সারিতা আহমেদ: বলিউড অভিনেতা সালমান খানের শাস্তি , তাঁর ‘বিয়িং হিউম্যান ‘ কাজকর্ম , গায়ক অভিজিতের বিতর্কিত বাইট নিয়ে মিডিয়ায় হেব্বি বাওয়াল হলো।
‘গ্লোরি অফ ডেথ’ অথবা ‘গ্লোরি অফ ফেলিওর’ এই হল মোদ্দা কথা । ১২৫ কোটির মহান দেশে জন্মহারের চেয়ে মৃত্যুহার অনেক পুওর (মানে কম । ভুলেও ‘গরিব’ টরিব ভাব্বেন না )।
তবু মৃত্যু এদেশে বিরাট ‘বিষয়’ ।
বাঁচন্তির ‘পক্ষে’র লোকেরা যে মূহূর্র্তে চেঁচাবে, ‘মদ্যপ ড্রাইভারের ফাঁসি চাই। গরিবের অধিকার বাঁচাও কমিটি গড় । রাস্তা কি বড়লোকের বাপের?’
অমনি, বাঁচন্তির ‘বিপক্ষে’র লোকেরা সওয়াল করবে ‘ ন্যালাগুলো বেকায়দায় ঘুমাবে , গাড়ি এলে সরে যেতে পারবে না , ফিটনেস নেই , কিন্তু দুচার পিস টেঁসে গেলে শালা পাতাখোড়ও ট্যাগ খাবে সুপ্রিম শহিদ !’
কথা হলো, গাড়ি মদ খেয়ে চালানো বেআইনী ঠিকই, ফুটপাতে গাড়ি তুলে দেওয়া আরো বেআইনি। গাড়ির উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকা ও ফুটপাতবাসিকে খুন করা ( হোক না তা অনিচ্ছাকৃত) সওয়ারির অবশ্যই ফাঁসি হওয়া উচিৎ। সব বুঝলাম।
কিন্তু বলুন তো, ফুটপাত জুড়ে শুয়ে থাকা কোন ধারায় আইন সম্মত?
গাড়ির তলায় এসে পড়া লোকজন সব সময় গাড়ির মালিককে টার্গেট করে। রোড অ্যাক্সিডেন্টে যে ক’টা পিস আদমি শাস্তি পায়, সব ড্রাইভার। একটাও পথচারী নয়। ট্রাফিকের সতর্কতা, মোবাইলে সতর্কতা কিছুই পথচারীরা বা পথবাসীরা শুনবেন না।
কেন?
কারণ,
‘যব তক সুরজ চাঁদ রহেগা / রাস্তে পে আপনা ঘর রহেগা !’
আমরা, আম জনতা যেমন খুশি রাস্তাকে ব্যবহার করবো, হাঁটবো ,দৌড়াবো, মদ্যপ অবস্থায় মাপবো, খাবো, হাগবো , মুতবো, শোব, গড়াগড়ি খাবো, কিন্তু কোনো গাড়িওয়ালা যদি নিশানায় বেখেয়ালে এসে যায় তাইলে শালার হিউম্যান রাইটকে এমন যমের দুয়ারে পাঠাবো যে জীবনে লোকে তাকে ‘হিউম্যান’ ডাকবে না, হনুমান ডাকবে!
National Crime Record Bureau অনুযায়ী ২০১৩ সালে গড়ে প্রতিদিন ৩৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে পথ দুর্ঘটনায়। রোজ আহত হচ্ছেন ১২৮৭ জন। এত এত দুর্ঘটনা, এত এত মৃত্যু সব কী স্রেফ ড্রাইভারের দোষ ? বুক ঠুকে বলুক তো ফুটপাতের আম-নাগরিক !
একথা ঠিক যে, বেশীর ভাগই ড্রাইভারের দোষ। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা মানেই যে ড্রাইভার ভিলেন এটা কি খুব সত্য ?
সরকারি খতিয়ান বলছে , ২০১১ সালে ভারতে যত পথ দূর্ঘটনা হয়েছিল তার মধ্যে ২২.৫% ক্ষেত্রে ড্রাইভারের দোষ ছিল না। দোষ ছিল পথচারীর বেপরোয়া মন, যান্ত্রিক গোলোযোগ, খারাপ রাস্তা, খারাপ আবহাওয়া ইত্যাদি অনেক কিছু।
আর এটা তো সত্য, পথ দুর্ঘটনা পথেই ঘটবে। বেডরুমে নিশ্চয় নয়। কাজেই পথের মধ্যে বা ধারে রয়েছেন যিনি, সচেতন থাকাটা তারও আশু কর্তব্য নয় কি? নাকি ঘুমে অচেতন থাকা বা ফুটপাতকেই হকের বিছানা ধরে গড়াগড়ি খাওয়াটা খুব ন্যায়সঙ্গত?
রাস্তা বা ফুটপাথ যেমন বড়লোকের বাপের সম্পত্তি নয়, তেমনি গরিবের গত জন্মদিনেও কোনো চ্যারিটি হোম তাদের সেটা গিফট করেনি ।
কলকাতার বহু ফুটপাতে হাঁটার অবস্থাও নেই।
মধ্যবিত্তের ট্যাক্স দিয়ে বানানো শহরের চলাচলের জায়গা আজ বেআইনিভাবে বেহাত হয়েছে । অন্য এক কলকাতা ঘুমায় সেখানে প্রতিদিন প্রতিরাত। কেন? এই ফুটপাতে হাঁটার অধিকার আমাদের নেই ? মনে রাখবেন, ফুটপাত দিয়ে না হাঁটাও কিন্তু দুর্ঘটনার কারণ। ফুটপাতে ঘর-বাঁধা, পথকে আরও দুর্ঘটনাপ্রবণ বানিয়েছে।
পথে হাঁটা মানুষের ঝুঁকি বাড়ছে, পথের পাশে বসবাসকারীদের জীবন বিপন্ন করছে। এই দখলদারি কি বেআইনি নয় ?
রাস্তা ছাপিয়ে ফুটপাত দখলকারি ঝোপাড়-মহল্লাকে যদি সমর্থন দিতে হয়, তাহলে ফুটপাতে উদ্ধত দাঁড়িয়ে থাকা বেআইনি হকারদের অবস্থানকেও খুলে আম সমর্থন দিতে হবে । এই হকাররাও ত পেটের টানেই ফুটপাতে বসেন । তবে কলকাতার হাতিবাগান , গড়িয়াহাট, নিউ মার্কেট, বড় বাজার অথবা অন্য নানা ছোট শহরগুলোর বেদখল হয়ে যাওয়া ফুটপাত নিয়ে হা-হুতাশ কেন শহুরে মধ্যবিত্তের ?
এবার অনেক বুদ্ধিজীবি হাঁ হাঁ চেঁচাবেন , ফুটপাত কি কেউ শখ করে বেছে নেয় ? গরিবের সাধ আছে সাধ্য নেই । তাইবলে বাঁচার অধিকার নেই ? অ্যাঁ !
না , কথা একদম তা না । খুব সত্য কথা কয়েছেন তেনারা ।
এবার একটু ভাবুন তো, দূর্ঘটনায় পা-হারানো আব্দুল্লা রউফ শেখ তো কাজ করতেন আমেরিকান এক্সপ্রেস বেকারিতে । তাহলে বেকারির কর্মচারিকে কেন বেকারির সামনের ফুটপাতেই রাত গুজরান করতে হয় ? সে দায় তো তারাও এড়াতে পারেন না । রাতে খোলা আকাশের নীচে শুয়ে যাদের প্রান গেল গাড়ির চাকার তলায় তাদের সুরক্ষার দায় অবশ্যই রাষ্ট্রের ছিল। ছিল না কি ?
রোটি কাপড়া আউর মাকান — এই তিন কিন্তু আমাদের মৌলিক অধিকার , সংবিধান সম্মতভাবে।
যে দেশ তার নাগরিকের মাথার উপর ছাদ দিতে পারে না, তার আইনই যদি সেই নাগরিকের মৃত্যুর বিচার চালায় তাকেই বা কতদূর নিরপেক্ষ বলা যায়? প্রশ্ন থেকেই যায়।
প্রশ্ন আরো জমে, যদি সালমান দোষি হন, শাস্তি পান, তাহলে মুম্বাই কর্পোরেশন কি একই দায়ে দুষ্ট নয়?
দায় কি এড়াতে পারে শহরের পৌরপিতা থেকে ৬৮ বছরের স্বাধীন ভারত, স্বয়ং?
আবার এটাও ঠিক , এর আগে বহুবার নানা চাপে পড়ে ফুটপাত বাঁচানো ও দূর্ঘটনা এড়াতে সরকার নানা শহরে বস্তিবাসীদের জন্য নয়া আবাস গড়ে দিয়েছিল , হকারদের জন্য আলাদা হকারস মার্কেটও গড়েছিল ।
কিন্তু কেউ ওই আবাসে থাকেন নি বা ওই ছিমছাম দোকানে পসরা সাজাননি । ভাড়া দিয়েছেন মোটা টাকা আদায়ের জন্য আর নিজেরা ফিরে গেছেন শখের ফুটপাতে । এগুলো দোষের না ? বেআইনি না ?
‘নবান্ন’ নাটকে বিজন ভট্টাচার্য্য বুভুক্ষু মানুষ আর কুকুর এর সহাবস্থান দেখিয়েছিলেন একই ডাস্টবিনের সামনে । ক্ষুধার যন্ত্রনা হয়তো চেহারা পাল্টেছে কিন্তু মানুষ আর কুকুরের ফারাকটা সেদিনও যা ছিল আজও তাই । কিন্তু এই সত্য আমরা মেনে নিতে পারি নি ।
‘পথের পাঁচালী’ হোক , ‘স্লাম ডগ মিলিয়নিয়ার’ হোক , ভারত কিন্তু বিশ্বের বাজারে ‘গরিবি’ বেচেই অস্কার জেতে।
তাই গায়ক অভিজিতের ওই ‘কুত্তা কা মউত’ নামক বিতর্কিত ওয়ান লাইনার নিয়ে যতই বাওয়াল হোক না কেন, আমরা কিন্তু ঘুমিয়ে রয়েছি মহান ভারতের ফুটপাতেই।
সে তুমি যতই ভিভিআইপি হও না কেন ! মোদ্দা কথা হলো, ফুটপাথ সঙ্গমে ভারত আজও বিশ্বে একমবাদ্বিতীয়ম!