বীজ সংরক্ষণে জাহেরা বেগমের সাফল্য

Zahera 1oxfamঅক্সফাম: জাহেরা বেগমের বয়স ৪৫ বছর। কুড়িগ্রাম জেলা সদরের ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গনে আক্রান্ত  যাত্রাপুর ইউনিয়নের গারুহারা গ্রামের বাসিন্দা তিনি। ১৬ শতক জমির উপর তার নিজস্ব ভিটা। নিজে একজন প্রান্তিক নারী কৃষক, নিজের কোন জমি নাই, অন্যের ৯৬ শতক জমিতে বর্গাচাষ করে কোনরকমে জীবন চালান। শুধু নিজেরই নয়, জীবন চালার পরিবারের আরও পাঁচজন সদস্যেরও।  

একে তো সামান্য জমি, তারপর নিজের অত দক্ষতা নেই, কীভাবে সঠিকভাবে চাষবাস করে চলতে হবে এ নিয়ে সংশয়ে পড়েন জাহেরা। ছোটবেলা থেকে দেখে দেখে যা শিখেছেন সেই জ্ঞান থেকেই কৃষিকাজ করেন। কেউ কোনদিন কোনো পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেনি। উপরন্তু নারী কৃষক হিসেবে সবসময় সমালোচনার সম্মুখীন হতে হতো। গ্রামের কেউই তাকে নারীকৃষক হিসেবে মূল্যায়ন করতো না।

জাহেরা বলছিলেন, কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ না থাকায় তিনি বীজ সংরক্ষণের উপায় জানতেন না। ফলে একবার ফসল ফলানোর পর আবারও জমিতে ফসল ফলাতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হতো। বীজ কেনার জন্য বাজারে যেতে হতো, কিন্তু বাজারে যেসব বীজ পাওয়া যেত, তাও আবার ঠিক ছিল না। ভাল বীজ পাওয়া যেত না। তখন এলাকার অন্য কৃষকদের কাছে বীজ সংরক্ষণের উপায় জানতে চাইলে কেউ কোন সহায়তা করেনি।

এই অবস্থায় একদিন অক্সফ্যামের ফুড সিকিউরিটি গর্ভনেন্স প্রকল্পটি তার চোখ খুলে দেয়। কৃষি সেবায় কৃষকের প্রবেশাধিকার বিষয়ক ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠানে উপজেলা কৃষি অফিসার কুড়িগ্রাম সদর এর কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন “ঘরোয়াভাবে বীজ সংরক্ষণ করার পদ্ধতি ও বীজের গুণগত মান অক্ষুন্ন রাখার নিয়ম। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

জাহেরা একপর্যায়ে গারুহারা গণ সংগঠনের কার্যকরি কমিটির সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন এবং বাংলাদেশ সরকারের ইন্টিগ্রেটেড এগ্রিকালচারাল প্রডাক্টিভিটি প্রকল্পের ফার্মার ফিল্ড স্কুল (এলএফএস) গারুহারা যাত্রাপুর এর একজন সদস্য। ফুড সিকিউরিটি গর্ভনেন্স প্রকল্পের আওতায় ১৬০ জন (নারী-১৪৪ জন, পুরুষ-১৬ জন) কৃষক নিয়ে গঠিত হয় গারুহারা গণ সংগঠন। সংগঠনটি গারুহারা গ্রামের কৃষকদের সেবা ও সম্পদে প্রবেশাধিকারসহ সামাজিক সাম্য, ন্যায্যতা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রত্যয়ে ০৯-০৬-২০১৩ সালে গঠন করা হয়।

Zahera 2অথচ এই সংগঠনটি গঠনের আগে গারুহারা গ্রামের কৃষকরা জানত না কোথায় কী সেবা পাওয়া যায়। মূলতঃ সেবার ধরণ ও কৃষি সেবার প্রবেশাধিকারে নানাবিধ সমস্যাসহ সামাজিক বৈষম্য এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল গারুহারা গ্রামের জনগণ। গ্রামীণ এ জনপদের সীমাহীন সমস্যার মাঝে দরিদ্র কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব করছে গারুহারা গণ সংগঠন। ২০১৩ সালে শীত মৌসুমে বীজের চাহিদা মেটাতে জাহেরা তার সমস্ত অভিজ্ঞতা ও শিক্ষণ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ধানের বীজ (২৮ ও ২৯ নং), সরিষার বীজ, লাউ বীজ, সীম বীজ ও ডাল বীজ (মশুর, মাসকালাই ও খেসারি) সংরক্ষণ করি। তার সংরক্ষিত বীজের চাহিদা সে বছর সবার নজর কাড়ে। যারা যারা তার কাছ থেকে বীজ নিয়ে ধানের বীজ (২৮ ও ২৯ নং), সরিষার বীজ, লাউ বীজ, সীম বীজ ও ডাল বীজ (মশুর, মাসকালাই ও খেসারি) ফসল উৎপাদন করছিল তাদের সবারই উৎপাদন ভালো হয়েছে। এ ঘটনায় জাহেরা বীজ সংরক্ষণের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে এবং তা সকলের নজর কেড়ে। আর এরপর থেকেই তার বীজের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

জাহেরা সাথে কথা বলে জানা যায়, চলতি শীত মৌসুমের পূর্বে তিনি ১০০০ টাকা মূলধন খাটিয়ে ধানের বীজ (২৮ ও ২৯ নং), সরিষার বীজ, লাউ বীজ, সীম বীজ ও ডাল বীজ (মশুর, মাসকালাই ও খেসারি) প্রভৃতি ভিত্তি বীজ সংরক্ষণ করি বাজার জাতকরণের উদ্দেশ্যে। পূর্বের সুনামকে কাজে লাগিয়ে ধানের বীজ (২৮ ও ২৯ নং), সরিষার বীজ, লাউ বীজ, সীম বীজ ও ডাল বীজ (মশুর, মাসকালাই ও খেসারি) এসব সংরক্ষিত বীজ কৃষকদের কাছে বিক্রি করেন প্রায় ৫০০০ হাজার টাকা মূল্যে। লাভের এই চিত্র এখন আর তার এক মৌসুমের নয়, তা প্রতি মৌসুমের বেলায় প্রযোজ্য। বীজ সংরক্ষণের লাভের এই টাকা দিয়ে তিনি তার পরিবারের পুষ্টিমান সম্পন্ন খাদ্য চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।   

গারুহারা গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদের কাছে জাহেরা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “চলতি মৌসুমে আমি জাহেরার বীজ নিয়ে লাউ আবাদ করেছি, আমার লাউয়ের ফলন বিগত বছরের তুলনায় ভালো হয়েছে। তার বীজ ভালো না হলে লাউয়ের ফলন ভালো হতো না।”

জাহেরার মতে, তার বীজ বর্তমানে তার গ্রামে একটি মডেল হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। তার সাফল্য দেখে গারুহারা গ্রামের নয়টি পরিবার এখন একত্রে বীজ সংরক্ষণ করছে এবং সংরক্ষিত বীজ থেকে সমষ্টিগতভাবে বাজারে বিক্রি করছে। এতে তারা যেমন আর্থিকভাবে লাভবান অন্যদিকে জনগণ গুনগতমানের বীজ পেয়ে উপকৃত হচ্ছেন।

তিনি বলছিলেন, প্রচলিত বাজারের বীজসমূহ অনেক সময় নিম্নমানের হওয়ার ফলে কৃষকেরা আশানুরূপ ফসল পেত না। কিন্তু আমার সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষিত বীজে সংশ্লিষ্ট এলাকায় কৃষি উৎপাদন বেড়েছে যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ অবদান রাখছে। “ভালো বীজে ভালো ফসল” আর এই ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভালো বীজের কোন বিকল্প নাই এই কাজটি করে দেখিয়েছি আমি।

শেয়ার করুন: