উম্মে রায়হানা: নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক বাস্তবতা নিয়ে হইহই রইরই আজকে নতুন নয়। নিষ্ক্রিয়, যৌনবস্তু, অবলা, অলস, অবোধ, কুটিল, স্বার্থপর, পরচর্চাকারী, পরনির্ভরশীল ইত্যাদি নানা বিশেষণ নারীর জন্য সমাজের মধ্যে প্রচলিত আছে। এই সমস্ত ধ্যান-ধারণার বিপরীতে কোন রকম তৎপরতা ক্রিয়াশীল নেই, ব্যপারটা তেমনও না। অল্প হলেও প্রতিবাদ জারি আছে, থাকবে।
পুরুষাধিপত্যের সঙ্গে পুঁজিবাদের সম্পর্কও অনেক পুরানো। এ প্রসঙ্গে মহামতি কার্ল মার্কসের একটি বাণী সর্বদা মনে পড়ে। যথাযথ রেফারেন্স দিতে না পারার জন্য দুঃখিত। মার্কসের কথাটার সারবস্তু অনেকটা এরকম,পুঁজি তার নিজের স্বার্থেই পৃথিবী জুড়ে ভ্রমণ করে, নিজের মত করে পৃথিবীকে বানায়,সাজায়।
মোটকথা, পুঁজির প্রয়োজনে লাগবে না এমন রীতিনীতি ধ্যান-ধারণাগুলো ভেঙ্গে পড়ে, টিকে থাকে সেইসব যেগুলো মুনাফা তৈরিতে কাজে লাগে।
স্বাভাবিকভাবেই পুরুষতন্ত্রও রং পাল্টায়। নারীকে ঘরে আটকে রাখলে বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে শ্রমিক হিসেবে তার মূল্য আছে। সমাজ ভেদে তাকে বের হতে দেওয়া হয়। নারীর শ্রম সস্তা,তাতে মুনাফা বাড়ে এবং নারীকে সস্তা শ্রমিক হিসেবে রেখে দেওয়ার জন্যই তার দ্বিতীয় মাত্রার অবস্থান নিশ্চিত করার দরকার পড়ে। আবার পরবর্তী শ্রমিকদের পৃথিবীতে আনার, লালন-পালনের জন্য তার চিরাচরিত ভূমিকাকেও মহিমান্বিত করে রেখে দেওয়া হয়।
এই কারণে পুঁজিবাদী কর্মকাণ্ডকে অনেক সময় নারীবান্ধব বলেও ভ্রম হয়।
তেমনই এক ছদ্মবেশী নারীবান্ধব কর্পোরেট কর্মকাণ্ড দেখলাম আজ সকালে। এক বন্ধু ফেসবুকে লিংক পাঠালেন একটি বিজ্ঞাপনের।
বিজ্ঞাপনটি বেঙ্গল প্লাস্টিকের। শুরু থেকে দেখলে কোনমতেই বোঝার উপায় নেই এটি কিসের বিজ্ঞাপন।জীবনের নানা ক্ষেত্রে নারীর দ্বিতীয় মাত্রার অবস্থান,বৈষম্য,নিপীড়ন ও শোষণ দেখিয়ে দেওয়া হয় ম্যানিকুইন দিয়ে। ভয়েস ওভারে থাকে নারীকণ্ঠ।
তারপর পর্দায় আবির্ভূত হয় রক্তমাংসের নারী, দেখানো হয় নারীর অগ্রযাত্রা। নারীর মুখ দিয়ে বলানো হয়- আই অ্যাম নট প্লাস্টিক। আই হ্যাভ ফ্রিডম অব চয়েস- ইত্যাদি।
শেষে ভয়েসওভারে একটি পুরুষকণ্ঠ বলে ওঠে, নারীর ইচ্ছাশক্তিকে স্বাগত জানাই।তাই তাদের সঙ্গে বলতে চাই,আই অ্যাম নট জাস্ট প্লাস্টিক, আই অ্যাম মোর, আই অ্যাম বেঙ্গল, আস্থা শতভাগ।
নারী প্লাস্টিক নয়, কিন্তু বেঙ্গলের প্লাস্টিক নারীর মত। মোর দ্যান প্লাস্টিক। তাই তো?
বিজ্ঞাপনটি দেখে অনেকদিন আগের শোনা একটা জোক মনে পড়ল-নাসিরুদ্দিন,বীরবল না গোপাল ভাঁড়ের মনে নাই। কথাটা এরকম- মোসাহেব হাত কচলে কচলে রাজা/বাদশাহকে বলছেন- হুজুর আমাদের মা বাপ, আর আমরা তো সব কুত্তার বাচ্চা।
আর বেশি কিছু বলার ধৈর্য নাই। শুধু বলি- বিজ্ঞাপনের মধ্যে থাকা কর্পোরেট নারীবাদকে প্রতিহত করতে হবে। শত্রুমিত্র চিনে নিতে হবে। এখনই।
পুনশ্চ- অনেকদিন আগে ‘শ্লোগান দিতে গিয়ে’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম। লেখার বিষয়বস্তু ছিল গণজাগরণ মঞ্চের শ্লোগান এবং শ্লোগানে পুরুষাধিপত্যবাদী চিন্তাচেতনার বহিঃপ্রকাশ। প্রতুলের একই গান থেকে আজকের লেখার শিরোনামটি নেওয়া।
প্রতুল তাঁর গানে ‘ভাই’বলতে ‘বন্ধু’ বুঝিয়েছেন। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে নানান লেখায় এই লাইনটিকে শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছি এ জন্য যে, নারীপ্রশ্নে ‘ভাই’ শব্দ ব্যবহার করার বিপক্ষে আমার অবস্থান। কিন্তু এই লেখায় আমিও প্রতুলের মত ভাই বলতে বান্ধব বোঝাতে চাইছি।
নারীর প্রতি অযৌন দৃষ্টিভঙ্গি বোঝাতে ‘বোন’ শব্দের ব্যবহার হয়। নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে দেখার ও আক্রমণাত্মক পুরুষালী মননের বিপরীতে তাকে মা-বোন বানিয়ে ফেলার যে চর্চা প্রচলিত আছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ‘বন্ধু’ শব্দের প্রতিস্থাপক হিসেবে ‘ভাই’ শব্দ ব্যবহারকরা যৌক্তিক কারণেই চলে না।
সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট