
প্রভাতী দাস: শুক্রবার যখন আমেরিকান সুপ্রিম কোর্ট সমকামী বিয়ে আইনসংগত করে বিল পাশ করেছে খবর এলো, তখন আমি আউট পেশেন্ট ক্লিনিকে (আমার চেম্বারে)। দক্ষিণ ম্যারিল্যান্ডের ছোট্ট মফঃস্বল শহরে। সেদিন আমার সব রুগীসহ ডায়ালাইসিস ইউনিট এর নার্স এবং অন্য সবার আলোচনার বিষয় এই একটি-ই।
আমার প্রথম রুগী, ৭৮ বছর বয়েসি এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক। তিনি বললেন, আমি বেঁচে গেছি, আমার দুই মেয়ে আর এক ছেলে কেউ গে নয়। নাতিনাতনিদের কেউ-ও নয়। বাকিদের নিয়ে আমার আর ভাবনার কিছু নেই। ওদের বিয়ে-সাদী দেখতে আমি আর বেঁচে থাকবো না। আমি হাসলাম। স্পষ্টতই তার এসবে বিন্দুমাত্র অনুমোদন নেই; সে তার ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করতে পেরেই খুশী।
এরপর অনেকের এইরকম সেই রকম মতামত শুনলাম, কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেননি, আমি কি ভাবছি। আমার শেষ রুগী ষাট উত্তীর্ণ। তিনি এ কথা সে কথা শেষ করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ডক তুমি শুনেছ তো সুপ্রিম কোর্ট এর খবর। তোমার কি মনে হয়? আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তোমার কি মতামত বলো শুনি আগে। তারপর আমি বলছি। আমার এই রুগী আমার বেশ পুরনো রুগী, কৃষ্ণাঙ্গী, প্রায় গোঁড়া ক্যাথলিক, সে কারণে প্রচণ্ড ধর্মভীরু। প্রতি রবিবার চার্চে যান, তিন মেয়ের ঘরে নাতি নাতনি তো আছেই। দুই কিশোরী নাতনীর ঘরে প্রপৌত্র আছে দু’জন।
তিনি, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখো আমার ধর্মীয় বিশ্বাস বা সামাজিক মূল্যবোধ এসব গ্রহণ করতে শেখায়নি। কিন্তু আমার আশেপাশেই অনেক ছেলে মেয়েকে দেখেছি যারা সমকামী। শুধুমাত্র ওইটুকু ছাড়া তারাও আমাদের-ই মতো মানুষ, সুখদুঃখ, আনন্দ-ভালোবাসা আমাদেরই মতো। ওরাও কারো কোন সাতে পাঁচে নেই। নিজেদের নিয়ে নিজেদের মতোই আছে, কাজ করছে, ট্যাক্স দিচ্ছে। অনেকদিন ধরেই তো ওদেরকে দেখছি, ওদের এই আন্দোলন দেখছি, আমি কি ভাবি জানো, সত্যি সত্যি যদি দুজন দুজনকে ভালোবাসে, আমরা ওদের বলার কে যে ওরা ভুল করছে। ওরা যদি কোন চুরি, ডাকাতি, খুন, খারাবি না করে তাহলে ওরা কে কার সাথে দুঃখ কষ্ট ভাগ করে নেবে সেটা নিয়ে আমি বলার কে। আর এই যে এতোদিন সমাজ ওদের তেমন করে স্বীকৃতি দেয়নি, তাতে কি আর ওসব থেমে ছিল? ছিল তো না। আজ ওরা সমাজের স্বীকৃতি পেয়েছে, এই তো। ভালোবেসে যদি অন্যরা স্বীকৃতি পেতে পারে, ওরাই বা কি দোষ করলো। আমার বিশ্বাস আমার থাক, ওদের বিশ্বাস ওদের। তুমি কি বলো। আমি বললাম, এর চেয়ে ভালো করে আমিও বলতে পারতাম না।
সবশেষে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল, ডায়ালাইসিস নার্স মেরীর সাথে। মেরী মধ্য তিরিশের, শ্বেতাঙ্গিনী। বাবা মা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এ দেশে এলেও ওর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা নিউ-ইয়র্ক শহরে। বছর দুই আগে বিয়ে করেছে ওর স্কুল জীবনের সুইট হার্ট বিলি কে অনেক বছর লিভ টুগেদার এর পর। এখন ওদের এক বছর কয়েক মাসের এক পুত্র সন্তান নিয়ে খুব সুখের সংসার। ছেলে আর বরের ছবি অনেক ছবি ওর ডেস্কের আশেপাশে। মেরী স্পষ্টতই জানালো, ব্যাপারটা ওকে খুব অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ঠিক মানতে পারছে না ও। খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো, আমি যেহেতু তৃতীয় বিশ্বে বেড়ে ওঠা আমার কেমন লাগছে। আমার তখন হাসপাতালে ফেরার তাড়া।
