নখ লুকানো যৌনকাতর গর্বিত পুরুষের দল

Crocodile tearsশারমিন শামস্: এক বিখ্যাত ব্লগার- অ্যাক্টিভিস্ট। মহা উন্নতমনা। তার নিজের দাবি অন্তত তাই। সেদিন দেখলাম সে পোষ্ট দিয়েছে। সিলেটে ব্লগার হত্যার প্রতিবাদে অল্প কয়েকজন ছেলে মিছিল বের করেছে। তার ভাষায় বাকিরা চুড়ি পরে বাসায় বসে আছে। চুড়ি পরে বাসায় থাকা মানে মেয়েদেরকে বোঝানো হচ্ছে। অর্থাৎ বিপ্লব আন্দোলন মিছিল এসব পুরুষালী ব্যাপার। মেয়েদের নয়। অথচ ঘটনা কিন্তু ঘটিয়েছে একটি মেয়েই।

সে পুলিশের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, মিছিলে গিয়েছে, নির্যাতন সয়েছে। তাহলে পুরুষ করলোটা কী? সবসময় কি পুরুষই তবে করে? মতিয়া চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী দিনের পর দিন রাজপথে পড়ে মার খেয়েছেন, লাখ লাখ মেয়ে রাজনীতি করছে, আন্দোলন করছে, মুক্তিযুদ্ধে নারীর সাহসিকতার প্রসঙ্গ আর না টানি।

এদেশে কয়জন পুরুষ জাহানারা ইমাম জন্মেছেন? তবু প্রতিবার, প্রত্যেকটি সময় ভীরুতা, পিছুহটা আর কাপুরুষতার উদাহরণে কেন ফিরে ফিরে আসে নারীর তুলনা? তাও আবার তাদেরই মুখে যারা কিনা বিশাল উদারমনস্ক, অ্যাক্টিভিস্ট, লেখক, প্রতিবাদী প্রগতিশীল বলে দাবি করে নিজেকে?

এদেশে নারীকে প্রতিদিনই নির্যাতন করা হয়। যৌন নির্যাতনও প্রতিদিন চলছে। বাসা থেকে বের হবেন, রিকশাওয়ালা বাসওয়ালা আপনার বুকের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে। আপনাকে অপমান করবে। আপনি উচ্চশিক্ষিত বিশাল চাকরিজীবী? তাতে কিছুই যায় আসে না। আপনার পাশে বসা কলিগ আপনাকে রগরগে কথা বলে ঝালিয়ে নেবে। আপনার বস আপনাকে ডেকে পাঠাবে অযথা। তারপর বুকের দিকে পেটের দিকে হাতের দিকে পায়ের দিকে জুলজুলে চোখ বুলাবে। আপনি জড়োসড়ো হবেন। সেটাও সে উপভোগ করবে।

পুলিশও এর ব্যতিক্রম হবে কীভাবে? এরা তো এদেশের পুরুষ আগে, তারপর পুলিশ। নিম্নাঙ্গের যৌনযন্ত্রণা ঠিকমত নিভাতে না পারার আক্রোশ হয়তো ঝাড়তে হয় তাদের হাতের কাছে একটি সাহসী দুর্বিনীত মেয়েকে পিটিয়ে। পিটাতে পিটাতে হয়তো খিস্তিও করেছে। এ তাদের একঘেয়ে জীবনে এক আদিম আনন্দ। অফিসে এরা মেয়ে কনস্টেবলের গায়ে নানা ছুঁতোয় হাত দেয়, যৌন নিপীড়ন করে। মেয়েগুলি চাকরি বাঁচায়। কিছু বলে না।

Moonmoon“এদেশের পুরুষদের একটি বৃহৎ অংশ নানাভাবে নারী নির্যাতন করে। যৌন নির্যাতন আরো বেশি। এবং তারো চেয়ে বেশি সেইসব পুরুষের সংখ্যা যারা নারী সংবেদনশীল সেজে মুখোশ এঁটে নারীকে নানাভাবে ছোট করে। এরা নারীকে দুর্বল হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। এরা নিজেদের নারী রক্ষক হিসেবে ভাবতে পছন্দ করে এবং তা প্রচার করে। তারা দেখাতে চায়, নারী অসহায়, নাজুক, নরম, তুলতুলে। তাই নারীকে রক্ষা করে যাচ্ছে সে। এবং এর অর্থ সে চরিত্রবান, দারুণ এক পুরুষ”।

তো এরকম একটি সমাজে একটি পুরুষ যখন সত্যিকার অর্থে নারীর ক্ষমতা, শক্তি এবং বুদ্ধিমত্তাকে স্বীকার করতে জানে, যখন সে পুরুষ ও নারীর মধ্যে নিজের ভিতরেই কোন বিভেদ তৈরি করে না, তখন এই সমাজের বাদবাকি পুরুষের চোখে সেই পুরুষও নানাভাবে সমালোচিত ও নির্যতিত হতে থাকে। এটাই বাস্তবতা। এই বঙ্গদেশে নারীকে একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে দেখতে শিখতে গোটা জাতিকে আরো অন্তত দুশো বছর অপেক্ষা করতে হবে।

যেদেশের পুরুষ রাস্তায় লুঙ্গি তুলে হিসু হাগু করে, দুমিনিট পরপর থু থু করে থুতু ফেলে, ভাত রেডি না থাকলে বৌ পিটিয়ে আধমরা করে, নতুন বৌয়ের সাথে মোটর সাইকেল আর ঘড়ি আদায় করে নেয়, তারা নারীকে এই চোখেই দেখবেন এটাই স্বাভাবিক। আর যারা এইসব পুরুষের বংশধারা থেকে এসেছেন, তারা যতই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল, বুয়েট কাঁপিয়ে এসে, রাজনীতি করে, ব্লগ লিখে, সাহিত্য করে, গান গেয়ে, নৃত্য করে ফাটিয়ে ফেলুন না কেনো, তারা ওই ভিতরে ভিতরে শিরায়-উপশিরায় সেই রক্তধারাই বহন করছেন।

রান্নাঘরে বৌকে রাঁধতে পাঠিয়ে এরা ইউটিউবে গান শোনে, আর রান্না দেরি হলে ভিতরের ওই রক্তকনা তাদেরও বৌ পিটাতে সুড়সুড়ি দেয়, কিন্তু পারে না। তবে মাঝে মাঝে পারে। সবসময় তো আর দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়! পুরুষ বলে কথা! তো এই পুরুষ ছাত্রলীগ করে, ছাত্রদল করে,ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র ইউনিয়ন করে। গলা কাঁপিয়ে শ্লোগান দেয়। আর বাসায় ফিরে মা-বোন-বৌয়ের সাথে ক্ষমতা দেখায়।

এরা আড্ডায় বসে মেয়ে বন্ধুদের সাথে। কিন্তু সবসময় এদের ভিতরে এই চিন্তাই কাজ করে, আমি শ্রেষ্ঠ, কারণ আমি পুরুষ। সাথী মেয়েটি বা মেয়েগুলি যতই বুদ্ধিমতি, ব্রিলিয়ান্ট আর জ্ঞানী হোক, পুরুষের মন তা মানে না।  আমি পুরুষ- এই চিন্তা থেকে উদ্ভুত ক্ষমতার দম্ভে কাঁপতে থাকা এদেশের পুরুষের একটি বিশেষ রোগ। ক্ষমতার দম্ভ আর অবদমিত যৌনচিন্তা- এই নিয়েই পথ চলছেন এদেশের কোটি কোটি পুরুষ।

তাই এদেশের কোন পুরুষ নারীদের বন্ধু হতে পারেন, আমি বিশ্বাস করি না। থাকতে পারেন এক আধজন। তারাও মুখে ওই ঠুলি পরেই থাকে অধিকাংশই। তো নারীর বন্ধু নারী নিজেই। নারীর আর কেউ নেই। এই বঙ্গদেশে যৌনকাতর, লোভী ও পুরুতান্ত্রিক প্রতিটি পুরুষকে চিনতে শেখা নারীর জীবনের একটি বিশেষ কাজ। ঘরে বাইরে অফিসে আড্ডায় দোকানে বাসে সবখানে নারীকে আঁচড়ে কামড়ে দিতে উদ্যত নখ লুকানো পুরুষকে দেখামাত্র সতর্ক হয়ে যাওয়া এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নারীর বেঁচে থাকার জন্য।

লেখক- সাংবাদিক

শেয়ার করুন: