উইমেন চ্যাপ্টার: আমার ১৬ মাস বয়সে আমার মা ডুয়ং থি জুয়ান কাই যুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে যিনি উত্তর ভিয়েতনামে প্রথম নারী যুদ্ধবিষয়ক সংবাদদাতা হয়েছিলেন। কিন্তু সেই যুদ্ধে নিহত ৩০ লাখ মানুষের মতোই আমার মা-ও আর ফিরে আসেননি। এখনও তাঁকে খুঁজে ফিরি আমরা।
মা যখন নিজেকে একজন সাংবাদিক হিসেবে প্রমাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল ২৭ বছর। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধ কভার করার জন্য পরিবারের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন, তাঁর বাবাকে কিছু কাগজপত্রে সই করতে অনুনয়-বিনয় করেছিলেন। মা বলেছিলেন, জীবনে এরকম সুযোগ একবারই আসে, ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি।
অনুমতি পেয়ে মা বেছে নিয়েছিলেন সেন্ট্রাল ভিয়েতনামকে। যুদ্ধ তখন প্রচণ্ড আকার নিয়েছে সেখানে। দৃঢ় মানসিকতার মা আমার হ্যানয় ছেড়েছিলেন এভাবেই। খালি পায়ে পাড়ি দিয়েছিলেন জঙ্গল, পার্বত্য এলাকা। এই পথটি তখন দক্ষিণে রসদ ও সেনাবাহিনী পাঠানোর কাজে ব্যবহার করছিল উত্তর ভিয়েতনাম। ওই গ্রুপে একশ জন লেখক, চিত্রকর, সঙ্গীত শিল্পী এবং আলোকচিত্রীদের মধ্যে আমার মা ছিলেন একমাত্র নারী।
সঙ্গে নিয়েছিলেন নিজের খাবার, রাতে ঘুমানোর জন্য একটি ঝুলানো বিছানা আর টুকিটাকি নিজের জিনিস। যতটুকু তার পক্ষে কুলোয় সবই তিনি পিঠে করে নিয়েছিলেন। ডা নাঙের পার্বত্য অঞ্চলে লুকানোর স্থানে পৌঁছাতে তাঁর সময় লেগেছিল দুই মাস। সেখানেই আমার বাবা, যে নিজেও সাংবাদিক ছিলেন, দুজনের দেখা হয় আবার। বাবা তারও একবছর আগে যুদ্ধে গিয়েছিলেন নিউজ কভার করতে। কিন্তু বেশিদিন তারা একসাথে থাকেননি, দুজনের কাজের জায়গা ছিল ভিন্ন, ভিন্ন ভিন্ন অভিযানে তারা অংশ নিয়েছিলেন।
এভাবেই ১৯৬৯ সালের এক বসন্তে মা হারিয়ে যান। তিনি ভিয়েতকং গেরিলা নামের যে গ্রুপটাতে ছিলেন তা ধরা পড়ে দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনীর হাতে। মার্কিন বাহিনীর সাথে যুদ্ধে হাত মিলিয়েছিল তখন দক্ষিণ কোরিয়া। নৌবাহিনী গুলি চালালে মা লুটিয়ে পড়েন গেরিলাদের পায়ের কাছে। ঠিক তখনই তিনি একটি গ্রেনেড ছুঁড়ে মারেন হামলাকারীদের দিকে। এই ফাঁকে গেরিলারা মাকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এরপর থেকে মাকে আর কখনই দেখা যায়নি।
যুদ্ধ শেষ হয়েছে এতোবছর হয়ে গেল, কিন্তু মাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। আমার মায়ের গল্প এবং তার সাথে আসলেই কী হয়েছিল, তার দেহাবশেষ খোঁজা, এসবই আমার পরিবারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বছরের পর বছর ধরে আমরা ওই এলাকায় গিয়েছি, কিন্তু কিছুই পাইনি।

এবছরও একইভাবে ভিয়েতনাম গিয়েছিলাম। যুক্তরাষ্ট্র এবং কোরিয়ার যুদ্ধ করেছে যেসব সংগঠন তাদের সাথে তথ্যের জন্য যোগাযোগ করেছি। তারা আমাকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাদের এই কথায় আমাদের মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়েছে, হয়তো এতোদিনে কিছু একটা পাবো। স্থানীয় কৃষকদের সাহায্য নিয়ে নিজ হাতে ওই এলাকার পুরোটা আমরা খুঁড়েছি। যা পেয়েছিল তা হলো একটিমাত্র বোতাম এবং চুলের একটি ক্লিপ। হতে পারে এগুলো আমার মায়ের, আবার নাও হতে পারে।
যে স্থানটিতে সবশেষে দেখা গিয়েছিল মাকে, সেখানে আমরা তাঁকে স্মরণ করে একটি পাথর রেখে দিয়েছি। পাথরটা আমরা নিয়েছিল ডা নাঙের মার্বেল পর্বত থেকে। যেখানে যুদ্ধের সময় কমিউনিস্টরা পালিয়ে ছিলেন এবং এখন অন্যতম পর্যটন স্থান। আমাদের সান্ত্বনা এখানেই যে, আমরা জানি তাঁর আত্মা কোথাও না কোথাও শান্তিতে আছে।
কিন্তু মনের ভিতরটা এখনও খচখচ করে, অনেক প্রশ্ন মনে। যতবার দেশে ফোন করি, মাকে নিয়ে কথা বলি। ভিয়েতনামে এমন একটি পরিবারও নেই, আমেরিকান যুদ্ধ যাদের ছুঁয়ে যায়নি। নয় কোটি মানুষের দেশের প্রতিটি বাড়িতেই মা-বাবা বা তাদেরও বাবা-মায়ের জন্য প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। আসলে অতীত কখনও মুছে যায় না।
মায়ের মৃত্যুর অনেক বছর পর আমার পরিবার আমাকে মায়ের একটি ডায়েরি দিয়েছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার আগে এটি তিনি বাবার কাছে রেখে গিয়েছিলেন। আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি ডায়েরিটা হাতে পেয়ে, যেখানে তিনি তার প্রতিটি দিন আমাকে উদ্দেশ্য করে লিখে গেছেন।
একটা জায়গায় লিখেছেন, আমাকে ফেলে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে তার কতটা কষ্ট হয়েছিল। তিনি তার মৃত্যুভয় নিয়ে, আমাকে বড় করতে না পারার কষ্ট নিয়ে লিখেছেন। এই চিন্তাগুলো তার মাঝে এতো প্রবল ছিল যে, তিনি যুদ্ধশেষে বাড়ি ফেরার আকুতির কথাও লিখেছেন ডায়েরিতে।

জঙ্গলে লুকিয়ে থাকার সময় আমার দ্বিতীয় জন্মদিন পালনের কথাও তিনি বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমার প্রিয় ছোট্ট মেয়ে লাই, আজ আমি যেখানে, খুব সুন্দর একটা দিন। সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে, বৃষ্টির পর বেশ সতেজ আর জোরালো তার আভা। তোমার জন্মদিনটাও সুন্দর অবশ্যই। কিন্তু আমার দুখিনী ছোট্ট মেয়েটা, তুমি কোনো উপহার পাচ্ছো না জন্মদিনে, না মিষ্টি, না নতুন কাপড় আমার কাছ থেকে। যখনই ভাবি তোমার কথা, হৃদয়টা ভেঙে যায়’।
এই শব্দগুলো লেখার ছয় বছর পর ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল যখন দক্ষিণ ভিয়েতনাম চূড়ান্তভাবে উত্তরের কমিউনিস্টদের কাছে পরাজয় মেনে নেয়, তখন আমার পরিবারে একই সাথে আনন্দ আর দু:খ ছড়িয়ে পড়েছিল। উত্তরে তখন একজন ক্ষুদে পাইওনিয়ার ব্রিগেড হিসেবে আমি হ্যানয়ের রাস্তা ধরে মার্চ করে যাচ্ছিলাম মাথা উঁচু করে, আর হাতে দোলাচ্ছিলাম ঘরে তৈরি কমিউনিস্ট পতাকা, গাইছিলাম বিপ্লবী গান। এর কয়েকদিন পরই বাবা ফিরে আসেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এবং মায়ের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেন।
যদিও এই আশংকা সবসময় ছিলই পরিবারে, তারপরও স্তম্ভিত হয়ে যায় এই খবরে। আমি আমার দাদীমার হাতটি শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম। কেমন যেন শূন্য শূন্য মনে হচ্ছিল চারদিক। একটু বড় হয়ে সেবারই প্রথম আমি আমার বাবাকে দেখেছিলাম। বাবার ফিরে আসা আর মায়ের মৃত্যু, পরিবার জানতো না তার কি করা উচিত, আনন্দ? নাকি শোক? দিনের আলোয় আমরা হাসতাম আর রাতের আঁধারে কাঁদতাম মায়ের জন্য। কিন্তু ধীরে ধীরে সামলে নিয়েছিলাম। বাবার ফিরে আসা এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার উৎসবে মেতেছিলাম আমরা। উত্তর ভিয়েতনামের হয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়ায় তখন আমাদের গর্ব ছিল অনেক। এছাড়াও দক্ষিণে বসবাসকারী আত্মীয়স্বজনের সাথে একত্রিত হতে পারাটাও ছিল আনন্দের।
আমাদের দক্ষিণের অনেক আত্মীয় তখন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছিল। সেসব কথা এখন আর মনে করতে চাই না। আমার মায়ের নামে ডা নাঙ শহরের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়। এছাড়া আমার দাদা এবং পরিবারের আরও তিনজন সদস্যের নামেও রাস্তা আছে।
আমার মায়ের পুরো পরিবারই ছিল নামকরা। তার বাবা ছিলেন পার্লামেন্ট সদস্য এবং বহু আন্দোলনে অগ্রগণ্য কর্মী।
মূলত মায়ের কারণেই আমার সাংবাদিক হওয়া। আমি এখন বিবিসিতে কাজ করি। বিবিসির হয়ে আমি আফগানিস্তান, ইরাক, ইয়েমেন, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য কভার করেছি। মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমি যেন মায়েরই ছোঁয়া পাই। আমি সেই জীবনটাই যাপন করছি, যা খুব তাড়াতাড়ি হারিয়ে ফেলেছিল আমার মা।
(ঈষৎ সংক্ষেপিত)
By Huong Ly
BBC World Service