তামান্না কদর: হিজড়াদের আমি হিজড়াই বলতে চাই। তৃতীয় লিঙ্গ নয়, অন্য কোনোও নামে নয়। কেননা তাহলে তাকে অসম্মানই করা হবে।কারণ বেশির ভাগ মানুষই প্রথমে হিজড়াদের হীনদৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে, তারপর হয়তো মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে।
আমি জানি না, কীভাবে হলো, আমাকে কেউ কিছু হাতে ধরে শিখিয়ে দেয়নি। আমার শৈশব, তারুণ্য, যৌবনের কোনো বন্ধুর সাথেই আমার মানসিক মিল হয়নি। তারা সকলে যা ভাবতো, বলতো আমি তার বিপরীত। এজন্যে কারও সাথেই উল্লেখযোগ্য ভাব হয়নি, যদিও চিন্তার মিল না থাকার পরও ৪/৫ জন বন্ধু আমার জুটেছিল, যারা আমার মতকে ঘৃণা করতো না।
আমাকে কেউ বলে দেয়নি যে, হিজড়াও মানুষ বা তাদের দেখে আমি ভয়ও পাইনি কোনোদিন। বরং বড়রা বলেছে, তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে। আমি থাকিনি। আমার খুব যন্ত্রণা হতো তাদের দেখে। আমি প্রথম হিজড়া দেখি আমার বয়স যখন ছয় বছর। শিশু হলেও চুপচাপ স্বভাবের, ভাবুক আমিটা ভাবনাতেই ব্যস্ত থাকতাম।
আমার মনে পড়ে এখনো, তখন আমি কী ভাবতাম। দাদাবাড়িতে বেড়াতে গেলে একজন হিজড়া আসে ভিক্ষে করতে, দেখা হয়। সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার নিম্নাঙ্গ দেখার জন্যে। সে দুটো পয়সার জন্যে, ভিক্ষের জন্যে নিম্নাঙ্গ দেখায়। তার চোখে জল। সবাই তাকে এনজয় করে। আমি কিছু দেখি না। বড়দের আড়াল-আবডাল দেখে আঁচ করি।
সে যখন বসে ভাত খাচ্ছিলো, তখন কাপড়ের বাইরে দিয়ে মামা-চাচাদের মতো কিছু একটা দু-পায়ের মাঝখানে বোঝা যাচ্ছিলো। আমি বুঝলাম সে সাজসজ্জায় মেয়ে হলেও পুরোটা মেয়ে সে নয়। আমার খুব কষ্ট হলো! সবাই যখন তাকে নিয়ে মজা করছে, আমার তখন বুক ভাঙছে।
সবাই বলে, আমি শক্ত মনের মানুষ, বাবা বলে সীমার। কিন্ত আমি জানি, অসহায়ের জন্যে আমি কতো পুড়ি! বাচ্চা মেয়েরা-ছেলেরা তাকে চুল ধরে টানছে, কাপড় ধরে টানছে। আমি ওদের ‘না’ করলে তারা দ্বিগুণ উৎসাহে তা করে। বাড়ির বড়দের জানার আগ্রহ কীভাবে তার এমন হলো!
সে কী জবাব দিয়েছে জানি না। কী জবাব আছে?
বাড়ির বড়রা বলেছে, এর ধারে-কাছে না যেতে, এটা অভিশাপ, আমারও হতে পারে। এরা অস্পৃশ্য। এরা নষ্ট-ভ্রষ্ট এইসব। কচি মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে বড়দের এইসব কুসংস্কার। আমি তা মেনেও নিইনি, মনেও নিইনি। ছোটরা সবাই ক্ষেপিয়ে ক্ষেপিয়ে ফিরে গেলো, আমি চুপি চুপি তার পেছন পেছন গিয়ে বললাম-আবার আসবেন, আমি চাল দিব। সে আমার গালে ধরলো আর দু-দিকে তাকালো।
এখন বুঝি, তার হয়তো ভয় হচ্ছিল। এরপর এইটুকু জীবনে অনেকবার তাদের দেখা পেয়েছি কখনও দুর্ব্যবহার তো করিইনি, বরং কথা বলতে চেয়েছি স্বাভাবিক মানুষের মতো। এরপর এদের নিয়ে র্যালী করবার সময়ও দেখেছি এরা অনেক বেশী প্রাণচঞ্চল। সামাজিক কারণে এরা এই কৃত্রিম আচরণগুলো করে। এরা ভিক্ষে করে, সাধ করে নয়। কাজ পেলে এরা খুশি। সামাজিক, স্বীকৃত জীবন এরা আমাদের মতোই যাপন করতে আগ্রহী। আমার ভাবতে অবাক লাগে স্বীকৃতির জন্যে এতে সময় কেনো লাগলো? এরা আমাদের মতোই কোনো নারীপুরুষের যৌথ মিলনের ফসল, এটা আমরা কী করে এতোদিন অস্বীকার করেছিলাম? যে-অধিকার এতোদিন আমরা হরণ করেছি আজ তার সময় হয়েছে কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দেবার।