মেরীকে বললাম; মেরী তো তুমি তো বিলিকে ভালোবেসে বিয়ে করলে। ধরো, তোমাকে যদি কেউ জোর করে কোন একটি মেয়ের সাথে পুরো জীবন কাটাতে বাধ্য করলো, তুমি কি মেনে নিতে চাইবে? তোমার কেমন লাগবে, ভেবে জানিও। মেরী একটু অপ্রস্তুত হয়েই বললো, এভাবে ভেবে দেখিনি।
গত শুক্রবার থেকে কফির কাপ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় চলছে আমেরিকান সুপ্রিম কোর্টে সমকামীদের বিবাহ সংক্রান্ত এই নতুন আইন নিয়ে। অনেক জনের অনেক মতামত, পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তি দেখছি। সামাজিক মাধ্যম গুলোতে দেশী বন্ধুদের বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া দেখে বেশ অবাক হয়েছি। এই সিদ্ধান্তটি এবার আমেরিকা নিলেও আরও অনেকগুলো দেশেই এটি অনেকদিন ধরে আইনসংগত। নেদারল্যান্ডস ২০০১ সালে প্রথম এই বিয়ে আইনসংগত করেছে, আমেরিকা সেখানে ২০তম দেশ; সাউথ আফ্রিকা, উরুগুয়ের চেয়েও পিছিয়ে। তবু বাঙালীদের আমেরিকার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে এতো আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যাওয়া দেখে, অস্বীকার করতে চাইলেও আমেরিকার প্রভাব আমাদের উপর কতো ব্যাপক সেটাই দেখলাম আবার।
এবার নিজের কথা বলি। হ্যাঁ ,অন্য অনেকের মতোই সমকামীতা আমার জন্যও খুব জানাশোনা বিষয় ছিল না। এমনকি, মেডিক্যাল কলেজে পড়লেও। যতটুকু মনে আছে, মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ বর্ষে ফরেনসিক মেডিসিন এ এসে শব্দটির সাথে পরিচয়। এবং তখন একে পারভার্সন বা বিকৃত রুচী বলেই শেখানো হয়েছিল। আমাদের শিক্ষকদের কেউ-ই এই বিষয়ে কথা বলতে খুব স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। যারা এ নিয়ে কথা বলতেন, তারাও ব্যাপারটা যে বিকৃতি সেটাই রসিয়ে রসিয়ে বলার চেষ্টা করতেন।
এদেশে এসে প্রথম দিকে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ফ্রান্সিসকো’র কাছাকাছি ছিলাম বেশ কিছুদিন। যারা জানেন না, তাদের বলি, ক্যালিফোর্নিয়া আমেরিকার সবচেয়ে লিবার্যাল স্টেট বলে পরিচিত। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, চিকিৎসা, শিক্ষা, সামাজিক বা ধর্মীয় যে কোন ক্ষেত্রেই বেশীর ভাগ সংস্কার বা প্রথা বিরোধী আচরণের সুত্রপাত সেখানেই। স্যান ফ্রান্সিসকো-তেই জীবনে প্রথমবারের মতো সমকামী মেয়ে বা ছেলে যুগলদের দেখা হয়। প্রথম দিকে আমি যে এদের কে চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দ্বিতীয়বার দেখে নেবার চেষ্টা করিনি সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে। প্রথম প্রথম আমার-ও যে অস্বস্তি হতো না, তা নয়।
নিজের দেখার বাইরে, জানার বাইরে, গ্রহণযোগ্যতার বাইরে পুরোই নতুন এক ধারনা, ধাক্কা খেয়েছি বৈকি। ইউএসএমএলই পরীক্ষা জন্য বিহেভিয়্যারাল সাইন্স পড়তে গিয়েই সমকামীদের সম্পর্কে বিজ্ঞান সন্মত ভাবে প্রথম জানতে শুরু করা। জানলাম, এদের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে চাইলেও এরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই ছিলেন, পুরনো অনেক সভ্যতায়ও এদের খুঁজে পাওয়া যায়। এরপর রেসিডেন্সী, ফেলোশিপ এবং এখন কাজের সুবাদে অনেক অনেক সমকামী মেয়ে বা ছেলে যুগলের সাথে পরিচয় হয়েছে, হয়েছে বন্ধুত্ব। পুরনো ধারনা ভুল হলো। দেখলাম, একটি সমকামী মেয়ে মানেই বন্ধুর বউ-এর সাথে প্রেমে লিপ্ত হয় না, একটি সমকামী ছেলে মানেই সে তোমার স্বামীর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাবে না। জানলাম আমাদের-ই মতো এদেরও একে অন্যের প্রতি, সম্পর্কের প্রতি নিষ্ঠার কথা। এরাও দিনে কাজ করে, রাতে স্বপ্ন দেখে, কাঁদে, হাসে, ভালোবাসে।
একটি যুক্তি খুব শোনা যায়, সমকামীদের বিরুদ্ধে যে তাদের মিলন নতুন প্রাণ সৃষ্টি করেনা, তাই জীবনের স্রোত থেমে যায়। সুতরাং এটি প্রকৃতি বিরোধী। গোটা মানব জাতীর সবাইকেই সৃষ্টিতে লিপ্ত থাকতে হবে এমন কে বলে গেছেন, কবে, কোথায়! অনেক পুরুষ বা নারী সারাজীবন একলা কাটান, তারাও সৃষ্টি স্তব্ধ করে রেখেছেন। সেটা নিয়ে কিন্তু আমরা তেমন বাড়াবাড়ি করিনা, সেটা তাদের মর্জি বলে চুপ হয়ে যাই। এক্ষেত্রেও সেটা করাই যেতে পারে। গ্যালিলিও থেকে আইনস্টাইন, টি এস এলিয়ট থেকে আল্যান গিন্সবার্গ, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বা মাইকেল এঞ্জেলো এরা সবাই তো আমাদের বার বার দেখিয়ে গেছেন মানুষকে কোনদিনই প্রকৃতি, ধর্ম বা গতানুগতিক সামাজিকতা বিরোধী বলে থামিয়ে রাখা যায়নি, যায় না, যাবেও না। যদি যেতোই তবে আমরা কিছুতেই আজকের এই পৃথিবী দেখতে পেতাম না।
এরপরও যদি প্রশ্ন থাকে, তাহলে বলবো; ন্যায়ের দেবতা যেমন অন্ধ; তেমনি ভালোবাসার দেবতাও দৃষ্টিহীন। সেখানে একজন মানব বা মানবী একান্ত-ই নিরস্ত্র, অসহায়। যে ভালোবাসায় আপনি আপনার ভালোবাসার জনকে জড়িয়ে ধরেন, সে আপনার প্রেমিক বা প্রেমিকা, স্বামী বা স্ত্রী, ছেলে বা মেয়ে, বন্ধু বা বান্ধবী যেই হোক না কেন, সেই একই ভালোবাসায় এরাও দুজনে দুজনকে ভালবাসেন, জড়িয়ে ধরেন।
আপনার সন্তান যদি কোন একদিন আপনার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, সে সমকামী তখন আপনি কি করবেন? প্রথাবিরোধী এই একটি আচরণ সন্তানের জন্য আপনার এতো বছরের সব সত্য ভালোবাসাকে কি মিথ্যে করে দেবে? আশা করবো, দেবে না। আপনি তবু তার মংগল কামনা করবেন। বলবেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। সর্বোপরি তাকে ভালবাসবেন। চোখ বন্ধ করে ‘ভালোবাসা’ শব্দটি ভাবুন শুধু। সিদ্ধান্তটি তখন আর এতো কঠিন মনে হবে না। জানবেন, শেষ পর্যন্ত ভালোবাসাই জীবনের একমাত্র প্রাপ্তি; সংস্কার নয়, ধর্ম নয়, রাজনীতি নয়, যুদ্ধ নয় একমাত্র ভালোবাসাই ভুলিয়ে দিতে পারে জগতের সব অশুদ্ধি, বিভেদ অথবা ভ্রান্তি।