তামান্না ইসলাম: অনেক দিন আগের কথা। মাত্র তিন দিন আগে আমি বিদেশে পাড়ি জমিয়েছি। লিফটের দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতেই আমি একদম একা হয়ে গেলাম। এদেশে সব কিছুর নামই উল্টাপাল্টা। লিফটকে বলে এলিভেটর।
আজকে ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে আমার প্রথম মাস্টার্স এর ক্লাস। দেশে শখ করে মাঝে মাঝে শার্ট, প্যান্ট পরতাম, আর আজকে সেই পোশাক পরেই আমার এতো অস্বস্তি হচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে আমাকে একটা কিম্ভুত কিমাকার কিছু মনে হচ্ছে। এপার্টমেন্টে দেড় মাসের বাচ্চাটাকে ওর বাবার কাছে রেখে এসেছি, ওর কথা মনে হতেই দুচোখ ভরে জল এলো। মনের সবটুকু শক্তি জড়ো করে ইউনিভার্সিটিতে আসলাম।
চারিদিকে বসন্তের শোভা, তরুণ-তরুণীদের উচ্ছ্বাস কিছুই আজ আমাকে স্পর্শ করছে না। আবার সেই এলিভেটর। চার তলায় আমার ক্লাস। তবে এইবার এলিভেটরে ঢুকে কান্নার বদলে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। আমার সাথে যে উঠেছে, সে বিশাল আকারের এক কালো মানুষ, ছেলে না মেয়ে বুঝতে পারছি না, সে মিষ্টি করে হাসি দিল। আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম। দেশ থেকে যতগুলো উদ্ভট ধারণা নিয়ে এসেছি, তার মধ্যে একটা হলো হিজড়ারা একটা ভয়ের কিছু। মনে হয় সেই ভয় থেকেই আমি এক কোনায় জড়সড় হয়ে থাকলাম।
পরবর্তী দুবছরে সেই মানুষটি, যার নাম ডরোথি, সেই মেয়েটি ছিল আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। ও এসেছে পিএইচডি করতে। ওর মত জ্ঞানী, সুরসিক এবং সর্বোপরি সুন্দর মনের মানুষ আমি খুব কম দেখেছি জীবনে।
আজ অনেকদিন পরে ডরোথির কথা খুব মনে পড়ছে। কারণ কাকতালীয়ভাবে আমি আমার দুই বন্ধুর স্ট্যাটাসে সেদিন হিজড়াদের নিয়ে কিছু পরস্পরবিরোধী মন্তব্য পড়লাম। এদের দুইজনকেই আমি মানুষ হিসাবে দারুণ শ্রদ্ধা করি। কারো কথাই ফেলে দেওয়ার মত না জানি।
একজনের বক্তব্য ঢাকায় হিজড়াদের অত্যাচার চরম পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সে এতোই অতিষ্ঠ যে পারলে এইবার নিজেই একটা কিছু বিহিত করবে। আরেকজন মানুষের বৈচিত্র্যে বিশ্বাসী, হিজড়াদের জন্য সে মমত্ববোধ করে। আমি দ্বিতীয়জনের কথাগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে থাকি।
আর তারপরই ওদের কিছু সাক্ষাতকার দেখি। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় ওদের সাথে তার কিছু কথোপকথন শুনি। আমি নিজে সরাসরি কোন হিজড়ার সাথে কথা বলিনি কখনো, আসলে বলার সুযোগই হয়নি। কিন্তু শুধুমাত্র সেইসব সাক্ষাতকার দেখে, সেই লেখাটি পড়ে আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।
সমস্ত প্রকৃতির বিরুদ্ধে আমার আত্মা বিদ্রোহ করে উঠে। প্রকৃতির খেয়ালে এইসব মানুষ এভাবে জন্ম নেয়। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই তারা জানে, তারা আলাদা। তাদের কোন বন্ধু নেই, বেড়ে উঠে একা একা। সমস্ত বোধ সত্তা আছে, শুধু নেই নিজে আসলে কি সেই ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা।
তাদের পরিবার-পরিজন তাদেরকে নিয়ে বিব্রত, লজ্জিত। জোর করে এই সব মানুষকে তাদের নিজস্বতাকে ঢেকে অন্য একটা পরিচয় দিতে বাধ্য করে পরিবার, চার পাশের পরিবেশ। কী নিদারুণ সেই একাকীত্ব। তার চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর হলো, অতি অপরিণত বয়সে এদের পরিবার-পরিজন এদেরকে ত্যাগ করে, বা অত্যাচার সইতে না পেরে এরা নিজেরাই ঘর ছাড়ে।
আর তারপর থেকেই অনিশ্চিত জীবন। খাওয়া পরা নাই, মাথা গুঁজার ঠাঁই নাই। আত্মীয় নাই, বন্ধু নাই। কেউ কাজ দিতে চায় না, এমনকি কেউ দুটো কথাও বলতে চায় না। কেউ বা ভুল করে দুটো কথা যদি বলেও ফেলে, ভুল করে ভালোবেসেও ফেলে, তার কোন পরিণতি নাই। সমাজ, পরিবারের ভয়ে কেউ তাদেরকে গ্রহণ করতে পারে না। এইসব মানুষগুলোর বেঁচে থাকার উপায় কি? কি তাদের অপরাধ? একমাত্র নিজের জন্ম ছাড়া।