আমার না বলা গল্প-৯

child-girl-rapeসামিয়া: প্রিয় শৈশব, তোমাকে সেভাবে চিঠি লেখা হয়নি। কত কত সময় পার হয়ে গেল; তুমি আমার শৈশব। কবে তোমাকে ফেলে এসেছি! কিন্তু কেন এখনও এতো বেশি মনে পড়ে? কাঁচা আমের চাটনি, দুরন্তপনা, মায়ের শাড়ি ফ্রকের ওপর পেঁচিয়ে পরে গিন্নী গিন্নী খেলতে খেলতে কখন যে ফুলটাইম গিন্নী বনে গেছি; খেয়ালই করিনি!

আমি এক নারী, সমাজের নিয়মে ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই মেয়ে শিশু হিসেবে বেড়ে উঠতে হয়েছে আমাকে। ছোটবেলায়, বাবা, আর কাকাদের কোলেও একটু বড় হবার পর থেকে মা এর সে কি সাবধানতা! কত সতর্কতা আমাকে নিয়ে! আমার চলাফেরা, খেলার সাথী, প্রাইভেট টিউটর, এমনকি ছোট বেলায় যারা আমাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে, তাদের থেকেও আমাকে আগলে আগলে রাখা।

তবুও আমাদের সমাজেই প্রতি ৫ টি শশুর মধ্যে ৩ জন, কোন না কোনভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। তাই আমিও বাদ পরিনি। কোন এক নির্জন দুপুরে মা যখন সংসারের সব কাজ সেরে ক্লান্ত, বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিয়েছেন। তখনই ঘটল সেই ব্যাপারটা। এবং আমি এক তীব্র আতঙ্ক নিয়ে আবিষ্কার করলাম, আমার আত্মীয়দের একজনই আমার শরীরের দিকে বাড়িয়ে দেয়েছে তার কুৎসিত কালো হাত।

যাকে আমি পরম আপনজন জানতাম, যে বাড়ি এলে আচার আর চাচা চৌধুরীর কমিক বই কিনে দেবার জন্য বায়না করতাম, সেই মানুষটাই আজ চাচা চৌধুরীর দুষ্টু লোকদের মত আমাকে আক্রমণ করলো অতর্কিতে!

আহা; আমাকে বাঁচাতে; সাবু বা চাচা চৌধুরীর মত কেউ যদি এগিয়ে আসতো! কী জানি, কী দৈব বলে,কাছাকাছি কোন এক পরিচিত পায়ের শব্দ শুনে একটু পরেই পিছিয়ে গেল সে। কিন্তু ততোক্ষণে আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম।

বুঝলাম, আমি একটি মেয়ে শিশু বলে আমাকে থাকতে হবে একটা বর্মের ভেতরে। আর মুখ রাখতে হবে বন্ধ। পাছে কেউ জানতে পারে; পাছে নিন্দে হয়। সেদিন রাতে বুকে তীব্র যন্ত্রণা হলো। অস্বস্তি দেখে মা জানতে চাইলেন কি হয়েছে? মাকেও আমি বলতে পারলাম না…কারণ সেই আততায়ী বা আত্মীয় আমাকে সেই ঘটনার পর নানাভাবে, নানা সময় বারণ করেছে আমি যেন কাউকে কিছু না বলি। তাহলে আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। আমাকেই সবাই মন্দ বলবে।

আর এই “মন্দ” হওয়ার ভয়ে আমি নীরব হয়ে রইলাম। আতংক আমাকে ঘিরে রাখল। এর পর আরও কত কত দিন কেটে গেল! আমি আরও বড় হলাম। মা এর হাত ছেড়ে একা হাঁটার চেষ্টা করলাম আর পাঁচ দশ জনের মত…। আর বাসে,পথে, ফুটপাতে এমনকি কো- এডুকেশান শিক্ষা ক্ষেত্রে আমি- আমরা নিপীড়িত হতে থাকলাম। আর চুপ করে থাকতে লাগলাম। সেই নিঃস্তব্ধতা দূর থেকে দূরে ছড়িয়ে যেতে থাকল।

সোনালী রোদ্দুরের মত আমার জীবনেও ভালবাসা এলো এক সময়। কোন এক বিশেষ মুহূর্তে সেই মানুষটার আচরণকেও আমি সেই আততায়ীর মতোই মনে করলাম। আমার অবুঝ মন বা শরীর বিভেদ করতে পারলো না কোন স্পর্শটা ভালবাসার আর কোনটা আক্রমণের! আমি দূরে সরে যেতে থাকলাম।

সময় আরও গড়ালো। পাড়া প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে চাপ আসতে লাগল “মেয়ের যে বয়েস বেড়ে যাচ্ছে, এবার বিয়ে দাও”। মায়ের শাড়ি ফ্রক এর ওপর প্যাঁচিয়ে পরা মেয়েটার পড়া-লেখা রত অবস্থায় তথাকথিত এক সু-পাত্রের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো একদিন। সময় বয়ে যেতে লাগলো। আমার কাছে কোন স্পর্শে ভালবাসা রইল না। একদিন সেইসব ভালবাসাহীন স্পর্শে আমি নিজের মাঝে মাতৃত্ব অনুভব করলাম।

ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো সময়। অথচ, তখনও আমি বাড়ির বাইরে গেলে আমাদের সমাজের মানুষগুলো কথার তীরে আমায় বিদ্ধ করত। শিশু জন্মানোর প্রক্রিয়া নিয়ে নানান উক্তি করতো এক রাস্তা ভরা জনবহুল জনারণ্যে আমি সেই তিরস্কার শুনেও চুপ করে থাকতাম।

অবশেষে সেই দিন এলো; আমার মধ্য দিয়ে আবার আমারই জন্ম হল। আমার সেই ছোট্ট কন্যা শিশুটি ঘুমের মাঝেই মুচকি হাসে। কিন্তু আমার সব আনন্দ বাতাসে মিলিয়ে যায়…আবার আমি ভাবতে থাকি, ওকেও তো চুপ করে থাকতে হবে!! কিন্তু ওকে আমি চুপ করে থাকতে শেখাই না। বলতে শেখাই, প্রতিবাদ করতে শেখাই। আমাদের শৈশবের ঘটে যাওয়া এই দুষ্ট চক্রকে ভাঙ্গতে হবে আমাদেরই। ভাল থেকো শৈশব। ভাল থেকো শৈশবের সব শিশুরা।

নাম ও ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারীর জীবনের ঘটনা অবলম্বনে:

Rj সামিয়া

Cityfm96

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.