ইভটিজিং, মা থেকে মেয়ে 

Meye 4তামান্না ইসলাম: আমার যখন ৫/৬ বছর বয়স তখন আমার একটা  শখ ছিল ফড়িং ধরা। লাল, নীল নানান রঙের নানান  জাতের ফড়িং ধরে ধরে ম্যাচের বাক্সে ভরে রেখে দিতাম। এই ফড়িং ধরাই আমার একদিন এক ভয়ানক সর্বনাশ ডেকে আনল। বেশ বড় এক ছেলে (বয়স আন্দাজ নাই, সেই বয়সে আমার চাচা মামাদের মত মনে হয়েছিল)  এক বিকালে এসে বলল “খুকি তুমি তো রাজা ফড়িঙের পিছনে অনেক দিন ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছ, আর ধরতে পারছ না, আমার বাসায় চল, আমার কাছে অনেক গুলো আছে। তোমাকে  দিব।”

এক মুহূর্ত না ভেবে আমি তার পিছু পিছু রওয়ানা দিলাম। পাশের বিল্ডিঙের সিঁড়িতে দোতলা যেয়েই আমাকে বলল “তোমার দুল জোড়া তো খুব সুন্দর। আমার বোনের জন্য বানাবো, ওকে একটু ডিজাইনটা দেখাতে চাই। ” একথা বলে সে আমার কান থেকে তড়িঘড়ি করে নতুন বানানো আমার জীবনের প্রথম দুল খুলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেলো। সবই নিমিষের ঘটনা। আজকে পিছনে তাকালে আমি শিউড়ে উঠি ভাবতেই যে কি ভয়ঙ্কর বিপদের হাত থেকে আমি সেদিন বেঁচে গেছি। মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের মেয়েটা আমিও হতে পারতাম সেদিন।

