হ্যাঁ, স্যানিটারি ন্যাপকিনেও আছে নারী স্বাধীনতা!

Napkin 2শামীমা মিতু: এসময় কোনো মেয়ে গাছে উঠলে সে গাছে ফল ধরে না। এসময় রান্নাঘরে ঢুকতে মানা। পুজার ঘরে ঢুকতে মানা, মন্দিরে ঢুকতে মানা, গির্জায় ঢুকতে মানা, নামাজ পড়তে মানা, রোজা রাখা মানা, ধর্ম গ্রন্থ ধরতে মানা। কারণ একটাই তোমার পিরিয়ড চলছে, তুমি অশুদ্ধ, অপবিত্র! অথচ পিরিয়ড নামক যে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াটিকে আজও মানুষ অশুদ্ধ, অপরিচ্ছন্ন মনে করেন, তার কারণেই কিন্তু টিকে আছে এই মানবসভ্যতা।     

কৈশোরে দেখেছি, স্কুলের মেয়েরা পিরিয়ড হওয়া নিয়ে যতটা লজ্জিত থাকতো, ছেলেরা ততোটাই উৎফুল্ল থাকতো। স্কুলের ধর্মের শিক্ষক রোজার মাসে প্রতিদিন মেয়েদেরকেই জিজ্ঞেস করতেন তারা রোজা রেখেছে কিনা, না রাখলে কেন রাখেনি, এই প্রশ্নের উত্তর ছেলেরা খুব উপভোগ করতো, আর মেয়েটি/মেয়েরা তখন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেত।

আমার নিজেরও এমন অবস্থা হয়েছিল।

ছোটবেলা থেকে শেখানো হয় পাপের ফলে পিরিয়ড হয়। অনেক মেয়েকে বলতে শুনেছি কবে এই পাপ থেকে মুক্তি পাবো! আমাকে কেউ বলে দেয়নি, কিন্তু তখন কিছু প্রশ্ন জাগতো। পিরিয়ড হওয়া তো আমার কোন অপরাধ না, আমাকে কেন সারাজীবন এটা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগতে হবে? এটা তো আমার নিজের ইচ্ছায় হয়নি! বরং প্রতি মাসে যেই অবর্ণনীয় কষ্টটা নীরবে সহ্য করছি সেটার জন্য কি চারপাশের মানুষগুলোর থেকে একটু সহমর্মিতা পেতে পারি না?

স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেটটা দোকানদার এমনভাবে খবরের কাগজ, প্লাস্টিকের পরতে মুড়ে দেন যেন অবৈধ কিছু! উপরে আবার একটা দড়ি বা রাবার ব্যান্ড দিয়ে দেওয়া হয়! পুরুষদের কী বলবো, মেয়েরাই তো পিরিয়ড নিয়ে লজ্জায় ভূলুন্ঠিত! এখনও অনেক মেয়ে দোকান থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে পারেন না।

এই রাজধানী্র হোস্টেলেই দেখেছি মেয়েরা দোকান থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে পারেন না বলে আন-হাইজেনিক কাপড় ব্যাবহার করেন। যেখানে পিরিয়ড নিয়ে গর্বিত হওয়া উচিত, আমরা মেয়েরা এমন এক শরীর পেয়েছি যা কোনও জাদুবাক্সের থেকে কম নয়। প্রতিমাসে এই পিরিয়ড হচ্ছে বলেই শরীরের ভিতরে ডিম্বকোষের জন্ম হচ্ছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর! যার কল্যাণেই টিকে আছে মানবসভ্যতা।

পিরিয়ড নিয়ে শুধু এদেশে নয়, সারা পৃথিবার সমাজ ব্যবস্থাতেই অনেক রকম মিথ প্রচলিত। প্রাচীন রোমে, প্লিনি দ্য এল্ডার তাঁর ন্যাচারাল হিস্ট্রি-তে লিখেছিলেন যেসব কুকুর পিরিয়ডের রক্তের স্বাদ পেয়েছে, তারা জলাতঙ্কগ্রস্ত এবং উন্মাদ হয়ে যেত, মাদী ঘোড়ার গর্ভপাত হয়ে যেত এবং শস্যক্ষেতের কাছে ঋতুমতী নারী গেলে নাকি সেই ক্ষেতের সব ফসল নষ্ট হয়ে যেত! ইউরোপে আবার  বিশ্বাস করা হতো, ঋতুমতী নারীরা জ্যাম ছুঁলে তা নষ্ট হয়ে যাবে অথবা ওয়াইনে হাত দিলে তা ভিনিগার হয়ে যাবে!

Mitu
শামীমা মিতু

একবিংশ শতকের আধুনিক সমাজেও ইতালির ওয়াইন তৈরির কারখানায় মেয়েদের কাজ করতে দেয়া হয় না কারণ তাদের পিরিয়ড হয়! ১৯১৯ সালে অধ্যাপক শিক পিরিয়ড নিয়ে পেশ করেছিলেন জনপ্রিয় হয়ে ওঠা বিকারগ্রস্ত এক থিওরি।

তিনি বললেন, ঋতুমতী নারীদের রক্তে নাকি একধরনের বিষ থাকে যাকে মেনোটক্সিন বলে। আর সব রকম খারাপ কাজের জন্যে এটিই দায়ী, সে গোলাপ ফুলের ঝরে পড়াই হোক অথবা সঠিকভাবে ব্রেড বেক না হওয়াই হোক!  

পিরিয়ড নিয়ে ধর্মও কম কুসংস্কারের জন্ম দেয়নি। ছোটবেলায় অধিকাংশ মেয়েকে বোঝানো হয় পিরিয়ড পাপের ফল, তা ওই ধর্ম থেকেই এসেছে। অ্যাডামকে যখন ইভ নিষিদ্ধ গন্ধম খেতে প্ররোচিত করে এবং খাওয়ায় ঈশ্বর তখন রাগান্বিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে গন্ধমের নিষিদ্ধ রসটাকেই ইভের পাপের স্মারকস্বরুপ তার শরীরে দেন, যাতে বংশ পরম্পরায় এ পাপের কথা তারা স্মরণ রাখতে পারে। ফলে ধর্মগ্রন্থে পিরিয়ডকে অপবিত্র শুধু তাই নয় পিরিয়ডের সময় নারীর পুরো শরীরটাকেই অপবিত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পিরিয়ডের সময় স্ত্রী সঙ্গম থেকে বিরত থাকার জন্য কুরআনে নির্দেশ করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে  তো পিরিয়ডের সময় স্ত্রীকে আলাদা ঘরে এক প্রকার বন্দী করে রাখার কথা বলা হয়েছে।

স্পষ্টভাবে শুনে রাখুন, পিরিয়ড হলে মেয়েদের শরীরে কোনো বিষ তৈরি হয় না, ফসল নষ্ট হয় না, জ্যাম নষ্ট হয় না, ওয়াইন ভিনেগার হয় না, দেবতারা অপবিত্র হয় না। ছোটবেলায় পিরিয়ড চলাকালে গাছে উঠতে মানা করতো বলে, চুরি করে বেশি বেশি গাছে উঠতাম। সেগুলোর সবটাতে এখনো ফল ধরে। বাংলাদেশের অন্যতম উঁচু পাহাড় কেওক্রাডং এবং তাজিংডং এর চূড়ায় ওঠার সময় আমার পিরিয়ড চলছিল। তাতে পাহাড় অপবিত্র হয়নি কিংবা সেই অভিশাপে ধ্বসেও পড়েনি।  

বেশ কিছুদিন আগে, রুপা নামের একটি মেয়ে তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিল, ‘পিরিয়ড – বিরক্তিকর একটা জিনিস। একে তো ব্যথা হয়, তার ওপর আবার নোংরা নোংরা ফিলিংস। উফফ — feeling irritated. ব্যাস, জাত গেল জাত গেল, ধর্ম গেল, নৈতিকতা গেল, সব গেল বলে রব উঠলো। কিছু পুরুষ তো পরাক্রমশালী হয়ে গালিগালাজ করে মেয়েটির গুষ্টি উদ্ধারে নেমে পড়লো।

শুধু আমাদের দেশে নয়, লেখিকা রুপী কৌরের বেলাতেও ঘটেছিল এমন ঘটনা। তার মতে, কোনো মেয়ে মা হলে তো সব্বাই খুশিতে গদগদ, অথচ যে রক্তবিন্দু সেই সৃষ্টির আদি, তা নিয়ে কেন সমাজের এত আরোপিত নিষেধাজ্ঞা? ঠিক সেটা প্রমাণ করতেই ইনস্টাগ্রামে কিছু ছবি দিয়েছিলেন। যার কোনোটিতে রাত পোশাকে লেগে আছে পিরিয়ডে রক্তের দাগ। কোনোটিতে রক্তভেজা স্যানিটারি ন্যাপকিন। সেইসব ছবি ইনস্টাগ্রাম সরিয়ে নেয় ‘কমিউনিটি পলিসি’ না মানার কারণে। তাতে অবশ্য দমে যাননি তিনি।

রুপী কৌরের সোজাসাপ্টা বক্তব্য- পিরিয়ডকে অপবিত্র ভাবা হয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তা অচ্ছুত। অথচ এর ফলেই মেয়েরা ধারণ করে নতুন জীবনের বীজ। আমি সেই মূহূর্তটিকেই সেলিব্রেট করছি। নারীর দেহকে পণ্য করে, ভোগ্যবস্তু করে ইনস্টাগ্রামে ছবি পোস্ট করা হলে তা পলিসি ভাঙ্গে না, তাহলে পিরিয়ডের ছবি কেন পলিসি ভাঙবে? এই লিখে তিনি ওইসব ছবি আবার পোস্ট করেন। পরবর্তীতে ইনস্টাগ্রাম অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করেছে, কিন্তু ততদিনে বিভিন্ন মহলে মৌচাকে ঢিল পড়ে যায়।

পুরুষতন্ত্র তো নারীকেই অশ্লীল মনে করে! আর কোনো ট্যাবু ভাঙ্গার প্রসঙ্গ এলে পুরুষের পাশাপাশি বহু নারীও বলে নাক কুচকাতে থাকে। তাদের বক্তব্য- পিরিয়ড নিয়ে এতো হট্টগোলের কি আছে? নারী-পুরুষের যৌনমিলন ব্যাতিত তো সন্তান জন্ম দেয়া সম্ভব না, তাহলে যৌন মিলনের ছবি পোস্ট করলে নিশ্চয় ভুল হবে না, বা উস্কানিমূলক হবে না? স্যানিটারি ন্যাপকিন বা ব্রা ঝুলিয়ে দেয়াতেই কি নারী মুক্তি?

হ্যাঁ, পিরিয়ডের ন্যাপকিন প্রকাশ্যে কিনতে পারার মাঝেও নারী মুক্তি আছে। পিরিয়ড নিয়ে কথা বলতে হতো না, যদি না তাতে মেয়েরা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। গ্রামাঞ্চলে বহু মেয়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে পিরিয়ড সংক্রান্ত জটিলতার কারণে। ট্যাবুর কারণে লুকোছাপা করতে করতে অপরিচ্ছন্নতায় বহু মেয়ে যৌন রোগে ভোগে, মারাও যায়।  শিশুপল্লিতে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দলের একজন সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারের খেলোয়ার জীবন শেষ হয়ে গেছে পিরিয়ড সমস্যায়। মাসে দুই-তিনবার পিরিয়ড হতো তার, কিন্তু লজ্জায়, অসচেতনতায় আর সামাজিক কুসংস্কারের কারণে সেকথা কাউকে তিনি বলতে পারেননি। অনেক অসুস্থ হয়ে যখন জানিয়েছে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।   

নারীত্বের উদযাপনে মেয়েদের সবরকম কুসংস্কারই ঝেড়ে ফেলা দরকার। সমাজ যেসব মেকি বিষয় নারীর উপর চাপিয়ে দিয়েছে তাকে ছুঁড়ে ফেলতে যদি এমন কিছু করতে হয় যাতে মানুষ উত্তেজিত হয়, তাহলে সেটাই করা দরকার। পিরিয়ডের রক্তের দাগ প্রকৃতির উপহার, যন্ত্রণা সহ্য করার শক্তি, গর্ভযন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা, তাই তা সুন্দর।

সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.