তামান্না কদর: সম্প্রতি ভারতের যৌনকর্মীদের বক্তব্য, সিনেমার নায়িকাদের কেনো যৌনকর্মী বলা হবে না? তারাও তো সিনেমায় যৌনতা বিক্রি করে। এই বক্তব্যটি আরও অনেক আগেই আসা উচিত ছিলো। আমি তাদের সাখে সম্পূর্ণই একমত।
ভারতীয় সিনেমাগুলিতে দেখা যায়, একই জায়গায় একই নাচগানের দৃশ্যে নায়কের পোশাক একবারে সাধারণ আর নায়িকার পোশাক হলো এরকম যে-ওইখানে উন্মুক্ত, এইখানে উন্মুক্ত। অনেক উদারনীতিক এতে নানারকম যুক্তি দেখাবেন। বিনোদন বলে ছাড় দিতে চাইবেন। কিন্তু কথা হলো নারীকেই কেনো উদোম করতে হবে? এজন্যেই তো?
যে, বেশীরভাগ পরিচালক পুরুষ, সমাজটা পুরুষ। যে কজন নারী পরিচালক আছেন, তাদের বেশীর ভাগটাই আবার মগজে পুরুষ। বোরকা আমার কাছে যেমন সংক্ষিপ্ত পোশাকও আমার কাছে তেমনই মনে হয়। দুটোই নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে।
বলতে পারে কেউ কেউ যে, এটা সিনেমা, এখানে বিনোদন থাকবে। স্বভাবত এমন ধারণাটি স্বাভাবিক বলেই প্রমিত। কিন্তু ওই যৌনকর্মীদের কথাই ঠিক।
নায়িকারা স্বল্প পোশাকে পুরুষের বিনোদন যোগাতে শরীর বা যৌনতা বিলাক, কিন্তু কথা হলো তারা যৌনকর্মী ট্যাগ না পেয়ে বরং সমাজে সমাদৃত হয়, কেনো? এটি অবশ্যই অন্যায়। অভিনয়ে চুমু বা বিছানার দৃশ্য। আসলেই কী চুমু খাওয়া বা বিছানার দৃশ্যে যাওয়া-এগুলি শুধুই অভিনয়?
অনেকে বলতে পারেন, হ্যাঁ এগুলি শুধুই অভিনয়, দৃশ্যের প্রয়োজনে এগুলি করা, এখানে নায়ক বা নায়িকা কেউ কারোকে ভালোবেসে চুমু খায় না বা বিছানার দৃশ্যে অংশ নেয় না। কথা একদম সত্যি! তবে এর ভেতরের প্রয়োজন কিন্তু ‘দৃশ্যের প্রয়োজন’ নয়; এখানে আছে পুঁজিবাদী চিন্তা-চেতনা। আর কে না জানে পুঁজিবাদী চিন্তা-চেতনার এক বড়ো টার্গেট নারী?
তাহলে এবার প্রশ্ন রাখি, যৌনকর্মীরা কি ভালোবেসে খদ্দেরকে বুকে তোলে নেয়? সেও তো জীবিকার তাগিদে এই কাজটি করে, নায়িকারাও জীবিকার তাগিদেই অভিনয়ে শরীর প্রদর্শন এবং শরীর বিনিময় এর কাজটি করে।
এখানে উল্লেখ্য যে, নায়িকা একা তো নয়, নায়ক অর্থাৎ পুরুষও তো এতে অংশ নেয়। এটাও ঠিক। তবে খেয়ালযোগ্য যে পুরুষটির প্রচার কতোটা হয়? অবশ্যি এই একই অর্থে সিনেমার নায়কদেরও যৌনকর্মী বলা যায় অনায়াসে। কিন্তু সামাজিক বাস্তবতায় দোষটি-নিন্দাটি নারীর জীবনেই জোটে। যেমন জোটে পতিতার জীবনে, খদ্দেরের জীবনে নয়।
এটার কারণ আছে। কারণটি হলো অর্থ অর্থাৎ ক্ষমতা। ক্ষমতাই নিয়ন্ত্রণ করে সকল কিছু। আরেকটু ভেঙ্গে বললে বোধ হয় বিষয়টি পরিষ্কার হয়। পর্নছবির সানি লিওনকে যেভাবে সামনে আনা হয়, সেভাবে কি তার একান্ত পুরুষ সহকর্মীদের সামনে আনা হয়? আনা হয় না। কারণ এগুলোর খাদকের বড়ো অংশ পুরুষ, আর সমাজটাতো পুরুষেরই।
যৌনকর্মীদের যে বিষয়টার সাথে একমত নই তা হলো- বেশ্যাবৃত্তিকে স্বীকৃতি দিতে হবে। কেনো? তারা যেনো সমাজে মানবাধিকার নিয়ে মানুষের অধিকার নিয়ে চলাফেরা করতে পারে।
আমি অবশ্যই প্রথমত বলি, তারা মানুষ, তারা মানুষের অধিকার নিয়েই বাঁচবে। কিন্তু এটিকে পেশা হিসেবে স্বীকার না করলে আবার মানুষের অধিকারগুলি পাবার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। তাহলে কী করা? এই প্রথাটিই থাকা উচিত নয়। এর আগেও বেশ্যাবৃত্তি কেনো পেশা হতে পারে না তার কারণ সম্পর্কে বলেছি।
বেশ্যাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্যে যে কয়টা যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছে তা নিতান্তই আপাতদৃষ্টিতে দেখা জীবন দর্শন এবং পুঁজিবাদী দর্শন।
খেয়াল রাখতে হবে পতিতার কাজ টাকার বিনিময়ে নিজের শরীর প্রদান-যেখানে নারী ন্যুনতম মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয় না। অনেকে এও বলেন যে, মাথা অর্থাৎ বুদ্ধির (স্বীকৃত স্বাভাবিক পেশা) বিনিময়ে যদি অর্থ উপার্জন বৈধ হয়, তাহলে শরীরের বিনিময়ে দোষ কোথায়?
দোষটা হলো, এখানে নারীকে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আবার অনেকে এও বলেন যে, জগতের সকল কিছুই পণ্য। কী আর বলি! ধরা যাক, যৌনকর্মীদের কাজটি পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পেলো আর আমাদের মেয়েরাও ছোটবেলায় বলতে শুরু করলো, বড় হয়ে আমি একজন যৌনকর্মী হবো। কেমন লাগবে শুনতে?