রওশন আরা বেগম: একটা মেয়ের একা চলা আমাদের সমাজে অনেক কঠিন একটা কাজ। সেই কঠিন কাজটি কোন কোন মেয়ের করতে হয়। যে পরিবার থেকে বঞ্চনা পায়, সমাজ থেকে অসহযোগিতা ও অবজ্ঞা পায়, স্বামীর থেকে বিতাড়িত হয়, পুরুষের কাছ থেকে ধর্ষণ উপহারটি পায়, সেই নারীর স্থান কোথায় হতে পারে?
এই বঞ্চিত নারীর সংখ্যা আমদের দেশের প্রায় প্রতি ঘরেই আছে। এদের কেউ কেউ আবার অত্যাচারিত ঘর থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে গিয়ে গভীর কোন অন্ধকারে হারিয়ে গেছে, অথবা নিজেই স্বেচ্ছা মরণ বেছে নিয়েছে। এই সব নারীদের একটা আশ্রয়স্থল করার এক অদম্য ইচ্ছা আমার মনে বহুদিন যাবত বাসা বেঁধে আছে। জানি না সেই ইচ্ছা কোনদিন পূর্ণ হবে কি না!
তবে অনলাইন পোর্টাল Womenchapter এর সম্পাদক সুপ্রীতি ধর যেভাবে একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছেন চারপাশের কিছু জন্তুর দ্বারা, তাতে মনে হচ্ছে ঐ সমাজে কোন কিছুই করা সম্ভব নয়। সমাজ আমাদের পাশে নেই, পুরুষের চরম অবজ্ঞার পাত্রী এই নারী। নারীবিহীন কোন সমাজ তৈরীর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে মনে হয়। যে দেশে নারী প্রধান মন্ত্রী, নারী স্পিকার সেই দেশে নারীরা এত নির্যাতিত কেন? এর উত্তর কেউ দেবেন?
আমি জানি এর উত্তর পেতে হলে কোন এক সমাজ বিজ্ঞানীর কাছে যেতে হবে। সাধারণ মানুষের কাছে এর উত্তর নেই। আর নারী নির্যাতনের শেকড় অনেক গভীরে। তাকে উপড়ে ফেলতে হলে নারীর পাশে কিছু বিবেকবান পুরুষের সহযোগিতা প্রয়োজন। এই অবস্থা বেশিদিন চলতে থাকলে নারীরা পোলারাইজ হতে বাধ্য হবে, যা ফলশ্রুতিতে একটা পুরুষ বিরোধী নারী সংগঠন তৈরি হবে। এটা সমাজের জন্য মঙ্গল নয়। একটা মানবিক সমাজ সব সময় নারীবান্ধব হবে, অর্থাৎ নারীর প্রতি সহযোগীমূলক আচরণ দেখাতে সক্ষম।
এই কানাডার কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। গর্ভবতী নারীর গর্ব এখানে এতো বেশী যে শরীরের পরিবর্তনটি ঢাকার প্রয়োজন পড়ে না। এই স্বাভাবিকতা আমাদের সমাজে নেই। এই স্বাভাবিকতাকে অস্বাভাবিক করে নারীকে খারাপ চোখে উপস্থাপন করা হয় পশ্চাৎপদ সমাজে। তাই গর্ভবতী নারীরা কারও সামনে যায় না। গেলেও তার উঁচু পেটটি ঢেকে রাখে, যাতে কেউ বুঝতে না পারে এই নারী গর্ভবতী।
শুধু তাই না গর্ভবতী নারীকে অসুস্থ বলেও চালানো হয়। এটা নারীর জন্য চরম অপমান। তেমনি মিনস্ট্রেশনকে বা মাসিককেও নারীর অসুখ বলেই ধরা হয়। অথচ এটা নারীর দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া একটা স্বাভাবিক ঘটনা। এই সময় তারা অনেক কিছু করতে পারে না বা করতে দেওয়া হয় না। এসবই নারীর স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করে তার স্বাধীন চলার পথকে রুদ্ধ করা হয়েছে।
এই জিনিসগুলো আমাদের পাঠ্যক্রমের আওতায় আনতে হবে ধীরে ধীরে, যাতে অজানা জিনিস নিয়ে অতিভক্তি বা অতিঘৃণা তৈরি না হয়। এক সময় মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ছিল। এটাও ভুল। কারণ কোনো একটা গ্রুপকে প্রাধান্য দেওয়াই বৈষম্য সৃষ্টির প্রথম পদক্ষেপ। তেমনি আজ যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নারীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে একটা বৈষম্যমূলক নির্যাতিত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
যেমন মাকে অতিভক্তির জায়গায় বসিয়ে তাকে আমরা মিস্টিফাই করে ফেলেছি। অথচ মা হওয়া এবং সন্তানের প্রতি তার স্নেহ ভালবাসা এই সবই প্রাকৃ্তিক। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই নারী ও পুরুষতান্ত্রিকতাকে বাদ দিয়ে সবার জন্যে একটা ভারসাম্যমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠায় অনেকদূর এগিয়ে গেছে, অথচ আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি নির্লিপ্ততা নিয়ে।