বাজার করতে পারে। সবকিছু বেছে বেছে ফ্রেশ ফ্রেশ নিয়ে আসবে।

: জ্বি জ্বি।

তারপর আর কী। ভোর থেকে রান্নার কাজ কিছুটা এগিয়ে রেখে এখন শ্বশুর-জামাইয়ের সাথে “সাথ নিভানা সাথিয়া” বাদ দিয়ে বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট খেলা দেখছি। শ্বশুর আমাকে বাংলাদেশ আর সাউথ আফ্রিকার ব্যাটিং লাইন আপের প্রত্যেকের হিস্ট্রি এক সিটিং-এ বোঝানোর চেষ্টা করছেন, “শোনো, এই যে মুস্তাফিজ আর সৌম্য সরকারের মত আর কয়েকটা প্লেয়ার পেলে আমরা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান হয়ে যাবো।“

: ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান হলে কী হবে? বাংলাদেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?

: ওহ! তোমার মাথায় খেলার মাহাত্ম্য ঢুকবে না। সাউন্ডটা বাড়াওতো একটু। ধারাভাষ্য শুনতেই পাচ্ছি না ঠিকমতো।

: আমি সাউন্ড বাড়াই আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি।

শেষ কথাঃ

গল্পটা কেমন লাগলো? এটাকে কি হাসির গল্প মনে হয়েছে? হিউমার খুঁজে পাচ্ছেন? নাকি অফেন্ডড ফিল করছেন?

হয়তো মনে হয়েছে, আজকালকার মেয়েদের এই অবস্থা কেন? এইসব ন্যাকামি নিয়ে গল্প লেখার কী আছে? শ্বশুরবাড়িকে এত নেতিবাচকভাবে দেখার কী আছে? মেয়েদের আসল ঠিকানা তো ওটাই।

আপনার এসব মনে হতেই পারে। আপনার যদি এই কথাগুলো মনে হয়ে থাকে, তাহলে এই মন্তব্যটি আপনার জন্যই।

মজার ব্যাপার হলো – এটা আমার লেখা কোন গল্প না। দেশের অন্যতম বহুল প্রচলিত দৈনিক প্রথম আলোর “রস+আলো”তে “সারপ্রাইজ” নামে প্রায় একই রকম একটি গল্প ছাপা হয়েছে। এই লিংকে গেলেই গল্পটি পড়তে পারবেন – http://www.prothom-alo.com/roshalo/article/576631/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%9C । “সারপ্রাইজ” গল্পে শুধু ছেলের জায়গায় একটি মেয়ে চরিত্র আর মেয়ের জায়গায় একটি ছেলে চরিত্র বসিয়ে দিলে ঘটনাপ্রবাহ অনেকটা এরকমই দেখায়।

প্রথম আলোর “রস + আলো”তে প্রকাশিত “সারপ্রাইজ” গল্পটি পড়ে হয়তো আপনার হাসি পেয়েছে। পেতেই পারে। সেটি একটি ফান ম্যাগাজিন। তাহলে একটি ফান ম্যাগাজিনের একটি “ফানি” গল্পে শুধু ছেলে-মেয়ের চরিত্রগুলোর অবস্থান বিপরীত হয়ে যাওয়ার কারণে কেন আর গল্পটা পড়ে আগের মত হাসি পাচ্ছে না? প্রশ্ন করুন নিজেকে।

Nafisa Tanjeem
PhD Candidate and Graduate Instructor
Department of Women’s and Gender Studies
Rutgers – The State University of New Jersey
New Brunswick, New Jersey, USA
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.