শামীম আরা শিউলি: গত এক দশকে এদেশের নারীরা যখন নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে, হিমালয়ের চূড়ায় উড়িয়ে দিয়েছে জাতীয় পতাকা, তখন দুলানার মত নারীরা লড়াই করছে তিনবেলা দুমুঠো খাবারের সংস্থানে।
কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার পুকুরপাড় গ্রামের যে ঘরে সে বাস করে, সেটি তার নিজের নয়। ৬০০ টাকা ভাড়া গুনতে হয় প্রতিমাসে। আসবাব বলতে ঘরে কিছুই নেই। কয়েকটি হাঁড়ি-পাতিল, আর ছেঁড়া কাপড়-চোপড়। তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে রাত কাটে খড়ের বিছানায়। শীতে সারারাত আগুন জ্বালিয়ে রাখে। স্বামী নেই, ছেড়ে গেছে তাকে।
দিনমজুরি করে সংসার চালায় দুলানা। রাস্তার মাটি কাটে। কখনো কৃষি জমিতে কাজ করে। কিন্তু এই হাওড় এলাকা বছরের ছয় মাসের বেশী সময় পানিতে তলিয়ে থাকে। তখন কাজ থাকে না। একটু অবস্থাপন্ন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে তখন দিন চলে দুলানার। কোনদিন দুইবেলা খাবার জোটে, কোনদিন জোটে না। মাত্র ৩০ বছর বয়সে চেহারায় রাজ্যের ক্লান্তি।
হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েটির কোনদিন পা পড়েনি স্কুলের গণ্ডিতে। কিশোরী বয়সেই বিয়ে হয়েছিল ভূমিহীন কৃষক নজরুল ইসলামের সঙ্গে। একে একে কোল জুড়ে এসেছে তিনটি সন্তান। কোনমতে সংসার চলছিল। আরও অনেক নারীর মতো একবার স্বপ্ন দেখেছিলেন একটু বাড়তি আযের, ছাগল কিনতে চেয়েছিলেন।
“হেই স্বপ্নই আমার কাল হয়া গেছে। ব্র্যাক থেকে ১০,০০০ টাকা ঋণ নিয়া তুইলা দিছিলাম হের (স্বামীর) হাতে। জুয়া খেইলা সব টাকা নষ্ট কইরা পলাইছে”, আক্ষেপ ঝরে পড়ে দুলানার কন্ঠে।
পাঁচ বছর আগে সেই যে বাড়ি ছেড়েছে নজরুল, কোনদিন আর খোঁজও নেয়নি স্ত্রী-সন্তানের। তারপর থেকে একাই টিকে থাকার লড়াই করছে দুলানা। মোটামুটি একইরকম গল্প মালেকা বেগম, পেয়ারা খাতুন কিংবা মোর্তেজার। হাওড় এলাকায় এ এক কঠিন বাস্তবতা।
এখানে বছরের নির্দিষ্ট একটা সময়ে কাজ না থাকায এলাকার দরিদ্র পুরুষেরা কাজের খোঁজে পাড়ি জমায় অন্য এলাকায, কেউ কেউ যায় শহরে। সেখানে নতুন করে সংসার শুরু করে, পেছনে ফেলে আসা স্ত্রী-সম্তানের আর খোঁজ নেয় না অনেকে। তারপর আছে জুয়ার মতো সামাজিক সমস্যা।
হাওড় এলাকার প্রান্তিক নারীদের জীবন ও জীবিকা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দুলানার সঙ্গে দেখা। তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাক্ষাৎকার নেয়া ২১ জন নারীর মধ্যে পাঁচজনই পাওয়া গেল স্বামী পরিত্যক্তা। প্রত্যেকের তিন থেকে পাঁচটি সন্তান। সরকারের দুস্থ ভাতা তারা পায় না।
মালেকা বেগমের অভিযোগ দুস্থ ভাতা নিতে ঘুষ দিতে হয়। “আমি যদি ঘুষই দিতাম পারবাম, হেলে ভাতা দিয়া কী করবাম?” প্রশ্ন মালেকার।

হাওড়ে জনবসতিগুলো সমুদ্রের মাঝে বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র দ্বীপ এর মতো। ভারী বর্ষণ আর অকস্মাৎ বন্যায় ভাঙতে ভাঙতে বসতিগুলোর যেটুকু টিকে আছে, সেখানে গায়ে গা লাগা বাড়ীগুলোতে গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে হাওড়বাসী।
আধুনিক দূরের বিষয়, কোন নাগরিক সুবিধাই নেই এখানে, নেই বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, বিদ্যুৎ। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো পৌঁছায় না, খবর নেয় না জনপ্রতিনিধিরা।
“হেরা খালি ভুটের সময় আহে। হের বাদে আর দেহি না” বললেন চল্লিশার্ধ পেয়ারা বেগম। জানালেন, তার এলাকায় কোন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থারও কার্যক্রম নেই।
বর্ষা মৌসুমে অভাব চরমে পৌঁছায়। ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রায় না খেয়েই দিন কাটে। ভাতই তাদের তিনবেলার খাবার, সঙ্গে আলুভর্তা বা মরিচ ভর্তা। মাছের এলাকায় থেকেও মাছ জোটে না সহজে। হাওড়গুলোতে মাছ ধরার সুযোগ নেই তাদের, এগুলো সব ইজারা দেয়ার পর পাহারাদার বসিয়ে দেয় প্রভাবশালীরা।
ডাল আর শাকসব্জির দামও এখানে অনেক বেশী। কারণ বাইরে থেকে আসে। মাংস বছরে দুই বা তিনদিন মেলে। ফল, ডিম বা দুধ দুর্লভ তাদের শিশুদের কাছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নযন সংস্থার এক জরিপে (২০১৪) দেখা গেছে, বাংলাদেশের হাওড় এলাকার শিশুরা, প্রায় ৪৮ শতাংশ, সবচেয়ে বেশী অপুষ্টির শিকার।
উন্নয়ন অন্বেষণের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে নারী-প্রধান পরিবারগুরোল দারিদ্র ২৯.৫ থেকে কমে ২৬.৬ শতাংশ হয়েছে। এই হারে ২০২১ সালে কমে দাঁড়াবে ২০.৮৫ শতাংশ। কিন্তু দুলানারা কী এই ২০.৮৫ শতাংশের বাইরে বেরুতে পারবে?
এই প্রান্তিক, হতদরিদ্র নারীদের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে সরকার এবং বেসরকারী সংস্থাগুলোর সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেয়া দরকার। বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো নিশ্চিত করতে হবে। পৌঁছাতে হবে স্থাস্থ্যসেবা, বিশেষ করে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে জন্মহার।
হাওড় এলাকার উপযোগী আয় বর্ধক কর্মসূচি নিতে হবে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য। সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণ এবং সহজ কিস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য কার্যকর ভূমিকা দরকার জনপ্রতিনিধিদের।
কিন্তু প্রশ্ন বা খটকা জাগে মনে, এই দুলানাদের বাইরে রেখে ২০২১ সালের মধ্যে কেমন করে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছুবে বাংলাদেশ?