
লুসিফার লায়লা: আমি এতদিন ধরে জেনেছি আমি খুব সহজ বাংলায় লিখি এবং লিখতে ইচ্ছে রাখি। তার কারণ সহজে নিজের কথাটা পৌঁছে দেয়া। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সব পাঠক আমার তৈরি হয় যাদের সহজ করে বলেও সহজ কথাটা বোঝানো যায় না। আমার ধারণা এরা সহজে কিছু বুঝতে নারাজ। আমার হিজাব সংক্রান্ত লেখাটি তার বড় উদাহরণ।
উম্মে রায়হানা তো আমার এই লেখাকে প্রগতিশীল হবার চেষ্টা বলেই চালাতে চাইলেন! আমি আমার প্রগতিশীলতার জন্যে কোন সাইনবোর্ড চাই না সেটা আগে জেনে নিন। কারণ আমার কাজের সাথে যদি সাইনবোর্ডটি সঙ্গতই না হয়, তবে সেটি কেবল ভেক ধরাই হবে। যে কারণে ফ্যাশনেবল হিজাবিদের ভেকটাও আমার পছন্দ নয়। ভেকটা আমার অপছন্দের।
এবং যেহেতু আমি নিজে অন্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, ঠিক একই কারণে নিজের পছন্দ-অপছন্দকে প্রকাশ করতে ভালবাসি। আপনি আমার লেখা পরে এত সব নারীবাদি কথা বলে যেখানটাতে ইতি টানলেন সেখান থেকেই শুরু করি।
‘যখনই ধর্ষণের কারণ হিসেবে নারীর পোশাককে দোষারোপ করা হবে, তখনই কি আমরা নারী সুলভ সৌন্দর্য বজায় রেখে হিজাব পরে সমাজকে উল্টো প্রশ্ন করতে পারি না- এই দেখ, হিজাব পরেও আমার সৌন্দর্য এতটুকু কমে যায়নি? পোশাক সমস্যা নয় সমস্যা তোমার শিশ্ন সর্বস্য মনন’।
পুরুষের হাত থেকে বাঁচতে পুরুষের চাপিয়ে দেয়া পোশাক অবলম্বন করতে বলছেন কোন কোন নারীবাদী। অবাক হইনি শুধু মনে হয়েছে সাত খণ্ড রামায়ণ পড়ে শেষে সীতা কার বাপ!
আমার পুরো লেখাটায় যে বিশেষ শ্রেণীর কথা বলেছি, তাদের ভেকটাতে আমার আপত্তি। নারীর পোশাকে নয়। নগ্ন চলুক আর আপদামস্তক ঢেকে ঘুরুক, সে নিয়ে আমার সত্যি আপত্তি নেই। আমার আপত্তি সে বিশেষ পোশাকে যেটি একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে উপস্থাপন করবার জন্য ব্যাবহার হচ্ছে, কিন্তু ভেকের ভেতর দিয়ে।
যারা পর্দা মেনে পর্দা করেন, তাদের বিষয়ে আমার আপত্তি নেই একটুও, কারণ সেটা তার বিশ্বাসের জায়গা থেকে তিনি সেটা করেন। কারো অবিশ্বাসের অধিকার আমি যেমন অধিকার মনে করি, তেমনি কারো বিশ্বাসের অধিকারকেও শ্রদ্ধা করি। এটা আমার মানবিক শিক্ষা। সিনেমায় ছোটখাটো কাপড় পরা নায়িকাটি যখন বলে, কাহিনীর প্রয়োজনে নগ্ন হতেও আপত্তি নেই, তারপর তার সিনেমা দেখতে বসে যখন দেখি সে কারণে-অকারণে কাপড় খুলে ফেলছে, সেই মেয়েটিকে যে কারণে আমি ফেইক মনে করি, তেমনি ধর্মের লেবাস পরা ফ্যাশনেবেল হিজাবীদেরও আমি একই মাপকাঠিতে মাপি।
নারীর মুখে একরকম, কাজে অন্যরকম তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা নিয়ে আমি সন্দেহ পোষণ করি। ভেকধারীদের আর যাই হোক, কোনো অর্থেই নিজের সহযাত্রী মানতে আমার অরুচি আছে। আমি ব্যাক্তিগতভাবে হিজাব করা যে কজন সহকর্মীর সাথে কাজ করি তাদের আমি শ্রদ্ধা করি কারন তাদের সেটি করবার পেছনে তাদের বিশ্বাসকে আশ্রয় করে চলেন। আর তাদের এত ঝকমারি অলংকারে সেজে উৎকট রঙ মেখে নিজেদের দ্রষ্টব্য বস্তুতে পরিণত হতে দেখি না। সচেতন নারীর নিজেকে পণ্যে রুপান্তরিত করাকে আমি ঘেন্না করি।
কৌশল আর আপোষের মধ্যে পার্থক্যটা গুলিয়ে ফেলেছেন মুসলিম নারীবাদিদের প্রসঙ্গে। ফ্যাশনেবল হিজাবীদের সাথে কোশলই নারীবাদীর ব্যবধান তাই ঘুচিয়ে দিয়েছেন। কোশলই নারীবাদীরা কি এই রকম জবড়জং অলংকার আর রঙ মেখে সঙ সেজে নারীবাদ ছড়িয়ে বেড়ান?
