রওশন আরা নীপা: সেই আদিকাল থেকে বাঙালীর একটা বৈশিষ্ট্য যা এক ধরনের বদনাম হিসেবেই পরিচিত ছিল। বাঙালীকে দিয়ে যুদ্ধ হয় না, বাঙালী রাগতে জানে না, বাঙালী জানে ভাত খেতে, দারিদ্র্য নিয়ে, দুঃখ বিলাসিতা করা প্রেম পীড়িতির মিছে আবেগ নিয়ে গান কবিতায় মেতে থাকতে শুধু।
বাঙালী মানেই বাউল, আলসে ঘরহীন বিবাগী। কালে কালে নদীর জল শুকিয়েছে, একদা নদীর জলের সাথে বেড়ে ওঠা যে বাঙালী নদীর স্রোতের সাথে ভাটিয়ালী সুরের সাথে বেড়ে উঠতো, উদ্দাম বরষার জলে কৈশোরের দুরন্তপনায় মাততো, বড় জোর শীতের সময়ে নদীর বুকে জেগে ওঠা চর দখলের জন্য পেটের দায়ে ভূস্বামীর জন্য লেঠেল হয়ে অন্য পক্ষকে ঘায়েল করতো। মাঝে মাঝে দু একজন এতে মারাও যেত। কিন্তু সেখানে দু পক্ষই যুদ্ধংদেহি।
এছাড়া পুরোটা বছর জুড়েই থাকতো, গান কবিতায় মজে থাকা উৎসবের রঙে বাঙালী। পাড়ায় পাড়ায় কবি গান, বাউলের আসর, বরষায় নৌকা বাইচ, সাথে ভাটিয়ালী, জারি-সারি, গাজী গান, পট গান, পুতুল নাচ, যাত্রার আসর , চড়ক মেলা। বারো মাসে তের পার্বনের একমাত্র দেশই তো এই বাংলাদেশ।
এখানে পাড়ায় পাড়ায় বিবাদ যে থাকতো না, তা নয়। বড়রা ছোটদের শাসন করতেন, বাবা-মা, চাচা-চাচী, আত্মীয়-স্বজন, মুরুব্বিরা ছোটদের বেয়াদব দেখলে চড়, থাপ্পর দিতেন, কিন্তু কোন শিশুকে মারতে মারতে মেরে ফেলা একথা বোধহয় স্বপ্নেও কেউ চিন্তা করতো না। পাড়ার ছোটদের দেখেশুনে রাখার অঘোষিত দায়িত্ব যেন ছিল বড়দের। আর ছোটরাও সেসব মেনেই নিতো। নিজের বাবা-চাচা ছাড়াও, পাড়ার খুড়তুতো চাচা বা দাদার ভয়ে ছোটরাও সবসময় তটস্থ থাকতো, বেয়াদবি দূরের কথা, কোনো অন্যায়ই করতে পারতো না। সেসময় মেয়েরা অনেক বেশি নিরাপদ ছিল। নিজ পাড়ার ছেলেরাই ছিল তাদের দেখভালকারী।
আর এখন? সময় কতোটাই পাল্টে গেছে। তুচ্ছ কথায় খুন, মতের মিল না হলে চাপাতির কোপে কল্লা আলাদা করা, ধর্ষণ এসব এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়।
চণ্ডিদাস আর রজকিনীর প্রেম উপাখ্যানের দিন শেষ হয়ে এখন খুনখারাবির আমল চলছে। এখন পাখির কলতানের বদলে মানুষের ঘুম ভাঙ্গে ঘড়ির এলার্মে। পাখিরাও নিরাপত্তার কারণে সব মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে গেছে। প্রকৃতির মানুষ বদলে গেছে যান্ত্রিকে। মনের আবেগ, অনুভুতি এসবের বদলে ঠাঁই করে নিয়েছে ভোগ, বিলাস আর পৈশাচিকতা! আর তাইতো ছোট্ট শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করার সময় একটি মানুষও এগিয়ে আসে না তাকে বাঁচাতে, কেবল হত্যা করাই নয়, সেই দৃশ্য আবার ভিডিও করে সবাইকে বিশদভাবে দেখানোতে আমাদের আনন্দ বাড়ে।
কিন্তু একবারও কি কেউ ভেবেছেন কেন এই বীভৎসতা? কেন আমাদের মন আর সুরের মায়ায় কাঁদে না্, কারো দু:খে ভারাক্রান্ত হয় না! কেন আমরা যাকাতের নামে নিজের খ্যাতি প্রচারের জন্য অনায়াসে পায়ের নিচে পিষ্ট করে মেরে ফেলি অর্ধশতক মানুষকে?
কেন আমরা আমাদের অন্তরের ক্ষুদ্র অনুভূতিগুলোকে পিষে মেরে ফেলছি?? কোনো আইন বা শাস্তি কি এর পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে পারবে? যদি না আমরা আমাদের অন্তরটাকে জাগ্রত করি, গানে কবিতায় ফিরে না যাই, প্রকৃতির রূপে পাগল না হই।
অনেকেই হয়তো বলবেন, কই, এখন তো আরও বেশি করে গানের চর্চা হয়, মেলা হয়, সংস্কৃতি চর্চা হয়। মানছি হয়, কিন্তু একটু ভিতরে তাকালেই বোঝা যায়, এগুলো সবই কর্পোরেট কালচারের বাতাবরণে হচ্ছে, যেখানে মানবিক চাহিদা বা মন খুলে, প্রাণের টানে যে চর্চা আগে হতো, তা উধাও। এখন টাকা কথা বলছে। এখনও রাত জেগে মানুষ গান শোনে, আর আগেও গ্রামে গ্রামে এসবের আয়োজন ছিল। কিন্তু দুটোতে আকাশ-পাতাল তফাত। এখন চর্চার নামে হয় শো-অফ, আর আগে মানুষ শুধুমাত্র মনের ক্ষিদে মেটাতেও শামিল হতো এসব উৎসবে।
তাই যারা প্রতিবাদ স্বরূপ আজ কবিতা থেকে দূরে থাকতে চাইছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ, আসুন এক রাজনের মৃত্যু থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও অগণিত রাজনকে বাঁচাতে কবিতার চর্চা করি, গানের সুরে মাতি, নদীর সাথে কথা বলি, বরষায় ভিজি, অন্তরের অন্তর থেকে ভালোবাসার চর্চা করি। ছড়িয়ে দেই প্রাণটাকে, খুলে দেই মনের আগল, ভালবাসি একে-অপরকে, হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাই সুন্দর-স্বপ্নীল এক জীবনের পথে। তাহলে আর কোনো রাজনই এভাবে মরবে না, এ আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।
আসুন সরকারি, রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তিগত যেভাবেই হোক, আবার বাংলাকে জাগিয়ে তুলি নতুন প্রজন্মকে বাঁচাতেই।
লেখক পরিচিতি: চলচ্চিত্রকার ও অ্যাক্টিভিস্ট