লীনা পারভীন: বর্তমান বিশ্ব হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির যুগ। অবাধ তথ্য বিনিময়ের যুগ। আর এ যুগে তাই কোন মাধ্যমকেই নগণ্য বা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। আমাদের ছোটবেলায় আমরা যা কিছু পড়েছি, শিখেছি তার সবটাই ছিলো মূলত পরিবার, তারপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য, জীবনী বা ইতিহাসনির্ভর কোন লেখা থেকে। টেলিভিশন তখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাদের নাগরিক জীবনে তেমন কোন প্রভাব ফেলতে শুরু করেনি, কারণ একটাই, এত শত শত দেশি বিদেশী চ্যানেলের আবির্ভাব ঘটেনি।
কিন্তু বর্তমানে সেইসব প্রচলিত ধারা আর নেই। কার্যকা্রিতা হারিয়েছে আমাদের স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানগুলি। আমাদের সন্তানরা এখন অনেক বেশি আধুনিক, তথ্যনির্ভর। তারা চাইলেই হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছে তাদের চাহিদামত সব। সময়ের চেয়ে অনেক আগেই তারা অনেক বেশি পরিপক্কতা অর্জন করছে। যে বিষয়গুলো যে বয়সে জানার কথা তা তারা অনেক আগে থেকেই জেনে বসে আছে, তা সে এবার বুঝুক আর না বুঝুক।
কোনকিছু বোঝার জন্য যে পরিমাণ ম্যাচিউরিটি আসতে হয় তার জন্য এখন আর অপেক্ষা করতে হচ্ছে না।এই অকালপক্কতা কখনো কখনো সমাজের জন্য নেতিবাচক হয়ে উঠতে পারে বলে আমি মনে করি। তাই বলে আমি কোন তথ্য সংকোচনের পক্ষে নই।
দরকার সঠিক দৃষ্টি গড়ে তোলার মত সেই গাইড বা দিক নির্দেশনা। নাটক, সিনেমা, ইন্টারনেট এখন তাদের জানা এবং বোঝার অন্যতম মাধ্যম। আমি জানিনা এখন কয়টা পরিবারে বাবা-মা বা বড় ভাইবোনেরা তাদের সন্তানদের বা অনুজদের শেখায় বড়দের মান্য করে চলতে হয়। পরিবারের বাবা মায়ের কথা যৌক্তিক কারণে মেনে চলতে হয়। স্কুলে শিক্ষকদের সম্মান করতে হয় কারণ তারা আমাদের গুরুজন এবং শিক্ষকের অপমান করলে জীবনে বড় হওয়া যায় না। আমি জানি এইসব খুবই ট্রাডিশনাল শিক্ষা, কিন্তু আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একজন মানুষের বেড়ে উঠা এবং সঠিক ও যুক্তিসংগত শিক্ষার পিছনে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। এখনো পরিবারের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। হ্যাঁ আমি পরিবারের ইতিবাচক শিক্ষার কথাই বলছি। পরিবারকে হতে হবে তার সন্তানের প্রথম এবং প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র।
বর্তমানে আমি মনে করি মিডিয়া বা চ্যানেলগুলো অন্যতম ভূমিকা রাখছে সমাজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে। কখনো কখনো পরিবার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বেশি। অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন আর ট্রাডিশনাল কথা শুনতে চায় না, বই পড়তে চায় না, জীবনী পড়তে চায় না। শিখতে চায় না অন্যের কাছ থেকে। তারা গল্পের বই পড়ে অনলাইনে, যেখানে পাতা উল্টাতে হয় না, বইয়ের সাথে কোন সংযোগ ঘটে না। তাই এর প্রভাব হয় খুব সংক্ষিপ্ত।
আমরা সবাই বড় বেশি ভিজ্যুয়াল জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছি। নিজে কষ্ট করে কিছুই আর আবিষ্কার করতে চাই না। তাই যা দেখি তার একটা বিরাট প্রভাব তৈরী হয় আমাদের মনন জগতে। আর সেখানে একটা মারাত্মক ভুমিকা রাখছে আমাদের চারপাশের চ্যানেলগুলো। সে এবার দেশি আর বিদেশি। পরিবার থেকে এখন আর কোন কন্ট্রোল ম্যাকানিজম এপ্লাই করেও কাজ হচ্ছে না।
কিন্তু কি শেখাচ্ছে আমাদের এইসব মিডিয়াগুলো? একটু কি কখনো ভেবে দেখেছি আমরা? পর্যালোচনা করেছি যে আমার সন্তান প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা যা দেখছে বা শুনছে তা কতটুকু ইতিবাচক আর কতটুকু নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে তাদের জীবনে? এমনকি আমার নিজের জীবনে? মিডিয়া যা বলে তার সবটাই কি সঠিক?
