পহেলা বৈশাখ এবং আমাদের পাপবোধ

Ovi-AUS
নাজিয়া অভি

নাজিয়া অভি: সেদিনও একই আশা নিয়ে পত্রিকা খুলেছিলাম। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবি, আজ হয়তো বাংলাদেশকে নিয়ে খুব ভাল কোন খবর পাবো। হয়তো মনটা ভাল হয়ে যাওয়ার মতোন কোন খবর পাবো। এমনটা খুব একটা হয় না। কালেভদ্রে কিছু ভাল খবর, আর ক্রিকেট নিয়ে উল্লাস ছাড়া।

কিন্তু এই প্রবাসে,  ১লা বৈশাখের দিন বুঝি এই আশাটা একটু হলেও করা যায়। কিছু রঙ্গিন ছবি। কিছু আনন্দে মন কেমন করা ছবি। কোনখানে নিজেকে না পেয়ে দুঃখ পাবার ছবি। তেমন আশা নিয়েই পত্রিকা ঘাঁটতে বসা। কিন্তু খুব বেশি করে জানা প্রায় দৈনন্দিন আটপৌরে সমস্যাটার ভীষণ ভয়াবহ রুপ সব ছিঁড়েখুঁড়ে এমন রঙ্গিন উৎসবের দিনে এভাবে সামনে এসে দাঁড়াবে ভাবিনি।

খুব ছোটবেলা থেকে আমাদের মেয়েদের যেটা সবার আগে শিখে নিতে হয় তাহলো নিজেকে লুকিয়ে ফেলা। তীব্র আপত্তির বা খুব দুর্বিষহ কোন মুহূর্তে এমন ভাব করা যেন সব স্বাভাবিক আছে। আমরা কেমন করে যেন বড় হয়ে উঠার আগেই জেনে যাই, লুকাতে হবে, চেপে গেলেই সব ঠিক থাকবে। অভিনয়টা হতে হবে খুব সুক্ষ্ম আর নিখুঁত ।

এত নগ্ন আর বীভৎসভাবে না হলেও এই অপমান আমাদের দৈনন্দিন একেবারে প্রতিদিনকার। শহুরে মেয়েদের সব থেকে আতঙ্কের জায়গা বুঝি বাস। বাসে দাঁড়িয়ে গেলে এক ধরনের, হয়রানি বসে গেলেও নিস্তার নেই। এই ধরনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়নি এমন কেউ বুঝি নেই। প্রতিদিন বাংলাদেশের প্রতিটা বাসে এই ঘটনাগুলো বিরামহীন ঘটে। কিন্তু খুব একটা প্রতিবাদ হয় কি?

আরেকটা আতঙ্কের জায়গা নিউ মার্কেট বা চাঁদনী চকের সামনের চত্বর। কখনও কেউ কি ভেবে দেখে যে ওই একটা বিশেষ জায়গায় গেলে আমাদের সাথের ব্যাগটায় ৫০ টাকা থাক, কিংবা ৫০ হাজার আমরা কেন সেটাকে অমন যক্ষের ধনের মত বুকের সাথে চেপে ধরে থাকি? তারপরও কি রক্ষা হয়?

একবার আমার ঠিক সামনে এমন একটা ঘটনায় কুঁকড়ে যাওয়া মেয়েটাকে দেখে ওই ভয়ঙ্কর নোংরা লোকটার কলার চেপে ধরে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলাম। আশেপাশের সব নারীদের চোখে আনন্দ থাকলেও একই সাথে দেখেছি অস্বস্তি, খুব খারাপ কিছু প্রকাশ হয়ে যাবার লজ্জা। হয়তো সেই লুকিয়ে ফেলার শিক্ষা থেকেই।

আমাদের দেশে অনেক পরিবারের মেয়েদের কনসার্টে যেতে দেয়া হয় না। মেলায় না। খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে না। মেয়েদের জীবনের শুরু থেকেই অলিখিত নিয়ম ভিড় এড়িয়ে চলা। এই পৃথিবীর যাবতীয় লজ্জা, শঙ্কা, অপরাধ, গ্লানি সব যেন নারীদের। এমন করে অফিস, মার্কেট, রাস্তা, দোকান, বিয়েবাড়ি, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবখানে এমন গ্লানি বয়ে নিয়ে বেড়ানো আমাদের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

আর নিজের ঘরে? নিজের ঘরেও কি মেয়েরা নিরাপদ? কত-শত পরিবারে মেয়েরা দূর কিংবা কাছের সম্পর্কের পুরুষ আত্মীয়ের হাতে দিনের পর দিন অত্যাচারিত হয়েছেন নিরবে, ভয়ে লজ্জায় সংকোচে কাউকে জানাতে পারেননি। সে হিসাব কেউ জানে না, জানাতে নেই। শুধু প্রবল গ্লানি মুছে ফেলতে স্নানের ঘরে অজস্র পানি উপচে ফেলে সব ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করা।

কখনো কেউ জানতে পারেনা সেই অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলো। অবিশ্বাসী হবার ভয়, লজ্জার ভয়, সম্মানহানির ভয় সব মিলে সব চাপা পড়ে যায়। কাউকে বলা যায় না, এমনকি বাবা-মাকেও না।

কিন্তু এই গ্লানি কি আসলে মোছা যায়? শরীরের দাগ হয়তো সময়ের সাথে মুছে যায়, কিন্তু মন? মনের গ্লানি, যন্ত্রণায় একসময় কুঁকড়ে যায় সব। কুঁকড়ে যেতে যেতে একসময় নিজের ভেতরে সব লুকিয়ে ফেলতে হয়। সবার সামনে কেন এই স্বাভাবিক থাকার ভাণ করা?

ওই যে আমরা লুকিয়ে ফেলতে শিখেছি, খুব ছোটবেলা থেকেই কেমন করে যেন আমাদের মাঝে গেঁথে দেয়া হয়, শরীরটাকে সামলে রাখতে হবে। অবাঞ্ছিত বা অনাকাঙ্খিত সব কিছু লুকিয়ে ফেলতে হবে। তা না হলে সে দাগ শুধু তোমাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে। এর দায় আর কারও নয়, শুধু তোমার।

গ্লানির শুরুটা আমাদের এতো ছোটবেলা থেকে শুরু হয়ে যায় যে, প্রথম কিছু সময় প্রবল লজ্জায় কেঁদে যাওয়া, দুবেলা উপোস, মন খারাপ করা নির্ঘুম কিছু রাত। ধীরে ধীরে আমাদের মেয়েদের সয়ে নিতে হয়। বেঁচে থাকতে হলে সইতে হবেই। নইলে সমাজ তোমাকে সইবে না। তুমি সবার চোখে প্রশ্নবোধক হয়ে উঠবে হয়তো একঘরে।

আসলে এই বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানে জন্মটাই আমাদের আজন্ম পাপ। কিন্তু কেন?কই পুরুষদের তো কোন বিধি নিষেধ নেই। আজ পর্যন্ত আমার জানামতে এমন কোন ঘটনা নেই যেখানে কোন পুরুষ এমনভাবে জনসম্মুখে নারীর দ্বারা লজ্জিত হয়েছেন বা অপমানিত হয়েছেন। তাহলে কেন সব আমাদের সইতে হয়? নারীদের মধ্যে যদি এত স্পষ্ট করে ঢুকিয়ে দেয়া যায় সব আড়াল করতে আর লুকাতে, তাহলে সেই একই সমাজ চাইলেই পারে পুরুষদের মাঝেও নারীদের প্রতি সম্মান ব্যাপারটা ঢুকিয়ে দিতে।

আমরা যখন গর্ব করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি, তখন ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর কয়েক লাখ মা-বোনের ইজ্জত/সম্ভ্রম/আব্রুর বিনিময় পাওয়া স্বাধীনতা বলি, এই ইজ্জত সম্ভ্রম আব্রু প্রতিটি শব্দের মধ্যে কিন্তু ওই শরীরের শুদ্ধতার বিষয়টা প্রকট। যে অমানুষিক শারীরিক আর মানসিক  কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিনের পর দিন তারা দেশের জন্য যুদ্ধ করে গেছেন, তারপরও আমরা তাদের মুক্তিযোদ্ধা বলিনা। বলি বীরাঙ্গনা। এই একটা শব্দই তীব্র চিৎকারে আর সশব্দে জানিয়ে দেয়, তাঁদের কি বিসর্জন হয়েছে আর নিজের অনিচ্ছায় সেটা রক্ষা করতে না পারায় তখন তারা ভিন্ন গোত্রের, একটা প্রশ্নবোধক মাত্র!

সেসময় কত অসহায় নারী এই অত্যাচারের ভার সইতে না পেরে নিজেদের শেষ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন, কত নারী ঘর ছাড়া হয়েছেন, কত নারী পুনর্বাসিত হয়েছেন!

আমাদের দেশে শরীর বিষয়টা এতোটাই গোপন, এই বিষয় জানাটা এতোটাই নিষিদ্ধ যে, কিছুটা নিষিদ্ধ আগ্রহ থেকেও হয়তো এই অসুস্থ মানসিকতার জন্ম। আমাদের পরিবার থেকে আমরা যদি সঠিক সময় সঠিকভাবে আমাদের সন্তানদের সামনে বিষয়গুলো তুলে ধরতে পারি, তাদের বুঝিয়ে দিতে পারি হয়তো কিছুটা পরিবর্তন হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোকেও সপ্রতিভ হতে হবে।

বুদ্ধিমত্তায়, কাজে কৌশলে কোনখানে নারী কোন অংশে কম নয় এই কথাটা শুধু মুখে না বলে ভিতর থেকে অনুভব করা জরুরি। আর এই জরুরি পরিবর্তন আনতে সময়ের প্রয়োজন।

আমার সন্তান ছেলে, তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এই ক্ষেত্রে আমার দায়িত্ব বেড়ে গেছে অনেক বেশি। আমার সন্তান যদি আমারই লিঙ্গের আরেকজনকে সত্যি করে সম্মান দিতে না শিখে, সে লজ্জা আমার।

ঈশ্বরের কাছে সবসময় প্রার্থনা থাকবে আমার সন্তান যেন চুরি করে আনতে শিখে। হ্যাঁ সে যেন চুরি করে আনে তার নারীর জন্য ভালবাসার রঙ, ফাগুনের নতুন পলাশ কিংবা বাদলের প্রথম কদম ফুল। যেন শিখিয়ে দিতে পারি, ভালবেসে আলতো করে কীভাবে হাতে হাত রাখা যায়। যেন শিখিয়ে দিতে পারি, প্রতিটি মেয়েকে কি করে সম্মান করতে হয়। পারবো কিনা জানি না।

যদি সত্যি সবাই মিলে পেরে যাই সেদিন থেকে আর বলতে হবে না, ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’। সেদিন গেয়ে উঠবো –

আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব–

ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব

শেয়ার করুন: