আমার মা, আমার রোল মডেল

Mothers Day 1তামান্না ইসলাম: কাউকে দেখামাত্র গলা জড়িয়ে ধরে হাগ দেওয়া ব্যাপারটা আমার একদমই আসে না। এই কারণে অনেক সময় অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও পড়তে হয়। আমার একবন্ধু আছে হাগ দিতে ওস্তাদ।

হয়তো আমাদের দুজনের সাথে কমন আরেক কোন বন্ধুর দেখা হলো, দেখা যাবে সে ছুটে যেয়ে জড়িয়ে ধরেছে তাকে, আর আমি অস্বস্তি নিয়ে পাশে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছি, আর মনে মনে আমার বন্ধুর উপর বিরক্ত হচ্ছি। সেই আমি গতকাল লাইন ধরে ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে এক আফ্রিকান মহিলাকে হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে এক বিশাল হাগ দিয়েছি।

ব্যাপারটা অদ্ভুত না?

অদ্ভুত হলেও সত্য। একথা  সত্যি যে, ওই নারী অনেক বিখ্যাত, কিন্তু সেটা মুখ্য ব্যাপার ছিল না আমার কাছে। মুখ্য ব্যাপার ছিল তার কথা। আমি প্রতি বছরই কিছু না কিছু মেয়েদের কনফারেন্সে যাওয়ার চেষ্টা করি, এর প্রধান কারণ হোল যেসব স্পিকাররা আসেন, তাদের যাদুকরি স্পিচ শোনা।

কী যে অসাধারণ তাদের একেকজনের গল্প, কী বিরাট প্রাণ শক্তি, কী শক্তিশালী তাদের চিন্তা ভাবনা, এরা সবাই একটু একটু করে আমার মাঝে স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছে। আর আমি সেই বীজ এখন আস্তে  আস্তে আমার চারপাশের মেয়েদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই।  

গতকালের এই নারী ছিলেন একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী, তার গল্প বলে এখানে পোস্ট লম্বা করবো না, তবে যে কথাটা আমার চোখ খুলে দিয়েছে সেটা হলো তার বক্তব্য “তুমি কি একজন শান্ত, লক্ষ্মী নারী যে জীবনে কাউকে কোন কষ্ট দেয়নি, এমনটি হয়ে মরে যেতে চাও, যাকে কেউ মনে রাখবে না কোনদিন, নাকি তুমি এমন একজন হতে চাও যে একটা রুমে ঢোকামাত্র রুমের সবার মধ্যে টেনশন কাজ করে সে রকম একজন হতে চাও, যাকে সবাই অনেক দিন মনে রাখবে?”

গতকাল এসেছিল ১৭ বছরের এক চাইনিজ মেয়ে, যাকে বিজ্ঞানে অবদান রাখার  জন্য পুরস্কার দেওয়া হোল। সেই মেয়েটি তার স্পিচে বলে নাই  “আমি বিজ্ঞানী হতে চাই”,  বরং বলেছে “আমি আমার পরিবারের প্রথম মেয়ে যে কলেজে যাওয়ার সৌভাগ্য পাচ্ছি।”

বিশ্বাস হয়? আমেরিকার মতো সভ্য দেশে? তার কথাটা আমাকে বড় ধরনের একটা ধাক্কা দিয়েছে, আমরা কতো সৌভাগ্যবান। তার পরের বাক্যটি ছিল আরও চমকপ্রদ “যখন কোন মেয়ের সামনে কোন রোল মডেল থাকে না, তার পক্ষে এগিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন, তাই আমি বড় হয়ে একজন রোল মডেল হতে চাই।”

ঠিক সেই মুহূর্তে আমি প্রথম বুঝতে পারি যে আমার সমস্ত সাফল্যের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি, তিনি আমার রোল মডেল, আমার মা। আমার মায়ের কথা না বললে মেয়েদের উদ্দেশ্যে  আমার যেকোনো লেখাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

আমার মা বহু বছর আগে মাস্টার্স করেছেন ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে। রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েও আধুনিকতার এক বাস্তব উদাহরণ তিনি আমার কাছে এবং তার আশেপাশের অজস্র ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মীর কাছে। খুব আহামরি ফলাফল ছিল না, মঝারি মানের ছাত্রী, কিন্তু তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, সততা, সাহস আর মানুষের জন্য বুকভরা ভালোবাসাই ছিল তার সম্পদ।

ঊনার নিজের মুখে বলা একটা গল্প বলি।

যখন চাকরিতে ঢুকেছেন লেকচারার হিসাবে, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো ছিল না।  পুরান ঢাকার কলেজ, অনেক ছাত্রের বয়স ঊনার চেয়ে পাঁ বছরের বেশী। পরীক্ষার হলে গার্ড দিচ্ছেন তিনি। ছাত্র নামধারী রাজনৈতিক নেতাদের নকলের প্রতিবাদ করতে তিনি পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে এসেছেন, প্রিন্সিপালকে জানিয়েছেন, এই পরীক্ষা নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। কয়েক ঘণ্টা পর সেইসব নেতারা বাসায়  এসেছে, ঊনার সই না হলে খাতা জমা দেওয়া যাবে না।

ঊনি তাদেরকে মুখের ওপরে না করে দিয়েছেন নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে, আমার ২৪ বছর বয়সী অসীম সাহসী মা। ৩০ বছরের চাকরি জীবনে আমি একদিনও তাকে কোন অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে দেখি নাই। উনি কোনদিন টিউশনি করেন নাই, নিরপেক্ষতা হারাতে পারে এই ভয়ে।

যতদিন পড়িয়েছেন, আমি ঊনাকে সব সময় নতুন নতুন বই পড়তে দেখেছি, নোট নিতে দেখেছি। ছাত্র-ছাত্রীরা ছিল উনার কাছে সন্তান তুল্য। নিজের ক্ষমতার মধ্য যতটুকু পেরেছেন দরিদ্র, মেধাবী ছাত্রদের সাহায্য করেছেন, কখনো বই দিয়ে, কখনো পরীক্ষার ফি মাফ করে, কখনো বা চাকরি পেতে সাহায্য করে।

আজ পর্যন্ত যেখানে যাই ঊনার সাথে, শুধু ছাত্রছাত্রী, সহকর্মীরা না, অজানা মানুষও দুই মিনিটেই ঊনার ভক্ত হয়ে যায়। কিছুদিন আগে আমার ভাইয়ের বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে গেছে, ওই প্রিন্সিপালের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া দেখা করা যায় না, সেই প্রিন্সিপাল ঊনাকে আসার সময় পা ছুঁয়ে সালাম করেছেন।

মনে মনে চিরতরুণ এক মানুষ তিনি। আমাকে সব সময় উপদেশ দেন, জুনিয়রদের সাথে বন্ধুর মতো মেলা মেশা করবে, তুমি বস এটা যেন আচরণে প্রকাশ না পায়, তরুণদের সাথে মিশলে তোমার প্রাণও তরুণ, সতেজ থাকবে। অসম্ভব পরিশ্রমী এবং গোছানো। এখন পর্যন্ত কোন কাজে নিজেকে অক্ষম মনে করেন না, বরং যথাসাধ্য চেষ্টা করেন অন্যদের সাহায্য করতে। ভীষণ আত্মনির্ভরশীল, আমি ঊনাকে কখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখি নাই।

মা হিসাবে মাকে কেমন দেখেছি, সেকথা বলতে গেলে শেষ হবে না, তবে রোল মডেল হিসাবে কি দেখেছি তার কিছুটা বললাম।

গতকাল ১৭ বছরের ওই মেয়েটার কথা শুনে আমার মনে হয়েছে, আমাদের সবাইকে চেষ্টা করতে হবে এক একটা রোল মডেল হতে পরের প্রজন্মের জন্য, আমাদের ছোট  বোন, মেয়ে, ভাগ্নি, ভাতিজি সবার জন্য। আমাদের প্রত্যেকের নিজের জীবনে ব্যক্তিগত সফলতা অর্জনের পাশাপাশি এই পৃথিবীকে, মানবজাতিকে কিছুটা ঋণ পরিশোধের দায়িত্বও আমাদের আছে বৈকি। মেয়েদের ক্ষেত্রে দায়িত্বটা বেশি, কারণ মেয়েরা পিছিয়ে আছে অনেক ক্ষেত্রে, মেয়েদের চোখের সামনে রোল মডেলের অভাব।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.