তেজস্বিনী মা আমার

সুপ্রীতি ধর:

“তোমাদের মতোন মিয়ারা যুদি উইঠে আসে, তাহলে ভারতবর্ষ উইঠে আসে”, কথাটা খুবই সত্যি, কিন্তু উঠে আসার রাস্তাটা যে এখনও তৈয়ার হয় নাই। খাড়া পাহাড়ে উঠা যে কী জিনিস, “বহুত দম লাগে, বহুত তেজ লাগে”……গতকাল এই কবিতাটা শুনতে শুনতে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলাম বার বার। কী এক অব্যক্ত কষ্ট এই কথাগুলোর সাথে মিশে আছে আমার জীবনেও। এটা উঠে আসার কষ্ট, খাড়া পাহাড় পাড়ি দেয়ার কষ্ট।

একাত্তর-পরবর্তী আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে এই উঠে আসাটা্ অনেক কঠিন ছিল, কোনদিন উঠতে পারবো কিনা, নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু উঠলাম তো!

কীভাবে উঠলাম? শুধুমাত্র মায়ের জন্য।

মা আমার তার সামান্য চাকরির টাকা দিয়ে একটু একটু করে ওপরে ঠেলে দিল, ঠিক যেন বানের জলে ভেসে থাকা সেই শিশুটির মতোন, মা ডুবে ডুবে শিশুটিকে একটি গামলায় করে ঢল পাড়ি দিচ্ছেন। কতদিন যে এই ছবি আমাকে ঘুমের মাঝেও তাড়া করেছে, ঠিক নেই। সবাই তখন সাধুবাদ জানায় মায়েদের। কিন্তু এই মানুষগুলোই জীবনে মাকে ন্যুনতম সম্মানটুকু দেয় না।

এমন একটা সময় ছিল একাত্তরের পরে, যখন মায়ের একটা মাত্র ভালো শাড়ি ছিল। শুনেছি, অফিস শেষে মা তার শাড়িটা (শাড়ি তো নয় পাড় দেয়া সাদা কাপড়) ধুয়ে দিতেন, খুবই শুচিবায়ুগ্রস্ত ছিলেন কিনা, সেই শাড়ি সারারাতে শুকোতো, আবার পরদিন ভোর চারটা না পাঁচটায় সেই শাড়ি পরেই মা রওনা দিতেন চাকরিতে। প্রতিদিন আসতেন, প্রতিদিন যেতেন। আসতেন শুধুমাত্র আমাকে বাসায় রেখে গিয়েছিলেন বলে। মাঠে খেলতে খেলতে দেখতাম, মায়ের রিকশাটা এসে থেমেছে বাসার সামনে। একবার শুধু মাঠের দিকে তাকিয়ে আমার অবস্থান নিশ্চিত করে মা ঢুকে যেতেন বাসায়। বন্ধুরা বলাবলি করতো, তোর মা এসে গেছেরে। সব বন্ধুর মায়েরা যখন দিনভর বাড়িতেই থাকে, আমি তখন ছাড়া ছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়াই এ বাড়ি, ও বাড়ি।

পাশের বাসায় পিসীমা ছিলেন নি:সন্তান। তার কাছে দুধওয়ালা আমাদের দুধটুকু দিয়ে যেত, চাল দেয়া থাকতো। আমি দুপুরে সেই দুধভাত খেতাম পিসীমার বাসায়। আর বিকেলে বাসায় ফিরে মা যখনই খেতে বসতো, আমি সারাগায়ে ধুলোবালি মেখে এসে সামনে বসে যেতাম হা করে। প্রথম খাবারটুকু আমারই খাওয়া চাই কিনা!

সন্ধ্যায় রান্নার তোড়জোড়, আমার পড়তে বসা। মায়ের খবরদারি। গলা নেমে এলেই মা এসে দেখে যেত, পড়ছি কিনা। কতদিন দেখেছে, ঘুমিয়ে পড়েছি। ধমক খেয়ে উঠেবসে কীসব হাবিজাবি পড়তে শুরু করতাম। মা তখন হারিকেনের আলোয় উল-সূতা দিয়ে কিছু না কিছু বানাতো। প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়া আমাকে তুলে খাবার খাইয়ে দিত। ঘুমের মধ্যে খাওয়া আমার মজ্জাগত। অসুখ-বিসুখেও মাকে চাকরিতে যেতে হতো, যখন তাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন, মা তখন দৌড়াতো চাকরিটা ধরে রাখার জন্য। ছোটবেলায় প্রায়ই আমার জ্বর হতো। ভীষণ জ্বর। একবার উঠলে তা ১০৬ এ গিয়ে থেমে থাকতো। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেই মাথায় জল ঢালা থেকে শুরু করে রাতজাগা সবই করতো এই মা।

