শাঁখা সিঁদুরের দিব্যি কিংবা আমার ঘর, আমার বেহেশত

FB_IMG_1431803590252
উম্মে ফারহানা মৌ

উম্মে ফারহানা মৌ: লুসিফার লায়লার ‘হিজাবিদের সেক্স আপিল কি কেবল চুলে’ এবং আমার লেখা ‘হিজাব, নিকাব… এবং’ শীর্ষক লেখাদুটির প্রতিক্রিয়া হিসেবে একটি লেখা দেখতে পেলাম যেটির শিরোনামই যথেষ্ট আপত্তিকর, হিজাব বিরোধিতাই কি প্রগতিশীলতার মাপকাঠি?

লেখক ধরে নিয়েছেন লুসিফার লায়লা এবং আমি দুজনেই নিজেকে প্রগতিশীল দেখানোর জন্যে হিজাবের বিরোধিতা করছি এবং না বুঝেই পুরুষতান্ত্রিক ডিভাইড এন্ড রুল কৌশলের শিকার হয়ে হিজাবকারিনীদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছি। আমাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ধর্মের প্রথা নয়, বরং প্রথার চর্চাকারিনী নারী। আসলে আমি/আমরা ‘সহি ইসলাম’ নামক এক অলীক ধারণার ধ্বজাধারী, অর্থাৎ মননে মৌলবাদী।
লায়লা কিভাবে ব্যাখ্যা দেবেন তা শোনার অপেক্ষায় আছি, আমারটা আমি দিচ্ছি।

প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল, এই লেখাটি আমার ব্যক্তিগত ব্লগ ‘সব দেখেশুনে ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার’ এ আমি আমার চিন্তাগুলো লিখে সংরক্ষণ করি। খুব বেশি পাঠক ওই ব্লগ পড়েনি। ব্লগের মূল উদ্দেশ্য লেখা সংরক্ষণ করা, পাঠক পর্যন্ত পৌঁছানো নয়। যা হোক, লুসিফার লায়লার এই লেখা প্রকাশিত হবার পরপর অনেকে তাকে তীক্ষ্ণ কটাক্ষ ও ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন জেনে আমি আমার লেখাটি প্রকাশ করবার প্রয়াস পাই। কারণ আমাকেও ওই লেখার কমেন্ট বক্সে গালাগাল দেখতে হয়েছে। ব্যক্তিগত ব্লগ বলে ডিলিট করতে পেরেছি।

আমার লেখায় হিজাব সংক্রান্ত ব্যখ্যার কোনটিই আমার দেওয়া ব্যখ্যা নয়, যারা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানেন ও তা পালন করবার চেষ্টা করেন তাদের দেওয়া ব্যাখ্যা। মডারেটেড মুসলমানরা কেন হিজাব জরুরি নয় ভাবেন সেটাও লিখেছিলাম, লেখার ইন্ট্রোতে আরেকটা কথা ছিল যা শ্লেষমূলক মনে হতে পারে, ‘হিন্দি ছবির নায়িকারা’ যেরকম বোরখা কার চোখে ধুলো দেবার জন্যে পরে (হালের বাংলা ছবি ‘জিরো ডিগ্রি‘ তেও নায়িকা জয়া আহসান তেমন এক বোরখা ব্যবহার করেছেন)।

মুসলমান বাদে অন্য অনেক ধর্ম বা গোত্রের নারীরাও যে মস্তক আবৃত রাখেন সেটাও উল্লেখ করেছি। কিন্তু মুসলিম পরিচয়ের সঙ্গে হিজাব জড়িত, সেটি তো ভুল নয়। পাশ্চাত্যের পোশাকের সঙ্গে হিজাবের ফিউশন করে ফ্যাশন তৈরি করে কেউ হিজাবকে অপমান করছেন বলেছি বলে কি আমাকে ইসলামিক মৌলবাদী বলে মনে হচ্ছে?