যদি বেড়ান তবে সেই সব নারীবাদীদের পেছনে দাঁড়িয়ে নারী অধিকারের লড়াইটা আমি লড়তে চাই না। কারণ তাতে আমার নারীত্ব নিয়ে আমি নিজের চোখেই প্রশ্নবিদ্ধ হব। এমন আচরণ জীবনের কোন ক্ষেত্রে স্বজ্ঞানে করতে চাই না, যেখান থেকে নিজেকেই নিজের মুখোমুখি হতে, লজ্জিত হতে হবে। আর কাঠামোকে যদি নিজে বেছে নিয়ে পালন করতে চান নিজের বিচার বুদ্ধিকে বাতিল করে, তখন কাঠামোকে বদলানোর আগে মানসিকতার বদলটা জরুরী বলেই মনে করি।
আমি গত ছয় বছর দেশের বাইরে, তাই জানি না দেশের গ্রাম থেকে পড়তে আসা মেয়েটার পোশাকে কি পরিবর্তন হয়েছে! তবে নিজের পুরোন অভিজ্ঞতাকে ঊল্টে দেখে মনে পড়ছে-যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি আমি। তাই আমাদের বাসায় নানা সময়ে আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে পড়তে আসা ফুফু, বোন,খালাদের দেখেছি যে তারা যেহেতু এত দূর পাড়ি দিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্যে আসতেন। ফলে তাদের নানান সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে পেরিয়ে আসতে হলে মাথায় কাপড়টা বেশ সহায়ক হতো। সেই মাথার কাপড় ধর্মীয় কতটা জানি না, কিন্তু সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝি, সেটা ছিল সামাজিকতা।
উচ্চ শিক্ষার্থে যারা শহরগামী হন তাদের সাথে আমি যে সকল হিজাবীদের কথা উল্লেখ করেছি তাদের কি কোন সম্পর্ক আছে? গ্রাম থেকে যারা আসেন তাদের হিজাবের গায়ে এমন অলংকার আর ঠোঁটে গালে এমন চটকদার রঙ থাকে কি? থাকে কি এমন আঁটসাঁটও পোশাক যেটি তার শরীর সর্বস্বতাকেই মনে করিয়ে দেয়?
বেশ কিছুদিন আগে অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, আমার কাছে যিনি দিদিভাই, ওঁর একটা লেখা পড়েছিলাম কলকাতা শহরে প্রকাশ্যে চুমু খাবার আন্দোলন নিয়ে। লেখাটা আমার কাছে খুব যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে তাই কেবল নয়, মনে হয়েছে সময়ের স্রোতে গা ভাসানোর বিপরীতে কাবেরীদির লেোটি সেই সময়ের মফঃস্বল থেকে পড়তে আসা মেয়েটির রক্ষা কবচ।
সেদিন বাহবাটা এমন করে দিতে পারিনি আজ আপনার নারীবাদী সত্তার সাথে যখন মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে যখন, তখন বলছি। কাবেরীদি নারীবাদী কতটা জানি না, তবে নারীর আদর্শ হবার সমস্ত গুণ তাঁর আছে। আর আমার নারীবাদী সত্তাটি দিয়ে আমি বুঝি নারীবাদের মানে পুরুষ বিদ্বেষ নয়, পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতা। আর এই পুরুষতান্ত্রিক আচরণ কেবল পুরুষই করে না আমাদের সমাজে এবং রাষ্ট্রে, অল্প কিছুদিন আগে থেকে শুরু হওয়া নারী নির্যাতনের ঘটনায় নারী প্রধানমন্ত্রীর নির্বিকার আচরণও আমার কাছে পুরুষতান্ত্রিক।
ইসলাম পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা রকমের এই কথাটা সত্যি কিন্তু এর আকর গ্রন্থ পবিত্র কোরান শরীফ কি নানা জায়গায় নানা রকম? আমি লেখাটি লিখবার আগে কিছু পড়াশোনা করতে হয়েছে। তাই ভেকধারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে আমাকে সঠিক ব্যাখ্যাটি জেনে নিয়ে উল্লেখ করতে হয়েছে।
দুঃখের কথা এই যে ভেক ধারীরা তাদের ভেকটাকে বাঁচাতে আমার লেখাটির মনগড়া ব্যখ্যা দিচ্ছে,গালাগালও। কিন্তু আপনার মত প্রগতিশীল নারীর অপব্যাখ্যায় কেবল মনে হয়েছে আমরা প্রগতিটা যত ভাল বুঝি, আধুনিকতাটা ততোটা বুঝি না।
ধর্মটা এক সময় কেবল রাষ্ট্র পরিচালকদের বাণিজ্য ছিল বলে জানতাম, কিন্তু আজকাল দেখি সেটা এই সব ভেকধারীদেরও বাণিজ্য। এই বাণিজ্য ব্যবস্থায় আপনার সায় থাকুক আমার আপত্তি নেই, খালি আমায় ডাকবেন না। কারণ আমি মানুষের ইমোশানকে বাণিজ্যে পরিণত করবার বিরোধী।
আর মাথায় কাপড় দেবার যে বিদেশী ইতিহাস আপনি টানলেন সেটি পড়তে গিয়ে মনে হলো- এত সহজ করে যে সহজ সত্যটি বোঝাতে চাইলাম আপনি সেটির মনগড়া ব্যাখ্যায় নামলেন যখন, তখন সাধারণ মানুষ আপনার এয়াসেরিয় বা পারসিয়ান উদাহরণ ধরতে পারবেন তো?
তার চেয়ে বরং আমাদের এই প্রাচ্যের ইতিহাসটা একটু ফিরে দেখি। আমাদের এই দিকেও ইসলামের আবির্ভাবের বহু পূর্ব থেকে পর্দা প্রথার প্রচলন ছিল সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোতে। চিকের আড়ালে, মাথার কাপড়ে সে পর্দা ধর্মের নয় বরং আভিজাত্যের ধারক ছিল। কয়েকশ বছর আগের হাতে আঁকা ছবিগুলোতে যে নারীদের আমরা দেখি তারা মাথায় কাপড় দিতেন।
কিন্তু এই যে ইতিহাস আপনার কারণে আবার ফিরে দেখলাম সেটির সাথে আমার লেখার কোন সম্পর্ক নেই একেবারেই। আমি যা বোঝাতে চাইলাম সে আপনি না বুঝে থাকলে বা বুঝতে না চাইলে আমি আপনাকে বাধ্য করবো না। কিংবা আমার আগের লেখাটির এক বিন্দুও পরিবর্তন করবো না। কারণ যা লিখেছি সেটাই আমার মত।
আপনি আপনার মত দিয়েছেন তাতেও আমার আপত্তি নেই, কারণ আমি ভিন্ন রুচির অধিকারকে শ্রদ্ধা করি। আর আমি প্রগতিশীল কতটা আমি জানি না, তবে মনে প্রাণে রোজ কামনা করি আমি যেন আধুনিক মন ও মননের মানুষ হয়ে উঠতে পারি।
সংশ্লিষ্ট লেখাগুলোর লিংক দেয়া হলো:
হিজাব বিরোধিতাই কি প্রগতিশীলতার মাপকাঠি?
হিজাবিদের সেক্স অ্যাপিল কি কেবলই চুলে?