উইমেন চ্যাপ্টার: আর দশটা সাধারণ আটপৌড়ে জীবনই জ্যোৎস্না বেগমের। গ্রামে গরিব পরিবারে জন্ম, বেড়ে ওঠা। বিয়েও হয় টানাটানির সংসারেই। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানার আখিলপুর গ্রামেরই মেয়ে জ্যোৎস্নার বিয়ে হয়েছিল আবদুর রশিদের সাথে। যার নিজের কোন জমি ছিল না, অন্যের জমিতে কাজ করেই সংসার চলতো।
বিয়ে হয়ে আসার পর সংসারের এই অভাব জ্যোৎস্নাকে নাড়া দেয়। বসতবাড়ি মিলে জমির পরিমাণ ১০ শতক। তিনি তখন বুদ্ধি করে বাড়ির পাশের জমিতে সবজি চাষ শুরু করেন। এছাড়াও হাঁস- মুরগি পালন, ঘরের কাজ, বাইরের কাজ, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা, চাষবাস সব নিজের কাঁধে তুলে নেন। পাশাপাশি আগাছা পরিষ্কার, ভাল বীজ সংরক্ষণ করা ইত্যাদি কাজও দেখাশোনা করতে শুরু করেন।
এই সবজি বাগানই তার জীবন পাল্টে দেয়, সংসারে কিছুটা হলেও স্বচ্ছলতা নেমে আসে। সবজি বিক্রি করে প্রতিদিনের খরচ চলে যায়, কিছু টাকা হাতেও থাকে। সেই টাকা কাজে লাগানো হয় জমিতে। আধুনিক পদ্ধতিতে, অর্থাৎ ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করা হয়। এতে শারীরিক পরিশ্রমও কমে আসে। জ্যোৎস্না এতোসব করেন নিজের সংসারের জন্য, সন্তানের জন্য।
কিন্তু সমাজ তো তাকে কৃষক হিসেবে মেনে নেয় না শুধুমাত্র মেয়ে বলেই। অনেক বাধার মুখে পড়েছেন চাষাবাদ করতে গিয়ে, এখনও যে হোন না, তা নয়। তবে আগের তুলনায় অনেক কম। প্রথম যখন তিনি কৃষিকাজ শুরু করেছিলেন, তখন সামাজিক কুসংস্কার অনেক শুনতে হয়েছে তাকে। বলা হতো, ‘‘মহিলারা ধানের ক্ষেতে গেলে ধান ক্ষেত মারা যায়, ফসল নষ্ট হয়ে যায়’’।
কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। পেট অভুক্ত রেখে এসব গালগল্প শুনলে চলবে কী করে তার? তিনি সব দুহাতে ঠেলে এগিয়ে যান। নিজের শ্রম দেন নিজ জমিতে, তার ফলও পান হাতেনাতে। সমস্যা পোহাতে হয়েছে অন্য জায়গাতেও। যেমন কৃষিকাজ নিয়ে কোনো পরামর্শ চাইতে গেলে কেউই তাকে বিশেষ পাত্তা দিতো না, পরামর্শ বা সহযোগিতা তো আরও দূরের বিষয়। সবজি বিক্রিতেও বাধা আসে। বাজারে নারীদের আলাদা বসার কোনো জায়গা নেই।
নারীদের বাজারে যাওয়া সেই অর্থে প্রচলিতও নয়। বাজারে গেলেও নানা ধরনের আজেবাজে মন্তব্য শুনতে হয়েছে। এইক্ষেত্রে তিনি নিজে না গিয়ে স্বামীকে পাঠান সবজি বিক্রি করতে। তবে গ্রামের বাজারে দাম কম বলে লাভ খুব বেশি হয় না। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো লেগেই আছে। এ পর্যন্ত চার বার ধানক্ষেত ও রামাই ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তখন সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে আবার চাষাবাদ করে ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠেন।
জ্যোৎস্না বলছিলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ না থাকায় সরকারি কৃষি সেবা থেকেও বঞ্চিত হোন, সরকারি কৃষি সেবার ক্ষেত্রে দেখা যায় এই সেবাগুলো শুধুমাত্র পুরুষ কৃষকদের দেওয়া হয়। তখন তিনি অন্যান্যদের দেখাদেখি ‘‘প্রচেষ্টা’’ সংগঠনের সদস্য হোন। প্রচেষ্টা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে, গ্রামে আলোচনা সভা করে এবং প্রয়োজনে আর্থিক সহযোগিতাও দেয়। প্রচেষ্টাই তাকে কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ এবং কৃষি উপকরণ সহায়তা দিয়েছে। প্রচেষ্টা সংগঠন তাকে কৃষি সংক্রান্ত পরামর্শ দেয়, যার ফলে তিনি আরও পরিকল্পিত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে সফলকাম হতে পেরেছেন।
পরিবারের সবাই তার সাথে ধান শুকানো, ধান তোলা ,ধান মাড়াইয়ের কাজে সহায়তা করে, এমনটিই জানালেন জ্যোৎস্না বেগম। তার ভাষায়, “স্বামীর সাথে সাথে কৃষিকাজ করার কারণে আমি এখন সন্তানদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে, চিকিৎসাসহ সংসারের আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আমাকে দেখে গ্রামের অনেক নারীরা এখন উদ্বুদ্ধ হয়ে কৃষিকাজ শুরু করেছে। তাদের অনেকেই বুঝতে পেরেছে যে, সামাজিক বাধাগুলো মেনে নিয়ে ঘরে বসে থাকলে কোন লাভ নেই। বরং কৃষিকাজের মাধ্যমে পারিবারিক আয় বৃদ্ধি করে সচ্ছলতা অর্জন করা সম্ভব, তার পাশাপাশি পরিবার এবং সমাজে নিজের একটি শক্ত অবস্থানও তৈরি হয়”।
সমাজে-সংসারে স্বচ্ছলতার কারণে আজ সিদ্ধান্ত নেয়া বা কোনো বিষয়ে মতপ্রকাশের অধিকারও আছে জ্যোৎস্নার। এখন আর কেউই তার কোনো পরামর্শকে উড়িয়ে দেয় না শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে।
তার মতে, নারী কৃষকদের জন্য স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ দিলে, নারী কৃষি কার্ড চালু করা হলে এবং নারীবান্ধব কৃষি উপকরণের ব্যবস্থা নেয়া হলে, কৃষিতে নারীর সুযোগ সুবিধা বাড়বে, আর নারী কৃষকরাও উপকার পাবে।