নাকি ইসলাম ধর্মে পুরুষকে দৃষ্টি সংযত রাখতে বলা হয়েছে এই কথার উল্লেখ করেছি বলেই আমি ইসলাম ধর্মের পক্ষের লোক বলে লেবেলড হয়ে গেলাম?
প্রথমত, হিজাবকে অপমান করলে আমার কিছু এসে যায় না, কারণ আমি হিজাব পরি না। এসে যায় ওই মেয়েটির যে গ্রামে থেকে পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পড়ালেখা বা চাকরি চালিয়ে যায়, লেখকের মতে হিজাব/বোরখা যার জন্য ‘অস্ত্র’। যখন একটি মেয়ে নেকাব পরে ভরদুপুরে রূপমহল রেস্ট হাউজে ঢোকে তখন তাকে কেউ আমার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবে না, গুলিয়ে ফেলবে সুতিয়াখালি থেকে রোজ টেম্পোতে করে ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা মহিলা কলেজে পড়তে আসা আমার খালাতো বোনকেই। ওর গ্রামেরই কোন লোক হয়তো স্টেশন রোডে দেখা মেয়েটিকে ও ভেবে নিয়ে কুৎসা রটাতে পারে। ওর অস্ত্র বোরখা,  কিন্তু অস্ত্রের অপব্যবহারকারী অন্য মেয়েটি কিন্তু ওর যুদ্ধটাকেই বানচাল করার ক্ষমতা রাখে। তাই নেকাবের বিরোধিতা করে আমি কিন্তু না বুঝে পুরুষের ডিভাইড এন্ড রুল কৌশলের শিকার হইনি। বরং বুঝে শুনে গ্রামের মেয়েটি, যে যুদ্ধ করে এগিয়ে যাচ্ছে তার পক্ষ অবলম্বন করছি।

Hindu nariআমার হিন্দু পুরুষ সহকর্মী এডমিট কার্ডের সংগে চেহারা মেলাবার জন্য নেকাব খুলতে বলার সাহস পাননি,  আমি তার অসহায়ত্ব দেখে কষ্ট পেয়েছি একথা বলে কি আমি পুরুষতান্ত্রিক হয়ে গেছি?
একজন এসোশিয়েট প্রফেসর শুধুমাত্র পুরুষ এবং হিন্দু হবার ‘দোষে’ প্রথম বর্ষের ছাত্রী, আসলেই সে আমাদের ছাত্রী কিনা যাচাই করতে ভয় পাচ্ছেন বলে রাগে দু:খে আমি যদি সেই কট্টর নিকাবধারিনীকে দুকথা শোনাই, তবে আমি কি ‘শিশ্নসর্বস্ব’ ধ্যানধারণার বাহক? সেই তিন কন্যার জনক ভদ্রলোক নিজের হিন্দু পরিচয় নিয়ে ভীত বলেই আমার রাগ হয়েছিল।

একজন শিক্ষক তার পরীক্ষা হলের ডিউটি ঠিকমত পালন করতে পারছেন না কারন তাতে বিশেষ কোন মহলের রোষানলে পড়ে যেতে পারেন, একজন শিক্ষকের জন্য এর চেয়ে অপমানের আর কি হতে পারে?
দ্বিতীয়ত, ফ্যাশন হিসেবে হিজাব ব্যবহৃত হলে আমি কেন আপত্তি করব যখন ধর্মের প্রথা হিসেবে ব্যবহৃত হলে আমার আপত্তি নেই, লেখক সেই প্রশ্ন তুলেছেন। কার ধর্ম পালনের অধিকারে যদি আমি বিশ্বাস করি,  কারো ফ্যাশন করার অধিকারেও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে, তাই কি?
ধরুন, একটি পুরুষতান্ত্রিক প্রথা হলো বিবাহিত হিন্দু নারীর শাখা সিঁদুর ব্যবহার। আমি কয়েকজন হিন্দু বিবাহিত নারীকে চিনি যারা এটি পরার প্রয়োজন বোধ করেন না। এখন যদি হঠাৎ করে সব ধর্মের সব অবিবাহিত মেয়ে শাখা সিঁদুরকে ফ্যাশন হিসেবে পরতে থাকে, আর বলে যে এটি পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, হিন্দু ধর্মের নারীকে দমনের কৌশলের বিরুদ্ধে আঘাত, তাহলে নারীবাদী তত্ত্ব হিসেবে তা কেমন হবে তা আমি বলতে পারব না, আমি তাত্ত্বিক নই, তবে যেসব মা-মাসি-পিসিরা পবিত্র জ্ঞানে এয়োস্ত্রীর চিহ্ন হিসেবে এই পুরুষতান্ত্রিক প্রথাকে ধারণ করেছেন, সেটি রাতারাতি ফ্যাশনে পরিণত হলে তাদের অনুভূতি আহত হবার সম্ভাবনা আছে( হিন্দু ছাড়াও অনেক নৃ গোষ্ঠীর নারীরাও সিঁদুর পরেন, হিন্দু উল্লেখ করলাম বলে ভাববেন না আমি প্রচ্ছন্ন ইসলামিস্ট, পরোক্ষভাবে হিন্দু ধর্মকে পুরুষবাদী বলে অপমান করার চেষ্টা করছি,হাতের কাছের উদাহরণ হিসেবে বলেছি)

আমি যখন ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’ উপন্যাসটি ক্লাসে পড়াচ্ছিলাম, তখন এক ছাত্রী বলেছিল যে চুল রং করাতো ফ্যাশন, এখানে বর্ণবাদের কী আছে! শ্বেতাঙ্গরা যখন তাদের মতোন সমান সোনালি চুল, নীল চোখ আর সাদা গাত্রবর্ণকে সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে চাপিয়ে দিয়েছিল তখনি কৃষ্ণাঙ্গ পেকোলার মা পলিন তার চুল সোজা করার চেষ্টা করতেন। ফ্যাশন সবসময় নির্দোষ নয়। হাই হিল একটি ফ্যাশন, কিন্তু এটি আসলে, কারও কারও মতে, নারীকে সচ্ছন্দে চলাফেরা করতে না দেওয়ার পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র, এমন কথাও পড়েছি তসলিমা নাসরিনের ‘নির্বাচিত কলাম’ এ। আবার ‘বিলিভ ইট অর নট’ ধরনের লেখায় এও লেখে যে প্রাচীন কালে হাই হিল পুরুষের ব্যবহার্য বস্তু ছিল। এখনও অনেক রকস্টারকে উঁচু হিলওয়ালা জুতো পরতে দেখা যায়, কিন্তু সেগুলো কোনমতেই স্টিলেটো হিলের মতন আনকমফোর্টেবল নয়।

Afhan Rape 2ফ্যাশন নিয়ে আমার আপত্তি কেন থাকবে? আমি নিজে যথেষ্ট ফ্যাশনেবল নই বলে? হিজাব নিয়েই বা কেন থাকবে? নিজে পরি না বলে? ফ্রান্সে যখন কোন মেয়েকে হিজাব পরার দোষে স্কুলে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, তখন আমি নিজে হিজাবধারিনী না হয়েও ওই মেয়েটির পক্ষে।

এই প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’  উপন্যাসের কথা স্মরণ করি। স্বাতীর বোন শাশ্বতী শাঁখা-সিঁদুর কেন পরছে না তা অন্য বোনেরা জানতে চাইলে সে বলেছিল, এসব দাসত্বের চিহ্ন সে রাখতে চায় না, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে সিঁদুর না পরার সিদ্ধান্তটি তার নিজের নয়, তার স্বামীর চাপিয়ে দেওয়া। প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারী হিসেবে স্ত্রীকে শাঁখা না পরতে দিয়ে যখন পুরুষ নিজের প্রভুত্বকে পুন:প্রতিষ্ঠা করে, তখন নারীর জন্য আসলে অর্জন কিছুই নয়।

