উইমেন চ্যাপ্টার (২০ জুন): আকাশ আজও মুখ ভার করে আছে। এরকমই এক আষাঢ়ের দিনে পৃথিবীতে এসেছিলেন তিনি আজ থেকে ১০২ বছর আগে। হয়তো বৃষ্টির মতো এই সমাজকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করবেন এই অভিপ্রায়ে।
সাহিত্য ক্ষেত্রে রবীন্দ্র-নজরুলের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে উজ্জীবিত ও তাঁদের প্রশংসায় ধন্য হয়ে, নারী মুক্তি আন্দোলনে বেগম রোকেয়ার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতার গৌরব নিয়ে এবং দেশবাসীর মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে যিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠেছেন, তিনি আর কেউ নন, সুফিয়া কামাল।
আজ তাঁর জন্মদিনে ঢাক গুড় গুড় আকাশ থাকলেও নেই বৃষ্টির তীব্রতা। ঝাঁঝালো রোদের প্রখরতা কাটিয়ে ধরণী এখনও শান্ত হতে ঢের বাকি। তবে মূলত: যে আবহাওয়াকে বদলে দিতে জন্ম নিয়েছিলেন এই শুভলগ্না নারী, সেই শুভক্ষণ কি আজো এসেছে?
যখন নারীরা ছিলেন গৃহবন্দি, যখন পরিবারে বাংলা ভাষার প্রবেশ এক রকম নিষিদ্ধই ছিলো, তখন একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন বাংলা সাহিত্যাঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র, ভাষা সৈনিক ও সমাজ সংস্কারক বেগম সুফিয়া কামাল।
সেদিন ছিলো ২০ জুন, আষাঢ়ের ১০ তারিখ। রবীন্দ্র-নজরুলের প্রশংসায় ধন্য এই আজীবন লড়াকু নারী জন্ম নেন ১৯১১ সালে, বরিশালের সায়েস্তাবাদে মামার বাড়ীতে। নানার দেওয়া নাম ছিল সুফিয়া খাতুন।
জন্ম বৃত্তান্ত থেকে যা জানা যায়, তাহলো, সুফিয়া কামালের বাবা যখন সাধকদের অনুসরণে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়েন, তখন তাঁর বয়স মাত্র সাত মাস। স্বামীর নিরুদ্দেশ যাত্রা, শ্বশুরবাড়িতে নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ , অনেকের বিরূপ মনোভাব সব মিলিয়ে মা সাবেরা খাতুন অনেকটা বাধ্য হয়ে বাবার বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। সুফিয়া বড় হয়েছেন তাঁর নানার বাড়িতে। ফলে তাঁর শৈশব স্মৃতি পুরোটাই মাতৃকেন্দ্রিক। তাঁর মা’ই শৈশব থেকে তাঁকে বাংলাভাষার শিক্ষা দেন। ১৩ বছর বয়সে সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। মূলত নেহালই তাঁকে লেখাপড়ার জন্য উৎসাহ যোগাতে থাকেন। তাঁর সহায়তায়ই তিনি পড়ালেখা করতে শুরু করেন। স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হন তিনি।
তারপর থেকে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। নতুন এক নক্ষত্রের আভা দেখতে পেলো বাংলা। ১৯২৬ সালে পত্রিকা সওগাত এ তাঁর প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ ছাপা হয়। বসন্ত নিয়ে যেন তাঁর আবেগের কমতি কখনই ছিল না। সারাটি জীবন বসন্ত বন্দনা করে গেছেন। হয়তো বাংলার নারীদের জীবনে চিরবসন্ত ছড়িয়ে দিতেই আবির্ভাব হয়েছিলো তাঁর। তাঁর কবিতা তখন নজরুল-রবীন্দ্রনাথের মতোন দের প্রশংসা কুড়োতে সমর্থ হয়েছিলো।
মাত্র ৭ বছর বয়সে কলকাতায় বেগম রোকেয়ার সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। প্রথম সাক্ষাতেই বেগম রোকেয়া সুফিয়াকে তাঁর স্কুলে ভর্তি করে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তব সমস্যার কারণে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের একেবারে প্রথম যুগের ছাত্রী হবার দুর্লভ সুযোগ হাতের মুঠোয় এসেও পিছলে গিয়েছিল। অনেকের ধারণা, পরিবারের রক্ষণশীলতার কারণেই সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে তাঁর ভর্তির সুযোগ হয়নি। এই সুযোগ না হওয়ার পশ্চাতে শুধু পারিবারিক রক্ষণশীলতা নয়, সে সময়ে কলকাতায় অবস্থানের সমস্যাও বহুলাংশে দায়ী ছিল।
সময়ের বিচারে নেহাল হোসেনের এই পদক্ষেপ সত্যিই যুগান্তকারী ছিল। ১৯৩২ সালে সুফিয়ার জীবনে নেমে আসে বিষাদের ছায়া। স্বামী নেহাল হোসেন দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হন। বোম্বে, মাদ্রাজ, নৈনিতাল ঘুরে ফিরে হাওয়া পরিবর্তন করেও রোগ উপশম না হওয়ায় অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে চলে আসেন শায়েস্তাবাদের বাড়িতে। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ১৯ শে ডিসেম্বর ৬ বছরের একমাত্র কন্যাসন্তান (আমেনা খাতুন দুলু) রেখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
স্বামীর অকাল মৃত্যুতে সুফিয়ার জীবনে নেমে আসে চরম দুর্যোগ ও দুর্ভোগ। এই সময়ে সবকিছু বিবেচনা করে সুফিয়া নিজেই উপার্জনের সিদ্ধান্ত নেন। মূলত এখান থেকেই তাঁর ব্যক্তিজীবন ও সাংগঠনিক কর্মকান্ডে দুর্যোগ মুহূর্তে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সূত্রপাত। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় উপার্জনের উপায়ের প্রশ্নে। কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সার্টিফিকেট তাঁর ছিল না। এরকম দুর্যোগময় দিনে তাঁকে দারুণভাবে সহায়তা করেন কলকাতা কর্পোরেশনের তত্কালীন এডুকেশন অফিসার শ্রীযুক্ত ক্ষিতীশ প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তিনি নিজ উদ্যোগে কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে সুফিয়াকে শিক্ষকতার চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন। পঞ্চাশ টাকা মাইনের এই শিক্ষকতার চাকরি তখন সুফিয়ার জন্যে ছিল পরম পাওয়া। তিন মাসের মধ্যে সুফিয়া নিজ যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে শিক্ষয়িত্রী পদে স্থায়ীভাবে বহাল হন। এ সময় কর্পোরেশনের শিক্ষকদের মধ্যে তিনি পান কবি আব্দুল কাদির, কবি খান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন, কবি জসীমউদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ কবি সাহিত্যিককে।
পুরো ত্রিশের দশকটা ছিল সুফিয়ার জীবনে রীতিমত দুঃস্বপ্নের মতো। এ দুঃসময়ে অভয়, আশ্রয় ও সমবেদনার বাণী নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন এক জ্ঞাতি-ভগ্নি বেগম মরিয়ম মনসুর। সে সময়ে বেগম মনসুর না থাকলে আজকের সুফিয়ার জীবন-ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতো। সমস্ত দুঃখ, দারিদ্র্য ও মানসিক অশান্তির মধ্যে দেশের সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের সান্ত্বনা ও উত্সাহ তাঁকে নতুন প্রেরণায় নতুনভাবে বাঁচতে শেখায়। তাঁদের মধ্যে সাদত আলি আখন্দ, কাজী নজরুল ইসলাম, মাহবুব-উল-আলম ও আবুল ফজল অন্যতম। সাদত আলি আখন্দই সর্বপ্রথম সুফিয়াকে কবি হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেন।
১৯৩৯ সালের ৮ই এপ্রিলে চট্টগ্রামের কামালউদ্দিন খানের সাথে তাঁর পুনঃবিবাহ হয়। বিবাহের পর তিনি সুফিয়া কামাল নামে পরিচিত হলেন। উচ্চশিক্ষিত সুদর্শন কামালউদ্দিন খান ছিলেন অত্যন্ত চিন্তাশীল ব্যক্তি। তিনি কবির কাব্য-প্রতিভার সম্মান করতেন। সুফিয়া কামালের প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল সাধারণভাবে সকলের অগোচরে, অনেকাংশে নেপথ্যে। সাহিত্যরসিক কামালউদ্দিন খান ছাত্রজীবনে কবিতা, প্রবন্ধ লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন। বিয়ের পর তিনি সুফিয়ার কাব্য প্রতিভা বিকাশের প্রতিই বেশি যত্নবান ছিলেন। তিনি কবির লেখা সংরক্ষণ, পান্ডুলিপি তৈরি ইত্যাদি সযত্নে করতেন।
এ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ছেলে শাহেদ কামাল (শামীম), আহমদ কামাল (শোয়েব), সাজেদ কামাল (শাব্বীর) এবং মেয়ে সুলতানা কামাল (লুলু) ও সাঈদা কামাল (টুলু)। শোয়েব ১৯৬৩ সালে ১৩ মে রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৭ সালের ৩রা অক্টোবরে আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে সুফিয়া কামালের দ্বিতীয় স্বামী কামালউদ্দীন খান মারা যান।
সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পরে তিনি চলে আসেন ঢাকায়। ৫২ তে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন সক্রিয়ভাবেই। বাংলার প্রতি এই অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রতিদানও তিনি পেয়েছেন। ৭১ এর মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে মিছিলের নেতৃত্ব দেন তিনি। যদিও মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারেননি।
১৯৯৯ সালে মহাপ্রয়াণের পূর্ব মূহূর্ত পর্যন্ত তিনি সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য কবিতা। একুশ আর একাত্তর তাঁকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়। ৫২ নিয়ে তিনি লিখেন ‘একুশের সংকলন: গ্রন্থপঞ্জি।’ সেটিতে তাঁর একুশ ভিত্তিক ৬৫টি কবিতার উল্লেখ আছে। একাত্তর নিয়ে লিখেন ‘একাত্তুরের ডায়েরি।’ এছাড়াও কাব্যগ্রন্থের মধ্যে সাঁঝের মায়া (১৯৩৮), মায়া কাজল (১৯৫১), মন ও জীবন (১৯৫৭), শান্তি ও প্রার্থনা (১৯৫৮), উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪), দিওয়ান (১৯৬৬), মোর জাদুদের সমাধি পরে (১৯৭২)। কবিতা, গল্পে, স্মৃতিকতার পাশাপাশি ১৯৬৮ সালে তিনি সোভিয়েতের দিনগুলি নামক ভ্রমন কাহিনীও লিখেন।
জীবদ্দশায় পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২), সোভিয়েত লেনিন পদক (১৯৭০), একুশে পদক (১৯৭৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯২) সহ আরো অনেক সম্মাননা ও স্বীকৃতি।
আজ বসন্তপ্রেমী আষাঢ়জন্মা সুফিয়া কামালের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন প্রার্থনা করা ছাড়া আর কি’ই বা দিতে পারি তাঁকে…
তথ্যসূত্র: গুণীজন ওয়েবসাইট