সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার খাসরাজবাড়ি ইউনিয়নের বিলধলী গ্রামে আমি বাস করি। আমার নাম আনোয়ারা খাতুন। বয়স ৪৩ বছর। আমার স্বামী মৃত হোসেন আলী। দুই মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে আমার সংসার।
আজ থেকে প্রায় ২৭ বছর আগে আমার বিয়ে হয় পাশের গ্রামের হোসেন আলীর সঙ্গে। হোসেন আলী স্বভাবে খুব আড্ডাবাজ আর অলস প্রকৃতির লোক ছিল। সংসার নিয়ে আমার স্বামী হোসেন আলীর তেমন কোন চিন্তা ভাবনা ছিল না। ইচ্ছে হলে মানুষের জমিতে কামলা দিয়ে আয়-রোজগার করত নয়তো কিছুই করত না। আমার সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকতো। বসত-ভিটা ছাড়া কোন আবাদী জমি ছিলনা আমার স্বামীর। সংসারের দুরবস্থা দেখে আমি এর হাল ধরি। বাড়ির আশেপাশের প্রতি ইঞ্চি জায়গা কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে লাউ, কুমড়া, সীম, করলা, পুঁইশাক ইত্যাদির আবাদ শুরু করি। কিন্তু বাড়ি থেকে বাজার দূরে হওয়ায় আমার উৎপাদিত সবজি সরাসরি বাজারে নিয়ে বিক্রি করার কোন উপায় ছিল না। এজন্য প্রতিবেশীদের কাছে সবজি বিক্রয় করা শুরু করি। কিন্তু সবজির প্রকৃত মূল্য পেতাম না। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে পাড়া প্রতিবেশীর কাছে বাড়তি সব্জি কম দামে বিক্রি করে পয়সা জমিয়ে তা দিয়ে মুরগীর বাচ্চা কিনে পালন করা শুরু করি। একসময় শাক সবজির বীজ, চারা সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়, সেইসময় শাক-সব্জির বীজ প্রথমে পাড়া প্রতিবেশীর কাছ থেকে সংগ্রহ করে আবাদ শুরু করি। তবে পরবর্তীতে নিজের রাখা বীজ দিয়েই চাষাবাদ করতে থাকি। বিভিন্ন ধরণের গৃহস্থালীর আবর্জনা, মুরগীর বিষ্ঠা, গোবর সংগ্রহ করে তা পচিয়ে নিজেই জৈব সার বানাই আর তা দিয়ে বছরব্যাপি বিভিন্ন ধরণের শাক-সব্জি ফলাই। শাক-সব্জি আবাদে আমার এ সফলতা দেখে পাড়ার অনেক নারীই আমার কাছ থেকে বুদ্ধি পরামর্শ, বীজ ইত্যাদি নিয়ে যায় এবং তারাও আবাদ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। তরিতরকারী ফলাতে শুরু করে। এরমধ্যে এক পর্যায়ে ৭-৮ বছরে ৪ সন্তানের মা হই আমি।
ছোট বাচ্চা নিয়ে আগের মত কাজ করতে পারতাম না, আর যে আয় হয় তা দিয়ে পরিবারের লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সংসারও চলত না। উপায়ান্তর না দেখে বাচ্চাদের মুখে দু-বেলা দু-মুঠো খাবার তুলে দেবার আশায়, কৃষি শ্রমিক হিসেবে যোগ দিলাম। জমি নিড়ানী, মরিচ তোলা, বাদাম তোলা, জমি তৈরি ইত্যাদি যখন যে কাজ পেতাম, তাই করতাম। কোন কাজে ক্লান্তি ছিল না আমার। কিন্তু নারী কৃষি শ্রমিক হওয়ার কারণে পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় সবসময় মজুরি কম পেতাম। সব সময় কাজও পেতাম না। সরকারি ৪০ দিনের কর্মসূচিতেও নাম লেখালাম। এভাবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রাত দিন পরিশ্রম করে যা পাই তা দিয়ে কোন রকমে চলছিল আমার সংসার। একদিন নদীভাঙ্গনের কবলে পড়ে বসত-ভিটাও নদীগর্ভে চলে যায়। মাথাগোঁজার শেষ সম্বলটুকুও হারিয়ে পাশের গ্রাম ছিন্নার চরে অন্যের জমিতে ঘর বেধে বাস করতে থাকি। এই অবস্থায় সাত থেকে আট বছর কেটে যায়। এরপর একদিন হঠাৎ করে আমার স্বামী মারা যায়। আমার বড় মেয়েটা দেখতে একটু কালো বলে কেউ তাকে বিয়ে করতে চাইছিল না। তখন মেয়েটা মনে কষ্ট নিয়ে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে ভর্তি হয়।
শাক-সব্জি আবাদের সফলতা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমি ধীরে ধীরে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জমি বর্গা নিয়ে তাতে মরিচ, ভুট্টা, ধান, গম ইত্যাদির আবাদ শুরু করলাম আর তাতে সফলও হলাম। প্রচলিত চাষাবাদের কৌশল, বীজ বপন/চারা রোপন, সার প্রয়োগ, ফসল সংগ্রহ, মাড়াই এবং বীজ সংরক্ষণ সব কিছুই আমার রপ্ত হয়ে গেছে এরমধ্যে। সমাজে একজন সফল কৃষক হিসাবে এখন আমার পরিচিতিও আছে। টাকা পয়সা, বন্যায় চাষ করা যায় এমন বীজ, উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি বিষয়ে সহযোগিতা পেলে আমি অনেক বেশি ফসল ফলাতে পারতাম বলে মনে হয় আমার। একজন নারী হয়ে পরিবারের সদস্যদের দেখাশুনার পাশাপাশি কৃষিকাজ করে সংসার চালানোর এক উদাহরণ হতে পারি আমি। সবার কাছে আমার প্রশ,œ কেউ তো আমাদের খোঁজ রাখেনা, মূল্য দেয় না তবুও জীবনের তাগিদে কাজ করি, করছি এবং করে যাব।