আবার সিঁদুর-শাঁখাকে ফ্যাশন বানিয়ে ফেলে সনাতন পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতা করতে গিয়ে কারও অনুভূতিকে আহত করাও খুব কাজের কথা নয়। হিজাবকে ফ্যাশনে পরিণত হতে দিলে আমার দেশ বাংলাদেশ যে আসলে একটু একটু করে মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে তাই প্রমাণিত হবে। বিকিনি-হিজাব বিভাজনের ষড়যন্ত্রে পড়ে কিংবা নিজেকে খুব প্রগতিশীল প্রমাণ করতে চেয়ে আমি কিছুই লিখিনি।

আমার মনে হয়েছে ধর্মের চর্চার চেয়ে বেশি জরুরী যখন হয় ধর্মের চিহ্ন, তখন বিষয়টি ভাবনার। ধনীরা জাকাত দেবে না, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বে মজুরি পরিশোধ করা দূরে থাক,মাসের পর মাস কর্মীদের বেতন দেবেনা, ওই দিকে দেওয়ালে মূত্র ত্যাগ ঠেকাতে আরবি হরফ লিখে দেওয়া হবে। পিন আপ পত্রিকা প্রকাশ্যে বিক্রি হবে আর নারীর মাথায় শোভা পাবে সুদৃশ্য হিজাব। তাহলে আমাদের পুরোপুরি ফান্ডামেন্টালিস্ট হতে খুব বেশি দিন লাগবে না।

আর শাঁখা-সিঁদুর না পরলে স্বামীর অমঙ্গল কিংবা স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত জাতীয় বাক্য যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তৈরী করেছে নারীকে আবদ্ধ করবার জন্য, আর এইসকল মগজ ধোলাই পাকাপাকি করবার জন্য ধর্মের দোহাই দিয়েছে সেটুকু বোঝার জন্য অনেক বড় তাত্ত্বিক হওয়ার দরকার পড়ে না। তাই মিডিয়ার পুরুষতান্ত্রিক স্বভাব যখন চলচ্চিত্রের নামে, যে দুটো ছবির নাম আমি এই লেখার শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করেছি, প্রকাশ পায় তখন তা, যে ধর্মের নামই ব্যবহার করুক, সমান ক্ষতিকর।

এখন যদি আমি বলি যে আমি মুসলিম পরিবারে জন্মেছি বলে শুধু ইসলাম ধর্মের সমালোচনা করবো, আর অন্য কোন ধর্মে নারী বিদ্বেষী নিয়ম আমার আলোচ্য নয় তাহলে তো হিন্দু মুসলিম খ্রিষ্টান বৌদ্ধ নির্বিশেষে সকল নারীর জন্য সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়েও কিছু বলা যাবে না। নিজে শরিয়া মোতাবেক ভাইয়ের পাওয়া সম্পত্তির অর্ধেক পাচ্ছি কিনা তাই নিয়েই মাথা ঘামাতে হবে।

বিশেষ কোন ধর্মের বিরোধিতা করাটাও খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয় এটাও সহজে বোঝা যায়। হিজাব বিরোধী হলেই প্রগতিশীল হওয়া যায় কিনা এই প্রশ্ন তুলেছেন লেখক, না তা যায় না। যেকোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরুদ্ধে, বিশেষত ইসলাম ধর্মের বিপক্ষে কথা বললেই হয়ত প্রগতিশীল হওয়া যায়। ইদানিং ইসলামোফোবিয়াও এক ধরনের ফ্যাশন,  যেভাবে হিজাবও পৃথিবীর অন্য কোন অংশে ফ্যাশন হয়ে যাচ্ছে।

শেয়ার করুন: