নাজনীন বোন আমার, ক্ষমা করে দিও এই ভাইটিকে

Tonni 2ফজলুল বারী: দৈনিক জনকন্ঠে নাজনীন আখতার তন্বী আমার সামনের টেবিলে বসতো। সেই সময়ে জনকন্ঠের জেনারেল রিপোর্টিং টিমে নাজনীন একমাত্র মেয়ে রিপোর্টার। স্পোর্টসে মনিজা আর ডেস্কে মিনু আপা, জলি আপা, পলিসহ অনেকে ছিলেন।

পুরুষ প্রভাবিত সমাজে ও মিডিয়ায় জনকন্ঠে নাজনীনের মানিয়ে নেবার সংগ্রাম আমার চোখে দেখা। তোয়াব খান তথা তোয়াব ভাই এর উৎসাহ-পৃষ্ঠপোষকতায় সে শুধু সেখানে টিকে যায়নি, নিজের একটা অবস্থানও গড়ে নেয় সংগ্রামে। সেইসময় নাজনীন এবং রকিবুল ইসলাম মুকুলের প্রেম-বিয়েও নিজ চোখেই দেখা। এরই মাঝে আমি বিদেশে পড়তে এসে সেটেল্ড করার পরও আমাদের ভাইবোন সম্পর্কিত যোগাযোগটি অটুট ছিলো।

ওদের সন্তান চন্দ্রমুখীকে নিয়ে আমেরিকায় যাবার পর সেখানে চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ দেখেছি। কারণ তাদের চিকিৎসা ইন্সুরেন্স করা ছিল না। সেই চন্দ্রমুখীর যে এতো কঠিন অসুখ তা জেনেছি অনেক পরে। চন্দ্রমুখীকে নিয়ে নাজনীন যখন হাসপাতালের আইসিইউতে, খবরটি পেয়ে তাকে ফোন করেছিলাম। কথা বলতে পারছিল না আমার বোন।

শুধু বলেছে, বারী ভাই, আমার মেয়েটার জন্য দোয়া করবেন। সেই চন্দ্রমুখীর অকালমৃত্যু, মা নাজনীনের আত্মহত্যার চেষ্টা, তাকে বাঁচাতে সহকর্মী সাংবাদিকদের অক্লান্ত চেষ্টা, ঢাকা মেডিকেলের অপারেশন থিয়েটার রেডি করে যানজটের রাস্তা বিশেষ ব্যবস্থায় ক্লিয়ার করে নিয়ে যাওয়া সব তো মানবিক গল্পটির কয়েকটি দৃশ্যমাত্র।

এর মাঝে মুকুল একদিন চন্দ্রমুখীকে নিয়ে তার একটা বইয়ের জন্যে আমার কাছে একটা লেখা চায়। লেখাটি আমি দিয়েছিলাম। কিন্তু একদিন এ নিয়ে ফোনে নাজনীনের কান্নায় আমি অপ্রস্তুত হই। আমাকে সে বললো, আমার মরা মেয়েকে নিয়ে বইয়ের নামে ব্যবসা ফেঁদেছে মুকুল, আর আপনি লেখাটা দেবার আগে আমাকে একটু জিজ্ঞ্যেসও করলেন না! নাজনীনের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলি, বিদেশে থাকায় আমি তো এসব কিছুই জানি না।
এর মাঝে নাজনীন অনেকটা সুস্থ হয়ে গেলেও ডান হাতের একটি অপারেশন জরুরি ছিল। অপারেশনের খরচ সংগ্রহের জন্যে আমি আমাদের সহকর্মী-সুহৃদদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। এর আগে নাজনীনের চিকিৎসার জন্যে যে বড়সড় তহবিলটি এসেছিল তার পুরোটাই চলে যায় মুকুলের পকেটে!

এরই মাঝে ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে। চিকিৎসকের পরামর্শে নাজনীন আবার মা হতে চললে আমাদের কাছে প্রকাশ পেতে থাকে অন্য এক মুকুলের চেহারা! যে মেয়েটির সঙ্গে সে নতুন সম্পর্ক করে, তার ফেসবুক একাউন্টের লিংক পেয়ে আমি মেয়েটির ম্যাসেজ বক্সে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলাম। আমি তাকে লিখেছিলাম, মানুষ তো একটা সম্পর্ক করে শান্তি-সুখের জন্যে। কিন্তু জেনেশুনে সে কেন অশান্তি কিনছে? চন্দ্রমুখী-নাজনীনের জন্যে দেশের মানুষ এবং মিডিয়ার সহানুভূতির বিষয়ে তাকে সতর্ক করি। কিন্তু সে মেয়ে তো আমার বার্তার জবাব দেয়ইনি, উল্টো মুকুলসহ দুজনে মিলে ব্লক করে আমাকে!

যে রাতে মুকুল আমার বোন নাজনীনের গায়ে হাত তুললো খবর পেয়ে প্রথম আলোর কামরুল হাসান, জনকন্ঠের উত্তম চক্রবর্তীসহ আরও অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করি ফোনে। সে রাতে সবার সঙ্গে কথা বলে আমার ধারণা হয়েছিল অন্য জায়গায় এংগেজ হয়ে যাওয়া মুকুল তার ঔরসজাত অনাগত সন্তানটির জীবন বিপন্ন করতেই মারধর করেছিল আমার বোনকে! নাজনীনের বন্ধুরা সে রাতেই নারী নির্যাতন মামলায় মুকুলের গ্রেফতার চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতেও ধৈর্য্য দেখিয়েছে নাজনীন। সংসারটা সে রক্ষা করতে চেয়েছে। আমাদের বেশিরভাগ মেয়েই তা চায়। কিন্তু লোভ মুকুলকে গ্রাস করাতে তা আর সম্ভব হয়নি।

এর মাঝে আবার মা হয় নাজনীন। 
সেই মুকুলের বিরুদ্ধে অবশেষে নাজনীনের মামলা ও তার গ্রেফতারের খবরে অনেকে হয়তো আকাশ থেকে পড়েছেন! কিন্তু যারা আদ্যপান্ত সব জানেন, তারা জানেন কতোটা ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছে নাজনীন। মুকুল তার স্ত্রী তথা এক নারীর গায়ে হাত তুলেছে এটা মিডিয়ায় বিশেষ করে তার গাজী টিভির অনেকেই জানতেন। এরপরও কী দিব্যি চলছিল মুকুলের মিডিয়া জীবন! নারী নির্যাতনের ঘটনার কোনো ছাপ পড়েনি তার পেশাগত জীবনে। গাজী টিভি এভাবেই প্রশ্রয় দিয়ে যায় এরকম একটি অপরাধকে।

মুকুলের গ্রেফতারের খবর দিতে গিয়ে প্রথমে অনেক মিডিয়া গাজী টিভির নামটি পর্যন্ত এড়িয়ে যায়! কিন্তু এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দা-প্রতিক্রিয়া বাড়লে অনেক মিডিয়া তাদের রিপোর্টে সংশোধনী আনে! গাজী টিভি থেকে একাধিক ব্যক্তি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে যে তথ্যটি দিয়েছেন তা বিস্মিত করেছে! এতসব জঘণ্য কাজ কারবারের পরেও নাকি সেখানে মুকুলকে রক্ষা-ছত্রছায়া দেবার কাজ করছিলেন আমাদের খুব পরিচিত কিছুজন! তাদের মাথায় বা বিবেকে কী একবারও আসেনি যে যদি কেউ নারী নির্যাতন করে, বউ পিটায় অথবা নারীর গায়ে হাত তুলে সে তখন আর সাংবাদিক থাকে না।

এমন একটি চাঞ্চল্যকর মামলার আসামিকে মাত্র একদিনের রিমান্ডে দেয়া-নেয়া হয়েছিল! এই সিদ্ধান্তটি কোথা থেকে এসেছিল জানতে ইচ্ছা করে। যদিও প্রসিকিউশন সংশ্লিষ্ট একজন আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, এই অপরাধীর যথোপযুক্ত সাজা হবে। কারণ নাজনীনকে নির্যাতনের পর হাসপাতালে তাকে যত সাংবাদিক নিয়ে গেছেন, এত সাক্ষ্য সাধারণত এমন সব মামলায় পাওয়া যায় না।

এর মাঝে একাত্তর জার্নালে নির্যাতিতা নাজনীনকে তুলে ধরে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করেছে একাত্তর টিভি। এই মামলাটি যাতে একটি দৃষ্টান্ত হয়। মিডিয়ার মানুষ বলে যাতে পার পেয়ে না যায় একজন নারী নির্যাতক। আর এর মধ্য দিয়ে যেন নারী নির্যাতন বন্ধেও একটি অনুকরণীয় পদক্ষেপ তৈরি হয়।

তন্বীকে বলছি, তোমার জরুরি প্রয়োজনের সময়গুলোতে কাজে লাগতে না পারায় এই ভাইটিকে ক্ষমা করে দিও। আমরা তোমাকে ভালোবাসি, তোমার পাশেই আছি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.