ভাল মা, খারাপ মা…

উম্মে ফারহানা মৌ: ছোটবেলা প্রবাদ শুনেছি মা-Women Riseখালাদের মুখে, “কুসন্তান যদ্যপি হয়, কুমাতা কদাচ নয়”। অর্থাৎ একজন মানুষ, বলা ভাল একজন নারী, মানুষ হিসেবে যেমনই হোক, মা হিসেবে সে ভালই হবে, সন্তানের জন্য সে হবে নিবেদিতপ্রাণ, নিঃস্বার্থ এবং আপোষহীন। সন্তানের কাছে সে আদর্শ।  সে সন্তানকে আদর করলেও ভালর জন্য করবে, শাসন করলে, বকলে মারলেও তা করবে সন্তানের ভালর জন্যেই। এই ব্যাখ্যা আপাত:দৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও এর অন্তর্নিহিত সংকেতটি যথেষ্টই জটিল।

একজন নারীকে মা চরিত্রে বেঁধে ফেলে তার কাছ থেকে সন্তানের জন্য যা কিছু ভাল তা আশা করবার জন্যেই সম্ভবত এইসব প্রবাদের উৎপত্তি হয়েছে। এর ব্যত্যয় বা ব্যতিক্রম সমাজ নিতে পারে না। ধরা যাক, কেউ একজন খুনের আসামী- মায়ের কাছে যদি সন্তানের আক্ষরিক অর্থেই ‘সাত খুন মাফ’ হয়, তবে তো এক খুন নস্যি। তো সেই মা খুনি সন্তানকে আইনের হাতে সোপর্দ করবে নাকি পালাবার পথ করে দেবে? কি করলে সে এই কুসন্তানের সুমাতা হতে পারবে?

সুমাতা আর কুমাতা নিয়ে আমার এত চিন্তার শানে নজুল বলি। আমার প্রথম সন্তানের যখন জন্ম হয়, আমি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিন মাস বয়সী মেয়েকে মায়ের কাছে রেখে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে গেলাম জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেয়ে আর আমার মাঝে প্রায় ১০০ মাইলের/ সাড়ে চার ঘন্টার বাস রাস্তার ব্যবধান। আমার টাকা ছিল না যে বাসা ভাড়া করে কাজের লোক কি গরীব আত্মীয়াকে পুষে, অনেক ওয়ার্কিং মাদার যেমন করে,ক্যাম্পাসের কাছাকাছি বাচ্চাটাকে রাখব।

সাহিত্যের পড়ায় ল্যাব-ট্যাব থাকে না, অল্পবিস্তর ক্লাস যা হয় তা না করলেও পাশ করা যায়, উপস্থিতির নম্বর বাদ যায় তাতে, কিন্তু টিউটোরিয়াল পরীক্ষাগুলো দিতে হয়। তাই আমার কাজ ছিল পরীক্ষা দিয়েই এক দৌড়ে ময়মনসিংহ চলে যাওয়া। তবু আমাকে অসংখ্যবার যে মন্তব্যটি শুনতে হয়েছে তা হল, “তুমি/তুই এত ছোট বাচ্চা রেখে ক্যাম্পাসে এসেছ/এসেছিস? তুমি/তুই তো খুব খারাপ মা!”

আমার মা চাননি আমি মাঝপথে পড়ালেখা ছেড়ে দিই, বাবা মারা যাবার পর তিনি বহু কষ্টে তিন সন্তানের লেখাপড়াটা চালিয়ে গেছেন, বড়খালা তার বাড়িতে থাকতে দিতে রাজি ছিলেন, শর্ত একটাই, আমার মাকেও থাকতে হবে। মায়ের পক্ষে নিজের সংসার ছেড়ে এক-দুই মাসের জন্যে ঢাকায় থাকা সম্ভব ছিল না। সুসন্তান হতে গিয়ে কুমাতা হলাম। বাচ্চাটাকে দূরে রেখে আমি কি করে ঘুমাতাম, নাকি সারারাত জেগে থাকতাম, তা কেউ জানতে চায়নি। আমাকে ‘খারাপ মা’ আখ্যায়িত করেই তারা খালাস।

মেয়ের দুই বছর বয়সের সময় তার বাবা আমাকে তালাকের নোটিস পাঠালেন; কারণের জায়গায় লেখা ছিল, ‘বনিবনা হচ্ছে না বিধায়’।  বাচ্চার খরচ হিসেবে মাসে একটা অংকের টাকা নিয়ম অনুযায়ী তার দেবার কথা। আমি চাইনি, তিনিও দেননি। উল্টো আমার চরিত্র খারাপ প্রমাণ করে বাচ্চার কাস্টডি নিয়ে নেবার হুমকি দিয়েছিলেন। এখন বুঝি, ওটা হুমকিই ছিল, তখন বুঝিনি। তালাকের লজ্জায় বিব্রত ও বাচ্চা পাওয়ায় কৃতজ্ঞ আমি বাচ্চার খোরপোষ না পেয়েই, আর না চেয়েই তালাকনামা রেখে দিলাম।

তখন আম্মা আমাকে যে টাকা দিতেন তার সিংহভাগ খরচ হতো আব্দুল্লাপুর-ময়মনসিংহ বাস ভাড়া দিতে। বাকিটা দিয়ে ডাল-ভাত খেতাম, মাঝে-মধ্যে খেতামও না, বই কেনার পয়সায় টান পড়তো। হলের বান্ধবী রিসনার কাছে তাই চিরকৃতজ্ঞ আমি, ওর বই পড়ে অনেক পরীক্ষা দিয়েছি। পার্টটাইম চাকরিও নিতে পারছিলাম না, টিউশনিও না, কারণ তাহলে দৌড়ে যখন-তখন মেয়েকে দেখে আসতে পারব না।

আমি একটা খারাপ মা, আগে ভাল ছাত্রী ছিলাম, ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তির সময় ফার্স্ট হয়েছিলাম। কিন্তু অনার্স ফাইনাল আর মাস্টার্স পাশ করলাম টেনেটুনে, ক্লাস না করে পাশ করা যায়, ভাল ফল কি আর করা যায়?

না, ভাল মা হবার চেষ্টায় কোন আত্মত্যাগ করিনি। ইয়ার ড্রপ দেইনি, পড়া ছেড়ে দেইনি, বাচ্চার বাপের কাছে দাসখত লিখে দিয়ে সংসার টিকিয়ে বাচ্চাকে ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি চাইল্ড’ হওয়া থেকে বাঁচাতে পারিনি।

কিন্তু আজকে যখন এই কষ্টার্জিত ডিগ্রির জোরে চাকরি করে খাচ্ছি আর বাচ্চার বাপের কাছে হাত না পেতে বাচ্চাকেও খাওয়াচ্ছি, পরাচ্ছি, পড়ালেখাও করাচ্ছি, তখন মনে হয়, আমি যদি ভাল মা হতে গিয়ে সেই সময় পড়ালেখা শেষ না করতাম, আজ কি করে শিশুটিকে বড় করতাম?

আজ, এখন,  আমি কি ভাল মা? নাকি খারাপ মা?

সত্যি কথা হল, পড়ালেখাটা আমি নিজের জন্যেই করেছি, মেয়ের জন্যেও না, মায়ের জন্যেও না। পড়ালেখা না করে মন দিয়ে সংসার করলে, বাচ্চার বাপের-দাদার-দাদির মন যুগিয়ে ‘বনিবনা’ করে চললে আজকে হয়তো ভাল মা, ভাল বউ, ভাল মেয়ের উপাধি পেতাম। কিন্তু আমার নিজের কিছুই থাকত না।

হ্যাঁ, যা করেছি নিজের জন্যে করেছি। সতী লক্ষী বউ হতে পারিনি, ভাল মেয়ে হতে পারিনি, হয়তো ভাল মা-ও হতে পারিনি।

কিন্তু তাতে আর কি এমন আসে যায়? আমিতো প্রথমত আমি, তারপরে কার মেয়ে, কার বোন, কার স্ত্রী আর কার মা। নিজের মাতৃত্বকে সবচাইতে বেশি প্রাধান্য দিতে না পারাটাই মনে হয় খারাপ মায়ের লক্ষণ।

ইদানিং ফেইসবুকে মা দিবস নিয়ে খুব মাতামাতি দেখলাম। সবাই তাদের মায়েদের সংগে ছবি দিচ্ছে, দেখে ভাল লেগেছে, সন্তানেরা মায়ের আত্মত্যাগের মূল্য বুঝতে পেরেছে। নিজের জীবনের সলতে পুড়িয়ে সন্তানের জীবনের প্রদীপ আলোকিত করা নারীদের তাদের সন্তানেরা শ্রদ্ধা আর ভালবাসা জানাবে এটাই তো স্বাভাবিক।

কিন্তু আমি এই দিবসটিকে ভালভাবে নিতে পারিনি। কারণ আমার মেয়ের পাসপোর্ট করতে গিয়ে জানতে পেরেছি যে তার পিতার এনওসি ছাড়া তাকে বিদেশ নিয়ে যাবার অধিকার আমার নেই। ছয় বছরে ছয়বার দেখেনি যে বীর্যদাতা জনককে, সে-ই আমার কন্যার আসল অভিভাবক। তাই মা দিবসের আদিখ্যেতাটুকু আমাকে অকারণ গাত্রদাহের অনুভূতি দিয়েছে।

আর কি বলব, এমনিতেই আমি খারাপ মা!

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.