আমার নাম নাসিমা বেগম । বয়স ৩৭ বছর । আমি বরগুনা সদর উপজেলার বুড়ির চর ইউনিয়নের সোনাতলা গ্রামে বাস করি । অল্প বয়সে আমার বিয়ে হয়ে যায় রিকশা চালক আ: জলিল মৃধা (৪২) এর সাথে। খালের চরের ৫ শতাংশ জমি যার একমাত্র সম্বল। এই জমিতে একটি ঘর তৈরি করে আমরা বসবাস করা শুরু করি। বিয়ের পর আমাদের ঘরে আসে একে একে চার কন্যা সন্তান। আমার রিকশা চালক স্বামীর পক্ষে চার সন্তানের লেখাপড়া এবং পরিবারের খরচ বহন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং আমরা অনেক ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ি। বাড়ি ছেড়ে তখন অন্য কোথাও কাজের সন্ধানে যাওয়ার চিন্তা করতে থাকি। কিন্তু তখন আমাকে কেউ কোন কাজ দিচ্ছিল না, কাজ পাওয়ার জন্য আমি মানুষের কাছে প্রতিনিয়ত ধর্ণা দিতে থাকি। কিন্তু কোথা কোন কাজ পাই নি। কাজ না পাওয়ায়, কিছু টাকা আয়ের উদ্দেশ্যে ২০১০ সালে সবজি চাষ করতে আগ্রহী হই আমি। কিন্তু টাকা ও জমির অভাবে সবজি চাষ শুরু করতে পারি নাই । জমি বর্গা নেওয়ার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকি কিন্তু কোনভাবেই টাকা কিংবা জমির ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না। তখন লোকমুখে জানতে পারি, বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাক থেকে ঋণ পাওয়া যায়। তখন আমি ব্র্যাক এর সাথে যোগাযোগ করি। কিন্তু সেখানে আমার পরিচিত কেউ না থাকায় এবং নারী কৃষক হওয়ার কারণে ঋণ পাওয়া সহজ ছিল না। দীর্ঘদিন যোগাযোগের পর ২০১১ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের কাছ থেকে ১৫,০০০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহন করি। এই টাকা দিয়ে ১০ শতাংশ জমি লিজ নিয়ে সবজি চাষ শুরু করি। আমার সবজি ক্ষেতে লাল শাক , পুঁই শাক, লাউ, শিম, মিষ্টি কুমড়া, করলা, ঢেঁড়শসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করি। ব্র্যাকের সহায়তায় সবজি চাষ, মাছ চাষ ও হাসঁ মুরগী পালন বিষয়ে ৩ দিনের প্রশিক্ষণ পাই। প্রশিক্ষণ পেয়ে সবজি চাষ করার জন্য জমি কুপিয়ে জৈব সার দিয়ে রেখে দেই। এর কয়েকদিন পর পুনঃরায় জমি কুপিয়ে বীজ রোপণ করি।
আমি আমার সবজি ক্ষেতে জমি চাষ, বীজ রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, মাচা তৈরি, সার প্রয়োগ, পানি সেচ থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ করি এবং এর পাশাপাশি হাসঁ পালন করি। খালের চরে বাড়ি হওয়ার কারণে হাসঁ পালন করে আমি বেশ লাভবান হই। দৈনিক কমপক্ষে ৬ থেকে ৭ ঘন্টা সবজি চাষের জন্য এবং ৪ থেকে ৫ ঘন্টা হাসঁ পালন ও গৃহস্থলির কাজে ব্যয় করতে থাকি। কৃষি ক্ষেত্রে কোন সমস্যা দেখা দিলে আমি ফোনে অথবা সরাসরি কৃষি অফিসের সাথে যোগাযোগ করে তার সমাধান করি। যার জন্য আমি সবজি চাষে বেশ লাভবান হয়েছি। আমার স্বামী রিকশা চালিয়ে যা আয় করেছেন তা দিয়ে ঋণের কিস্তির টাকা শোধ করেছি।
স্বামীর উপর্জিত অর্থ ও নিজের উৎপাদিত সবজি বিক্রি করে সংসারের খরচের পাশাপাশি মেয়েদেরকে লেখাপড়াও করাতে থাকি। আমার মেজ মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে, সেজ মেয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে এবং ছোট মেয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। বড় মেয়েকে ২০,০০০ হাজার টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়েছি। সবজি চাষ করার জন্য ৩০ শতাংশ জমি ৫ বছরের জন্য লিজ নিয়েছি। যাতে এখন সবজি ও মাছ চাষ করছি। স্বামীর জন্য একটি ভ্যান গাড়ি ক্রয় করে দিয়েছি যা দিয়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় মালামাল বহন করেন। উৎপাদিত সবজি বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন। এই ভ্যান গাড়ি দিয়ে আমার স্বামী ভাল উপার্জন করতে থাকেন। আমার স্বামী ভ্যান গাড়ি চালানোর পাশাপাশি আমার সাথে মাছ চাষ ও সবজি চাষে সাহায্য করে ।
আমার ইচ্ছে, মেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে একটি ভাল চাকুরির ব্যবস্থা করা ও ভাল জায়গায় বিয়ে দেওয়া। নিজেদের যেহেতু জমি নেই তাই কিছু জমি ক্রয় করা এবং একটা ঘর তৈরি করা।