ফারহানা রহমান: স্কট ফিটসেলাল্ডের বিখ্যাত উপন্যাস ‘দি গ্রেট গ্যাটসবি” আমাকে যার পর নাই অভিভূত করেছিলো। ভালোবাসার এইসব বিস্ময়কর উপাখ্যান নারী-পুরুষের চিরন্তন সম্পর্ক “ প্রেম” নিয়ে আমাকে চিন্তা করতে বাধ্য করেছে সবসময়।
“দি গ্রেট গ্যাটসবি” উপন্যাসটি নিয়ে কথা বলার আগে আরও দু’একটি গল্প-উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
নারী-পুরুষের ভালোবাসার উন্মাদনায় কে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়? ভালোবাসার বাজি ধরে নিঃস্ব হয়ে যাবার পথে এগিয়ে আছে কে? নারী নাকি পুরুষ? সেটা হয়তো হিসেব কষে বলা কঠিন। তবে যুগযুগ ধরে ভালোবাসার খেলায় নারীদের হিসেবী চেহারাটাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। গল্পে উপন্যাসে সেটা আরও বেশী করেই হয়তবা করা হয়েছে।
সেই কবে কিশোরী বয়সে যাযাবরের “দৃষ্টিপাত” পড়েছিলাম আর চারুদত্ত আধারকারের গভীর বেদনায় সহমর্মিতা জানাতে বিশ্বাস করেছিলাম তারই অনুভূতিগুলো, —
“যে নারী, প্রেম তার পক্ষে একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র। আবিষ্কার নয়, যেমন পুরুষের কাছে। মেয়েরা স্বভাবত সাবধানী, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর বাঁধে। ছেলেরা স্বভাবতই বেপরোয়া, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর ভাঙ্গে। প্রেম মেয়েদের কাছে একটা প্রয়োজন, সেটা আটপৌরে শাড়ির মতই নিতান্ত সাধারণ।
তাতে না আছে উল্লাস, না আছে বিস্ময়, না আছে উচ্ছ্বলতা। ছেলেদের পক্ষে প্রেম জীবনের দুর্লভ বিলাস, গরীবের ঘরে ঘরে বেনারসী শাড়ির মতো ঐশ্বর্যময়, যে পায় সে অনেক দাম দিয়েই পায়। তাই প্রেমে পড়ে একমাত্র পুরুষেরাই করতে পারে দুরূহ ত্যাগ এবং দুঃসাধ্য সাধন।
জগতে যুগে যুগে কিং এডওয়ার্ডেরাই করেছে মিসেস সিম্পসনের জন্য রাজ্য বর্জন, প্রিন্সেস এলিজাবেথরা করেনি কোনো জন, স্মিথ বা ম্যাকেঞ্জির জন্য সামান্য ত্যাগ। বিবাহিতা নারীকে ভালোবেসে সর্বদেশে সর্বকালে আজীবন নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছে একাধিক পুরুষ; পরের স্বামীর প্রেমে পড়ে জীবনে কোনদিন কোনো নারী রয়নি চিরকুমারী।
কিন্তু আন্তভ চেখভ এর , “লেট ব্লসমস” এর সেই হতভাগিনী প্রিন্সেস মারুস্যা ? যে তার বাবা স্বর্গত পিতা প্রিন্স প্রিকলনস্কির চিরদাস মজুরের ছেলে ডাক্তার তপকরভের প্রেমে পড়ে ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরতে থাকে আর একটিবার মাত্র ডাক্তারের সান্নিধ্য পাওয়ার যে আকুতি প্রকাশ করে ! তাতে কি প্রমাণ হয় জানিনা। তবে মৃত্যুর পূর্বে রুগী হয়ে ডাক্তারের চেম্বারে গেলে রুগী দেখার পর ডাক্তার জানায় “রুগী দেখা হয়ে গেছে আপনি যেতে পারেন।”
মারুস্যা চেয়ার ছেড়ে উঠলো না। তার জীবনী শক্তির অবশিষ্ট দিয়ে যেটুকু শব্দ হয় তা দিয়েই ফিসফিস করে শুধু এতোটুকুই বলতে পারলো, “ ডাক্তার আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
এসব বাতুলতা বোঝার ক্ষমতা তো ডাক্তারের থাকার কথা না। তাই মারুস্যা আবারও বলল, “ আমি তোমাকে ভালোবাসি । আবারও, “আমি তোমাকে ভালোবাসি ডাক্তার।“
হায়রে প্রিন্সেস!!
ডাক্তার শুধাল, “ আমি কি করতে পারি?”
প্রিন্সেস মারুস্যার তো জীবন বায়ু নিভে গেলো। তাতে ডাক্তারের কি এসে গেলো?
আবারও ফিরে যাই “দৃষ্টিপাতে” ।।
জগতে মূর্খরাই তো জীবনকে করেছে বিচিত্র; সুখে দুখে অনন্ত মিশ্রিত। যুগে যুগে এই নির্বোধ হতভাগ্যের দল ভুল করেছে, ভালোবেসেছে, তারপর সারা জীবনভোর কেঁদেছে। হৃদয়নিংড়ানো অশ্রুধারায় সংসারকে করেছে রসঘন, পৃথিবীকে করেছে কমনীয়। এদের ভুল, ত্রুটি, বুদ্ধিহীনতা নিয়ে কবিরচনা করেছেন কাব্য, সাধক বেঁধেছেন গানচিত্র, ভাষ্কর পাষাণ-খণ্ডে উৎকীর্ণ করেছেন অপূর্ব সুষমা।
তাহলে কি দাঁড়ালো? উপরের প্রত্যেকটি শব্দ শুধুই পুরুষের জন্য প্রযোজ্য? নারীর মনে প্রেমের কি কোন স্থান নেই? নারী শুধুই সাধারণ আর পুরুষ মাত্রই অসাধারণ? জগতে নারীরাই শুধু বুদ্ধিমতি, এরা ভালোবাসে, বিয়ে করার জন্য আর চাকুরী করে ব্যাঙ্কে টাকা জমানোর জন্য, স্যাকরার দোকানে যায় গহনা গরানোর জন্য আর তাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেস্যই কি পুত্র-কন্যা- স্বামী নিয়ে নির্বিঘ্নে জীবন যাপন করবে সচ্ছন্দ সচ্ছলতায়!?
কিন্তু প্রেমিক যে পুরুষ, সে সংসারে রইলো বঞ্চিত হয়ে, হৃদয় নিয়ে করলো ব্যঙ্গ, যে উপহাসের পরিবর্তে নারীকে দিল প্রেম। সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দাহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন বহু কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য পুরুষ।।
তাহলে তো দেখছি পুরুষই সবদিক দিয়ে মহান!
কিন্তু সত্যি কি প্রেম শুধুই পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি? তাই তাদের জীবনকেই শুধু ঐশ্বর্যময় করে তোলে প্রেম আর মহিমা দেয় মৃত্যুকে? আর প্রেমে পড়ে নারীর সব ত্যাগ এমন কি জীবনও বুঝি হিসেব কষার খাতার মতই সাধারণ ও মলিন হয়ে রয় পুরুষের চোখে!! (ক্রমশ)