এই মিডিয়ার মধ্যে আমি সিনেমাকেও টানছি। সেইদিন রাস্তায় একটা সিনেমার পোস্টার খুব নজর কেড়ে নিলো আমার। গা রি রি করে উঠলো দেখে। সিনেমার নাম গুণ্ডা। পোস্টারটিতে একজন পুরুষ একটি শর্ট প্যান্ট ও শর্ট শার্ট পড়া একজন নারীকে (নায়িকাই হবে হয়তো) তার প্যান্ট ধরে টেনে ধরে আছে। একবার ভেবে দেখুন তো? আমার আপনার ছেলেমেয়েরা এইসব দেখতে সিনেমা হলে যায় আর মাথায় কি নিয়ে ফিরে আসে?
এখানে শুধু শিক্ষিত পরিবারই না, এইসব সিনেমার সিংহভাগ দর্শক হয় সাধারণত সমাজের খেটে খাওয়া শ্রেণির। তাদের মধ্যে কয়জনের বিচার করার মত ক্ষমতা আছে যে এইসব দেখানো মানে একটি মেয়েকে খাটো করে দেখানো? সারাদিন কর্মক্লান্ত হয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে তারা হয়তো সিনেমা হলে যাচ্ছে নিরেট একটু বিনোদনের জন্য। আর তাদেরকে বিনোদিত করার জন্য আমাদের পরিচালকরা বেছে নিয়েছে নারী নির্যাতনের মত বিষয়কে।
আরেকটু শেয়ার করি, আজকাল প্রায় প্রতিটা চ্যানেলেই আমি খেয়াল করছি কিছু অনুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে যেখানে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনষ্ক শিক্ষার বাইরে একটি কুসংস্কারকে উস্কে দেয় এমন শিক্ষাই দেয়া হচ্ছে। কেবল যে আমাদের দেশীয় চ্যানেলে তা হচ্ছে তা নয়, ভারতীয় সবচেয়ে জনপ্রিয় চ্যানেল জী-গ্রুপের প্রতিটা চ্যানেলে প্রচার করা হচ্ছে এইসব অনুষ্ঠান। যারা দেখেছেন তারা হয়তো জানেন ওখানে কি দেখানো হচ্ছে। আমি জানি তারা এইগুলো করছে তাদের ব্যাবসায়িক দৃষ্টি থেকে এবং তারা নিজেরাও এইসবে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু তারা কি কখনো ভেবেছে যে তাদের এইসব কুপমন্ডুক অনুষ্ঠান দেখে সমাজের মানুষ কি শিখছে? নিজেরা যা বিশ্বাস করেন না অন্যকে তা করানোর চেষ্টা কেন?

এক ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার হয় কিভাবে স্বামীকে বশ করা যায়, কোন তাবিজ বা পাথর পরলে আপনি ফিরে পাবেন আপনার বখে যাওয়া স্বামীকে। কোন পীরের কাছে গেলে আপনি পাবেন আপনার পূর্ণ যৌবনের সুখ। তাবিজের গুনে আপনি হয়ে উঠবেন একজন সফল ব্যবসায়ী বা আর্থিকভাবে সচ্ছল। তাবিজ কবচের গুনেই যদি মানুষের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যেত তাহলে তো আমরা বাস করতাম একটি সুখী সমৃদ্ধ বিশ্বে যেখানে কোন যুদ্ধ, হানাহানি, সাম্প্রদায়িক দাংগা, অন্যায় অবিচার কিছুই থাকতো না। এমনকি ধনী-গরীবের বৈষম্য, পারিবারিক ভাঙ্গনও না।
তাহলে আমার প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি বিংশ শতকের আধুনিক বিশ্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি! নাকি ক্রমে দৌড়ে যাচ্ছি একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রাগৈতিহাসিক যুগের দিকে? একজন মানুষ এমনি এমনি ভালো বা খারাপ হয়ে গড়ে উঠে না। তার দেখা ও বোঝার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে আমাদের সমাজ থেকে, পরিবার থেকে, চারপাশ থেকে। তাই এই মুহূর্তে দরকার সমাজে প্রতিটা মানুষের মাঝে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা, যেখানে সে শিখবে আমি চাইলেই যা খুশি তা করতে পারি না, আমি চাইলেই আরেকজন মানুষকে হত্যা করতে পারি না, আমি চাইলেই একজন নারী বা পুরুষকে অপমান করতে পারি না, চাইলেই আমি পারি না একজন নারীর গায়ে হাত তুলতে, বা আমার যৌন ক্ষুধা নিবারণের জন্য বেছে নিতে পারি না একজন নারীকে তার মতের বিরুদ্ধে।
যেখানে আবার শেখানো হবে, শিক্ষকরা গুরুজন, তাদেরকে সম্মান করলে জীবনে বড় হওয়া যায়। শেখাতে হবে সততাই সর্বোতকৃষ্ট উপায়, চুরি করে কেউ কোনদিন সফল হতে পারে না। সমগ্র বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদেরকেও সামনে এগিয়ে যেতে হবে তবে নিজেদের সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে নয়, তাকে সমৃদ্ধ করে।
উটপাখির সংস্কৃতি দিয়ে কোন জাতির ভিত্তি শক্ত হতে পারে না। গড়ে তুলতে হবে একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানমনষ্ক চোখ যেখানে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করার মত মানুষ গড়ে উঠবে। পরিবারগুলোকেও শিখাতে কেমন করে সন্তান লালন পালন করতে হয়, তাদেরকে কোন শিক্ষায় শিক্ষিত করলে আপনার সন্তান একজন সঠিক মানুষ হিসাবে বেড়ে উঠবে। গুড প্যারেন্টিং আমরা অনেকেই জানিনা। আর এসব গড়ে তুলার ক্ষেত্রে প্রয়োজন একতি সঠিক পারিবারিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে তুলতে হবে সেই কাঠামো।
টেলিভিশনের মালিকরা হবে সমাজের প্রতি দায়িত্ববান, কেবল ব্যাবসা আছে বলেই যেন তারা যেন তেন অনুষ্ঠান প্রচার থেকে বিরত থাকে। সিনেমা বানানেওয়ালারা সিনেমা বানানোর আগে ভেবে দেখবেন তাদের এই সিনেমা দেখে দর্শকরা কি পাবেন আর কি নিয়ে যাবে? তা কি সমাজের কোন কাজে লাগবে?
এর জন্য দরকার একটি সমন্বিত উদ্যোগ যেখানে রাষ্ট্র এবং নাগরিক সমাজ একসাথে কাজ করবে। কেবল একা রাষ্ট্রই নিশ্চিত করবে এমনটা আমি মনে করিনা। আমাদেরকে নিয়েই রাষ্ট্র। রাষ্ট্র কোন বায়বীয় পদার্থ নয়। কখনো কখনো রাষ্ট্রকে বাধ্য করাটাও নাগরিকের কাজ। এমনই একটি সুন্দর উদ্যোগের আশায় রইলাম।