মায়ের কথা বলে শেষ করা যায় না, এই গল্প অনাদিকাল থেকে চলে আসছে লোকমুখে, আরও চলবে অনেককাল। যতদিন অনুভূতি, ভালবাসাগুলো থাকবে পৃথিবীতে, ততদিন মা থাকবে।

আমি তখন রাশিয়া থেকে দেশে ফিরেছি, সব হারানো আমি, সংসার কোনরকমে টিকে আছে। সবাই যখন বলাবলি করছিল, এখন আর সময় নেই, কোথা থেকে শুরু করবে? এভাবেই চলে যাবে দিন, মেনে নাও। শক্ত মন নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে গেল মা।

জীবনভর ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন করে আসা আমার সেই মা তখন নড়ে-চড়ে বসলো, হাতটা শক্ত করে ধরে বললো, তোকে এখান থেকে বেরুতে হবে, যেভাবেই হোক’। আমি কোন কুলকিনারা পাই না, অথচ আমার মা সব কুল যেন দেখে বসে আছে। আমাকে রীতিমতোন ঠেলে-ঠুলে ঢাকায় এনে বসালো। নিজেও চলে এলো একফাঁকে। আমাকে তুলে ধরার চেষ্টায় লেগে রইলো। আমার কিছু করতে হয় না। মা-ই সব করে দেন, বলে দেন কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে। মা আমাকে প্রতিমূহূর্তে আগলে রাখেন আমার দুই ছেলেমেয়েসহ। আর আমি জীবন খুঁজে বেড়াই। হাতড়ে ফিরি একটু বাঁচার অবলম্বন।

সেই তখন যদি না বেরিয়ে আসতাম, আজ আমি কোথায় থাকতাম, আদৌ বেঁচে থাকতাম কিনা জানি না। মা আমাকে শুধু বাঁচতেই শেখায়নি, কীভাবে প্রতিনিয়ত লড়াই করে, তেজ নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়, তাও শিখিয়ে গেছে। মা বলতো, যেদিকে বৃষ্টি আসে সেদিকেই ছাতা ধরতে হয়। আমি ঠাট্টা করে বলতাম, বৃষ্টি যদি চারপাশ থেকে আসে? মা বলতো, তখন ছাতাটা ঠিক মাথা বরাবর ধরে রাখবি। মাথাটা বেঁচে গেলে সব বেঁচে যায়, আশপাশ তো নশ্বর।

মা আমার কতটা আধুনিক ছিল, সেটা যারাই তাকে দেখেছে, তারাই জানে। একদিন এক ডাকসাইটে আত্মীয় মাকে বললেন, ‘আপনি মেয়েকে মেনে নিলেন কেন? আমি তো আমার মেয়েকে কোনদিনই মেনে নেবো না’। মা শুধু বলেছিল, মেয়েটা আমার, মানবো কি মানবো না, সব আমার ওপরই নির্ভর করবে, আপনি বলার কে! মৃত্যু পর্যন্ত মা আমাকে ছেড়ে যায়নি কোনদিন।

মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে হলে অন্যের ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় দেখে একবার মা দিবসে একটা ফোন কিনে দেই আমি মাকে। মা সারাদিন সেই ফোন হাতে নিয়ে শুয়ে থাকে, আর বলে, ‘এই ছোঁয়া তো সাধারণ ছোঁয়া নয়, এতো তোকেই ছুঁয়ে থাকা’। তার দুই মেয়েই কেবল প্রতিদিন তার খোঁজ নিতো, তাই সে মোবাইল হাতছাড়াই করতো না পারতপক্ষে।

শেষদিকে একেবারে শিশুর মতোন হয়ে যায় মা। আমি না খাওয়ালে মা খায় না, আমি স্নান না করালে করে না। কী মুশকিল হয়ে গেল একেবারে। তারপরও সময় করে প্রতিদিন অফিস শেষে মাকে দেখতে যেতাম। একদিন এক সকালে মা আমাকে সব দায়দায়িত্ব থেকে ছুটি দিয়ে নিজে জীবন থেকে ছুটি নিল। আর আমার মাথার ওপরের হাতটাও সরে গেল সেই থেকে।

তবুও মা, সে আছে, আমার সমস্ত অনুভবে, মা না থাকলে তো আমার নি:শ্বাসই থাকে না, আর তেজ? সে তো বহমান।

শেয়ার করুন: