
উম্মে ফারহানা মৌ: আমার নানী ভীষণ স্নেহপ্রবণ ছিলেন। পাকিস্তান আর্মিতে তাঁর এক ছেলে চাকরি করতেন, আমার মেজ মামা। যুদ্ধ চলার সময়ে মামার এক সহকর্মী তাঁকে হত্যা করে। আমার নানা-নানী সেইজন্য সেই হত্যাকারীর বিচার দাবি করেননি। তাঁদের কথা হলো, আল্লাহ আখেরাতে বিচার করবেন, আল্লাহর চেয়ে ন্যায়বিচারক আর কেউ নেই।
তো আমার এতো ন্যায়পরায়ণ নানী আমাদের বোনদের ঈদের সালামী দিতেন দশ টাকা, ভাইদের বিশ টাকা। ষোল বছরের মেয়ে পাবে দশ টাকা আর দুই বছরের ছেলে বিশ। নানীর ব্যখ্যা হলো, এটাই আল্লাহর বিধান। আমি নানীর দেওয়া সালামী নিতে কোনদিন অস্বীকার করিনি, কিন্তু একবার ফুপার দেওয়া সালামী (ভাইদের অর্ধেক) নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম। তাতে করে বাসায় খুব শোরগোল পড়ে গিয়েছিল; বলা বাহুল্য, ‘বেয়াদব’ আখ্যা পেয়েছিলাম।
সমাজ বা ধর্মের যেকোন নিয়ম মানতে না চাইলেই যে মানুষ বেয়াদব হয়ে যায় তা কিন্তু নয়। শুধু যে নিয়মগুলো পুরুষদের গুরুত্ব দেওয়া ও তা নিশ্চিত করবার জন্য রাখা হয়েছে সেগুলোর বিরুদ্ধে কথা বললেই ‘গেল গেল’ রব ওঠে।
আমার নানীর জন্ম সম্ভবত ব্রিটিশ আমলে, ফুপার জন্ম পাকিস্তান আমলে নিশ্চয়ই। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মে অনেকেই এমন মান্ধাতার আমলের ধ্যানধারণা পোষণ করে থাকেন দেখে অবাক হই, রাগ, ক্ষোভ কিংবা বিরক্তির চেয়ে বেশি আমাকে গ্রাস করে বিস্ময়।
আমার ফেইসবুক আসক্তি দূর করবার চেষ্টায় আমার স্বামী মজা করে আমাকে ডাকেন ‘ফেইসবুক আপা’। তাঁর উদ্দেশ্য, আমি যেন রেগে গিয়ে ফেইসবুকে সময় অপচয় করা বন্ধ করি। এই ডাক শুনে আমার প্রিয় বন্ধু দোলা বলল, ‘ফেইসবুক আপা না, ফেইসবুক প্রতিবাদী আপা’। এটি হয়ত আরও অপমানকর সম্বোধন। এতে মনে হয় আমি রাস্তায় নেমে আন্দোলন করবার সাহস বা সদিচ্ছার অভাবে ফেইসবুকে গলা ফাটাচ্ছি। কিন্তু নিজের পেজে লেখার ‘অপরাধে’ যেহেতু রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা পর্যন্ত হতে পারে, কাজেই ফেইসবুকে দেওয়া বক্তব্যকে ছোট করে দেখবার সুযোগ নেই। তো, সেই ফেইসবুকের বন্ধুতালিকার দুই একজন উচ্চশিক্ষিত পদস্থ ব্যক্তি আমার লেখা অনেক পোস্টে মন্তব্য দেন যেসব মন্তব্যের সারকথা হলো “নারীবাদী না হয়ে মানবতাবাদী হবার চেষ্টা করা উচিৎ” কিংবা “নারীবাদ যতদিন থাকবে পুরুষবাদও থাকবে”।
একজন সবশেষে জিজ্ঞেস করলেন “what is the difference between feminists and feminazi?” । যিনি বা যারা এইসকল কথা বলেন বা লেখেন তাঁদের কেউ অশিক্ষিত নন, কম শিক্ষিতও নন। তবু তাঁদের সহ্য হয় না আমি আমার নিজের পেজে কোন বঞ্চনা লাঞ্ছনা কিংবা অবিচারের কথা লিখলে।
আমি সাহিত্যের ছাত্রী। আমার খুব প্রিয় শিক্ষক মোহাম্মদ রফিক স্যার একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন যে ইংরেজি বিভাগকে নাকি তিন ভাগে ভাগ করা উচিৎ। ভাষা, সাহিত্য ও তত্ত্ব (ল্যাঙ্গুয়েজ, লিটারেচার আর থিয়োরি)। কারণ জিজ্ঞ্যেস করতেই স্যার রেগে গিয়ে বললেন, “তোমরা তো তত্ত্ব কপচাতে কপচাতে সাহিত্যের রস আস্বাদন করতেই ভুলে গেছ”।
স্যার এত বড় মানুষ যে তাঁর সঙ্গে তর্ক করে আমি বলতে পারিনি যে তত্ত্ব দিয়ে বিচার না করে রস আস্বাদন যে কেউ করতে পারে, সেজন্য সাহিত্যে পড়ালেখা করবার দরকার নেই। আমার এই সকল ফেইসবুক বন্ধুদের মন্তব্য পড়ে আবারো মনে পড়ল স্যারের কথা।
এই তত্ত্ব নামক প্রস্তাবিত শাখাটি বোধ হয় সকল ডিসিপ্লিনেই পড়া বাধ্যতামূলক করা উচিৎ। নয়ত নারীবাদকে পুরুষবিদ্বেষের সঙ্গে আর নারীবিদ্বেষকে মানবতাবাদ বা তথাকথিত হিউম্যানিজমের (যা কিনা ফেমিনিজমের চেয়ে উৎকৃষ্ট বলে তাঁরা ভাবেন) সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা লোকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তেই থাকবে।
যাঁদের মন্তব্যের উদাহরণ দিলাম তাঁরা উচ্চশিক্ষিত, আগেই বলেছি। একজন রিকশাচালক যখন রাস্তা ভাঙ্গা বলে উচ্চস্বরে বলেন “মাইয়া মাইনষে দ্যাশ চালাইলে এইরমই অইব” তখন আমি তা গায়ে মাখি না। কিন্তু একজন সহকারী কমিশনার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যখন আমাকে ফেমিনিস্টের বদলে হিউম্যানিস্ট হতে বলেন তখন বিষয়টি আশংকাজনক বৈকি।
আমি আগে তাঁদের ব্যাখ্যা দিয়েছি, কোন কোন বিষয়ে আমার আপত্তি তাও জানিয়েছি। কিন্তু ঐ যে বলে, ঘুমন্তকে জাগাবার চেষ্টা করা যায়, জেগে জেগে যে ঘুমায় তাঁকে জাগানো অসাধ্য। তাই ক্ষান্ত দিয়েছি।
কেন আমার জাতীয় পরিচয়পত্রে আর ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন ফর্মে স্বামীর নাম থাকবে আর স্বামীর শুধু পাসপোর্ট বাদে আর কোথাও আমার নাম থাকবে না? কেন আমার প্রাক্তন স্বামীর অনুমতি ছাড়া আমি আমার মেয়েকে বিদেশে নিতে পারবো না, যে বাবা খেতে-পরতে দেয় না সে কিসের অধিকারে আমার কন্যার অভিভাবক থাকবেন? কেন আমার বাবা যিনি কন্যা আর পুত্রকে একই স্নেহে লালন করেছেন সেই বাবার সম্পত্তিতে অর্ধেক ভাগ পাব? কেন ধর্ষণের বিচার চাইলেই চরিত্র বিশ্লেষণ করতে হবে? কেন উপার্জনকারী নারীকেও গৃহকর্ম সুচারুভাবে করতে পারতেই হবে? কেন মাতৃত্বকালীন ছুটি চাইতে পারে বলে যোগ্য নারীকেও নিয়োগ দেওয়া হবে না কিছু প্রতিষ্ঠানে? কেনই বা এইসকল অবিচার আর অন্যায় নিয়ে কথা বললেই আমাকে নারীবাদী বলে লেবেল সেঁটে দিয়ে বাঁকা চোখে দেখতে হবে?
আমি মার্ক্সবাদী হলে আপনার আপত্তি নেই, আমি স্টোয়িক বা নিয়তিবাদী হলে আপনার কিছু এসে যায় না, আমি এস্কেপিস্ট বা পলায়নবাদী হলে আপনি আরও খুশি, আমি এক্সপ্রেশনিস্ট, এক্সিবিশনিস্ট, নারসিসিস্ট কিছু হলেই আপনার সমস্যা নেই। শুধু আমি ফেমিনিস্ট বা নারীবাদী হলেই আপনার গায়ে বিছুটির ছোঁয়া লাগে কেন?
তত্ত্ব জানেন না ভাল কথা, জানার চেষ্টা করুন। গুগল করলে অসংখ্য লেখা পাবেন, পড়ে কুলিয়ে উঠতে পারবেন না, তাই সহজে বোঝা যায় এমন একটি লেখার লিংক দিলাম। আপনি নারীবাদী হতে চান না, খুব ভাল কথা, হবেন না। কিন্তু নারীবাদীদের হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়ে তাঁদের ফ্যাসিস্ট প্রমাণ করবার বা তাঁরা মানবতাবাদের বিপক্ষে এমন প্রচারণা চালাবার কোন অধিকার আপনার নেই। আপনার মধ্যে মানবতাবাদ আনুন, মানবতাবাদের চর্চা করুন, নারীকে মানুষ ভাবুন, তাহলে আর নারীবাদী বলে আলাদা কোন দল থাকবার প্রয়োজন পড়বে না।
http://thotkata.net/2014/09/24/%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%b0%e0%a7%87-%e0%a6%85/