সারিতা আহমেদ: প্রতিদিন সন্ধ্যে হয় প্রতিটা বাড়ির খিড়কি থেকে ভেসে আসা কিছু খুব চেনা সুরের আবাহনে। হ্যাঁ, স্টার জলসা, জী বাংলা, ইটিভি অথবা রকমারি হিন্দি এন্টারটেইনমেন্ট চ্যানেলগুলোর কথাই বলছি।
আট থেকে আশি বছর বয়সী সবাই ‘হাঁ’ করে ‘বোকা বাক্সে’র সামনে বসে পড়ে সব কাজ ফেলে, বা হাতের কাজ সেরে, বা তাড়াতাড়ি কাজ গুছিয়ে। যেন কী এক আফিমের নেশা! যেন বাহা-কনক-রাশি-সৌভাগ্যবতী-নন্দিনী-জলনুপুর-পারি-দুষ্টু এদের ছাড়া বাঙালির ফ্যামিলি অসম্পূর্ণ!
বাহা-কমলীকার আকচা-আকচি; অর্চির একাধিক বিয়ে, অথবা শাশুড়ির কূটচালের কী করে যুতসই জবাব দিচ্ছে নন্দিনী! বা দিদি ঝিলমিল ও মামীর ষড়যন্ত্রের যোগ্য জবাব কেমন করে দিয়ে চৌধুরীবাড়ির যোগ্য-বৌ হয়ে উঠতে পারবে কনক? — এইসব নিয়ে মধ্যবিত্তের সান্ধ্য ডিবেট বেশ জমে ওঠে।
বৈঠকি বিকেলগুলো এখন আর বাচ্চাদের খিলখিলানিতে ভরে ওঠে না। বড়দের দাবার চাল বা মা-মাসিদের উলবোনার গপ্পে মুখরিত হয়ে ওঠে না। একটু বড় বাচ্চাদের পড়াশোনার ফাঁকে মায়েদের তর্জন-গর্জন শোনা যায় না “কিরে, গলা শুনতে পাচ্ছি না কেন? চেঁচিয়ে বানান করে পড়া কর।”
নাহ… এগুলো এখন অতীত।
এখন মা-মাসীরা ভারি ব্যস্ত বাহা-কনকের নতুন শাড়ির কালেকশন নিয়ে, ওদের রকমারি ষড়যন্ত্রের ফাঁদ আর তার ছোট্ট ছিদ্রগুলো নিয়ে।
বাচ্চারাও তাদের ফলো করে স্কুলে এখন নির্দ্বিধায় বলে,
”জানিস না, অর্চির তো দুটো বিয়ে! বাহা তো কমলীকার বাবার অবৈধ সন্তান! কঙ্কাকে তো সেই লোকটা বিয়ে করেনি, রেপ করেছিল… না না ওদের একটা সম্পর্ক ছিল বিছানায় … জানিস তো সেইজন্য বাহা জন্মেছে।”
আমরা শিক্ষিকারা কিছুতেই এই আলোচনা থামাতে পারি না।
কারণ, এগুলো ওদের মাছ-ভাতের মত জীবনসঙ্গী হয়ে গেছে। কিছুতেই এগুলো থেকে ওদের বিরত করা যাচ্ছে না। এতেই বাড়িশুদ্ধ সবাই আছন্ন। বড়দের থেকেই বাচ্চারা শেখে। কেউ ভাবেই না, বাচ্চাদের মাথায় এগুলো ভাইরাসের ন্যায় ছড়াচ্ছে।
‘মোরালিটি’ নামক বিষয় এখন প্লুটোয় প্রাণ পাওয়ার মতো অবাস্তব।
সিরিয়াল কর্তারা এমন স্টোরি বানাচ্ছেন যার পাশে ‘A’ চিহ্ন থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু না, রমরমিয়ে চলছে এমন সব নারীবিদ্বেষী ও অনৈতিক বার্তাবাহী কিছু চলমান গল্প।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সিরিয়ালগুলোয় বাড়ির কর্তাপুরুষদের দেখানো হয় Inactive ‘ক্লীব’ রূপে। যেন তাদের নিজস্ব কোনো মতামত নেই, মেরুদণ্ডহীন জড় পদার্থ এক-একটা। বাস্তবের সাংসারিক চিত্র থেকে একদম ১৮০ ডিগ্রী উলটো ব্যাপার!
কেন?
খুব চালু উত্তর হলো, সিরিয়াল তো মূলত নারীরা দেখেন, তাই তাদের মনের খোরাক জুগিয়ে এই গল্পের প্লট সাজানো হয়েছে। যাতে বাস্তব সংসারে তারা যা যা করতে চান অথচ পারেন না, সেগুলোই দেখানো হচ্ছে সেলুলয়েডে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো, আর কী!
বাহ! চমৎকার!
বাস্তবের কোন নারী চান এমন একটা জড়পদার্থ মার্কা স্বামী? ২৪ X ৭ হাড়জ্বুলুনে শ্বশুর-শাশুড়ি? দিনরাত হৈ চৈ পার্টি করা বাড়ি? সাতমহলা বাড়ির নিত্যদিনের নাটক? গাদা গাদা ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক বাজাতে চান কোন গৃহিনী?
আসলে, খুব সূক্ষ্মভাবেই কিন্তু পুরুষদের আড়াল করা হয় এই সিরিয়ালগুলোতে। এমন, যেন ওনারা সাধুপুরুষ, ভাজা মাছটিও উলটে খেতে জানেন না। নারী মহলের ছিপে গাঁথা কাতলা মাছটি যেন!
কেন?
কারণ, একটু তলিয়ে ভাবলেই দেখা যাবে যে, পুরুতান্ত্রিক মানসিকতার বীজ যদি কোনো নারী দ্বারা প্রচার করা যায়, তাহলে পুরুষদের ফিল্ডে নামার দরকারই পড়ে না!
এতে করে লাভের গুড় পুরোটাই কিন্তু নারীবিদ্বেষী সমাজের জিভে লপলপ করে।
তথাকথিত কর্তা ‘শোষকের ভূমিকা’য় ম্যাচ খেললেন না। ওপেনিং থেকে মিডল অর্ডার অবধি লেলিয়ে দিলেন শাশুড়ি বা জা বা বৌদি বা মামী বা মাসি বা বিধবা পিসি এদের। এরাই তো ম্যাচটা ভালোই খেলে দিতে পারলেন পুং টিমের হয়ে । দিনের শেষে ‘ম্যান অফ দি ম্যাচ’ কিন্তু ওই পুং-টিম মানসিকতা।একইসাথে আবারও ‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’ এই আপ্ত বাক্যটিকে যথাযথভাবে প্রমোট করাও হল উপরি পাওনা হিসেবে।
সেই রাজবংশিয় যুগ থেকেই, সেই মোগল আর রাজপুতের গল্পের সময় থেকেই , সেই ‘জহর ব্রত’ বা ‘সতী প্রথা’র সময় থেকেই … মেয়েদের দিয়ে মেয়েদের পেটানো বা জ্বালানো বা ধ্বংসের বীজ বোনানো পরম্পরা অনুযায়ী চলে আসছে।
এর পেছনে কে দায়ী?
উত্তরের পর উত্তর গেলে একের পর এক নারীদের নানা ভূমিকায় তুলে ধরা হবে ‘ মা- মাসী-দিদিমা-পিসিমা-ঠাকুমা-প্রমাতামহ… ‘
সবশেষে দায় পড়বে ধর্মগ্রন্থে এবং সেখানেও থাকবে ‘খনার বচন’ এবং এমন নানা নারীর উদাহরণ।
তারও পরে যদি উত্তর চাও তো, দেখতে পাওয়া যাবে সব সংস্কার এবং সংসারের যাবতীয় ‘জায়েজ’ নিয়মগুলোর রূপকার একজন বা একাধিক পুরুষ। যারা জন্ম দিয়েছে পুংতন্ত্র।
যা শিকড় গেঁড়েছে পুং মাথা ছাড়িয়ে ক্রোমোজমের ডিএনএ থেকে প্রতিটা কোষের গুপ্ত কুঠুরিতে।
আর সেখান থেকেই তার ধারক বাহকগণ সুকৌশলে প্রবেশ করিয়েছে মেয়েদের মাথার সতেজ তরুণ কোমল মস্তিষ্কে।
এই মেয়েরাই পুং ধ্যানধারণাকে মেয়েজীবনের পরমধর্ম – কন্যাজন্মের সার্থকতা এবং আরো নানা অলংকারে ভুষিত করছে যুগে যুগে … এখনো … আগামী সহস্র বছরেও যা চলবে নিরবছিন্নভাবে।
আধুনিক সিরিয়ালগুলো সেই পুরোনো মদ নতুন চকচকে বোতলে পরিবেশন করে চলেছে মাত্র। চাবুকটা শুধু কর্তার হাত থেকে নিয়ে ধরানো হয়েছে কর্ত্রীর হাতে, যিনি নিজেও একই ধারণার বশে আফিমগ্রস্ত।
বলা হয়, টিভি/মিডিয়া/প্রোগ্রাম সব নাকি বাস্তব থেকে ধার করা।
তাহলে, বাস্তব মহিলাদের ছবি ধরা পড়ে না কেন সিরিয়ালগুলোয়? আজকের শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত নারীরা বেশিরভাগই বহির্মুখি, সুচাকুরে, ঘরে-বাইরে সমান তালে ব্যালেন্স করে চলা পরিপূর্ণ মানুষ।
কিন্তু সেলুলয়েডে যাদের আমরা বাঙালি ঘরের লক্ষী হিসেবে দেখি তারা সব গৃহবধূ।
সব ‘অর্ধেক আকাশ’ প্রাপ্তির কাঙ্গাল!
শাখা-সিঁদুর ছাড়া যাদের অস্তিত্ব আর অসতীত্ব সমার্থক!
চাকরির চেষ্টা করলে তাদের শুনতে হচ্ছে গঞ্জনা (বাস্তব কিন্তু উলটো কথা বলে, স্ত্রীর মোটা টাকা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স থাকলে বাস্তব সংসার কিন্তু তাদের হেলাছেদ্দা করে না মোটেই)।
একটা মেয়ের স্ট্রাগল মানে দেখানো হচ্ছে তার অবৈধ জন্ম, পিতৃ পরিচয় খোঁজাটাই যেন মূখ্য একটা মেয়ের কাছে।
অথবা ত্রিকোণ প্রেমের টানাটানিতে দুই চুলোচুলি করা মেয়ের মধ্যে কে পাবে সেই অমূল্য রতন পুরুষ কর্তাটিকে। যেন উনি কলির কেষ্ট … এখন তোরা খামচা খামচি করে মর! (এ কেমন আবালের পরীক্ষা ? )
অথবা তাকে যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে শ্বশুর বাড়ির ঠাঁটবাট-আদব কায়দা শিখে নিয়ে, স্বামী-সন্তান-ইন ল’ দের মুখরোচক খাবার রান্না করে,
অথবা নানা কূটনীতি চাল ইত্যাদির পালটা ঘাত দিয়ে।
‘অমুক পরিবারের যোগ্য বৌমা’ হয়ে ওঠাই যেন মূল লক্ষ্য মেয়ে জীবনের!
যেন মেয়েদের এসব ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা নেই, পরিচিতি প্রমানের আর কোনো রাস্তা নেই… যেন আর কোনো ‘পরিচয়’ই নেই শিক্ষিত নারীর।
বাংলা সিনেমা যেখানে নানাবিধ বিষয় নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ছবি বানিয়ে সফল হচ্ছে, সেখানে সিরিয়াল, সোপ অপেরাগুলো যাদের দ্বারা আগামী প্রজন্মের মেয়েরা দ্রুত বাড়ি বসেই নানা বার্তা পাচ্ছে, শিখছে; তারা দেখাচ্ছে সেই ‘খনার বচন’ টাইপ সেকেলে টিপিক্যাল মহিলামহল থুড়ী পুরুষতান্ত্রিক বশ্যতা।
টিভি এমন এক মাধ্যম যা গ্রামগঞ্জে দুর্গম জায়গাতেও তথ্য সম্প্রচার করে। সেই সহজলভ্য গণমাধ্যমটিকে যদি নারীবিদ্বেষ ছড়ানোর প্রোমোটারি ব্যবসায় কাজে লাগানো হয় তা হলে বোঝাই যাচ্ছে আগামী প্রজন্ম কোন শিক্ষায় শিক্ষিত হবে!
আমরা যেন ভুলে না যাই…বাহা-কনকদের জন্মক্ষণ বা বৈধ অবৈধ সেক্সুয়াল রিলেশনের দীক্ষায় আমাদের বাড়ির কচি মেয়ে বা ছেলেকে দীক্ষিত করছি আমরাই।
সুতরাং, পরে ওদের রেজাল্ট কেন খারাপ হলো, বা কেন ওরা এমন কুসঙ্গে পড়ে জীবন নষ্ট করলো বা কেন ওরা এত কম বয়সে ক্লিনিক ফেরত হয়ে শারীরিক মানসিক সব দিক থেকে বিপর্যস্ত হলো … তার দায় কিন্তু ওদের ঘাড়ে চাপালে চলবে না।
আজকের সান্ধ্য বৈঠক যদি এমন শিক্ষা প্রমোট করে এবং তা গিলে মা-ছা সবাই ধন্য ধন্য রব ফেলে … তাহলে শেষের সেদিন কিন্তু খুব দূরে নেই।