এরও কয়েক বছর পরে আমার মা যে কলেজে পড়াতেন, সেই কলেজের  বাৎসরিক  পিকনিকে যেয়ে সোনারগাঁ বা জয়দেবপুর কোথাও পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। অনেকক্ষন পরে মায়ের  এক ছাত্র আমাকে খুঁজে পায়। সেদিনও  আমি বেঁচে গেছি।
যুগে যুগে আমাদের দেশে মেয়ে শিশুরা কিছু বুঝার আগেই নানা ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতির কোন উন্নতি তো হচ্ছে না। মিডিয়ার কারণে হয়তো আমরা জানছি আগের চেয়ে বেশী, প্রতিবাদের ঝড় উঠছে এই পর্যন্তই। আসল অপরাধীদের শাস্তি তো হচ্ছে না।
মেয়েদেরকে ইভটিজিং ব্যাপারটা বহু যুগ ধরেই আছে। আমার মায়ের মুখে শোনা  গল্প। তিনি তেজস্বিনী মহিলা, বাঙ্গালী মেয়েদের মধ্যে যেটা বিরল গুন। ষাটের দশকে চিটাগাঙের খাস্তগির স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। বাস স্টপের উল্টা দিকে পুলিশদের ট্রেনিং সেন্টার। মেয়েরা বাসের জন্য দাড়িয়ে থাকে, আর সেই পুলিশরা তাদেরকে নানা ভাবে উত্যাক্ত করে। যে দেশে পুলিশদের এই অবস্থা সে দেশে কি আশা করা যায়। আমার কিশোরী মা সেদিন বুঝে গিয়েছিলেন কারো কাছে নালিশ করে, বিচার চেয়ে লাভ হবে না। প্রতিবাদ যা করার নিজেকেই করতে হবে। বাসের সমস্ত মেয়ের কাছ থেকে এক জোড়া করে স্যান্ডেল নিয়ে জুতার  মালা গেঁথে বাসের জানালার এমাথা থেকে ওমাথা টাঙ্গিয়ে দিয়েছিলেন।  তার পর থেকে সেই অসভ্য পুলিশগুলো তাদেরকে উত্যাক্ত করা বন্ধ করে দেয়। ঢাকা ইউনিভারসিটিতেও উনি একবার এক বেয়াদবকে স্যান্ডেল খুলে জনগণের মাঝে শিক্ষা দিয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যক্রমে এই তেজস্বিনী মায়ের মেয়ে হয়ে আমি হয়েছি দারুণ ভিতু। কলোনিতে বড় হওয়ার  সুবাদে দু চারটা কমেন্ট, বা অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হইনি হলফ করে বলতে পারবো না। আমার টেকনিক ছিল কান বন্ধ টেকনিক। আজে বাজে কিছু কথা শুনার সম্ভাবনা থাকলে দ্রুত পায়ে সেসব জায়গা পার হয়ে যাওয়া।  আমার মাকেও কখনো কিছু বলতে পারতাম না, মনে হয় ভাবতাম উল্টো আমাকেই যদি খারাপ ভাবে। তিনি যখন কিছুটা জানতে পারেন আমাকে অনবরত রুখে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়েছেন।
মনে আছে একদিন স্যারের বাসায় একটা অচেনা ফোন আসলো। আমি বাসায় এসে কান্না কাটি, আমি আর একা একা ওই স্যার এর বাসায় যেতে পারবো না। হেঁটে হেঁটে যাই, কেউ যদি কিছু করে। আমার মা আমাকে বললেন “তোমাকে একাই যেতে হবে। কেউ কিছু করবে না। ওরা ভিতু, সামনে আসার সাহস ওদের নাই। আর যদি আসেও তোমাকে  নিজেকেই এখন থেকে এগুলা ফেস করতে হবে।”
কিন্তু আসলেতো  সব মেয়ে  এক রকম সাহসী হয় না। আমার মা যেটা পেরেছেন, তার মেয়ে হয়ে আমি সেটা পারি নাই। এখনো পারি না।  কিছু ব্যাপারে পরিস্থিতি আরও খারাপ রূপ নিয়েছে মনে হয়। আগে ইভটিজিঙ্গের শিকার হত কিশোরী, যুবতীরা। ওড়না, শাড়ী ধরে কেউ টান দিত না। এখন মুখ ছেড়ে, শরীরেও হাত চলে গেছে। আর শুধু কিশোরী, যুবতী না, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশুরা।
দুই তিন বছর আগে দেশে গেছি। আমার মেয়েটা ৭/৮ বছর হবে। পাড়ার দোকানে কি যেন কিনছি, এক ছেলে এসে এমন ভাবে তাকাচ্ছে, আমার মনে হচ্ছিল চোখ দুটো গেলে দেই। সেবারই আমার খুব কাছের এক বন্ধুর মেয়েকে নিয়ে এসেছে আমার সাথে দেখা করতে, আমার মেয়েরই বয়সী। ওর কথা শুনে আমি অবাক। মেয়েকে কোথাও খেলেতে যেতে দেয় না। জামা, কাপড় নিয়ে চিন্তার শেষ নাই। সর্বক্ষণ মা সাথে, আমার ডাক্তার বান্ধবী এই শিশুকন্যার দেখাশোনা করার জন্য পার্ট টাইম জবে চলে গেছে। তবে সুখবর একটাই, অনেক কষ্ট করে তাকে ঢাকার একটি সেরা স্কুলে ভর্তি করতে পেরেছে, স্কুলের নাম মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি। মেয়ের বাবা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবে না মেয়ে বখে যেতে পারে ভেবে, বাংলা মিডিয়ামের মধ্যে এটাকেই বেশ ভালো মনে হচ্ছে। সর্বশেষ  ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার পরে আমি আমার  বান্ধবীকে ফোন করতে চেয়েছি কয়েকবার, পারিনি। যদি কোন ভয়ানক খবর শুনতে হয়। আমার মনে বার বার আমার বান্ধবীর মেয়েটির নিষ্পাপ মুখ ভেসে উঠছে।
আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি, স্তব্ধ হয়ে গেছি যখন  এই জঘন্য অন্যায়ের বিচার না করে বরং ব্যাপারটাকে নানা ভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। হয়তো ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের গুজবও রটেছে, তার মাঝে প্রকৃত সত্যের সাথে কিছু কল্পনার রঙও চড়েছে। কিন্তু একটি শিশু একটি ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন তো হয়েছে, সেটার বিচার কই? সেটা নিয়ে কেন এতো সংশয়? যারা পানি ঘোলা করছেন,  আজ যদি তাদের কারো শিশু কন্যার জীবনে এই দুর্ঘটনাটা  ঘটতো ?
তাদের শিশু কন্যার দেহটিকে এক খণ্ড মাংসের মত দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়ার চেষ্টা করতো কোন কুকুর? এই সব নর পশুদের সাথে সাথে যারা তাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছে, তাদের ও চরম শাস্তি হওয়া উচিত। আপনার ঘরের কন্যা সন্তানটিকে সাহসী হতে শিখান, আত্মরক্ষার কৌশল শিখান, রাখ ঢাকের আর সময় নেই, তাদেরকে সবাধান বানী পৌঁছে দিন। জানিয়ে দিন যে  অনেক পুরুষের মুখোশের আড়ালে একটি জানোয়ার লুকিয়ে থাকে, কে মুখোশ পরে আছে আর কে নেই এটা আলাদা করে বোঝা খুব কঠিন।
কেউ কেউ আদর করে আমাদেরকে বলে ফুল। মধু ভরা ফুল, যেই মধু মৌমাছিকে ডেকে আনে।  আমরা ফুল না, আমরা ফুল বা আহার কোনটাই হতে চাই  না, আমরা খালি মানুষ হিসাবে বাঁচতে চাই, মানুষের মর্যাদা চাই।
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.