মাকসুদা বেগম: নদী ভাঙ্গনের পরও যিনি থেমে থাকেননি

oxfamউইমেন চ্যাপ্টার: ধান-নদী-খাল, এই তিনে বরিশাল। বাংলাদেশের যে সব ভূখণ্ড সৃষ্টিতে নদ-নদী মুখ্য, বৃহত্তর বরিশাল নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে অন্যতম। নদ-নদী, খাল-বিল, অরণ্য ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ‘উজিরপুর’ বরিশাল জেলার অন্যতম একটি উপজেলা। এই উপজেলার দক্ষিণ শিকারপুর গ্রামের মীরা বাড়ীর বাসিন্দা আমি।

নাম :  মাকসুদা বেগম

স্বামীর নাম  :  আজিজুল হক মীরা

বয়স: ৩৬ বছর

উৎপাদিত ফসল :  ধান, পাট, করলা, চিচিঙ্গা  ইত্যাদি

অঞ্চল : উজিরপুর, বরিশাল

সহযোগি সংগঠন: আভাস

আমার নাম মাকসুদা বেগম। আমি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি। অামার বাবার আর্থিক অস্বচ্ছলতা এবং পারিবারিক ও সামাজিক নানা কারণে আমার হাই স্কুলে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয়নি। আমার স্বামীর নাম আজিজুল হক মীরা। পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৬ জন। আমার স্বামী একজন কৃষক। এজন্য কৃষিই আমাদের আয়ের উৎস।

নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকা বাবুগঞ্জ উপজেলার রাকুদিয়া গ্রামে আমার জন্ম। নদী ভাঙ্গনের ফলে আমার পরিবার বসত ভিটাহীন হয়ে পড়ে। এরপর আমাদের অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়।

কিন্ত আমাদের গ্রামটির কিছু না কিছু অংশ প্রতি বছরই নদীর গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকে। তাই নদীর করাল গ্রাস থেকে রক্ষার জন্য এবং জীবনের তাগিদে আমি দক্ষিণ শিকারপুর চলে আসি স্বামীর হাত ধরে। দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে সংসার জীবনের যাত্রা শুরু হয় আমার। স্বামীর স্বল্প আয়ে সংসার চললেও সংসারের নতুন মুখ আসার ফলে নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন অবস্থায় আমি কৃষিকে অবলম্বন হিসাবে বেছে নেই।

স্বামীর  দুই শতাংশ জমিসহ বর্গা হিসাবে ৩ শতাংশ জমিতে ধান, সবজি ও রবি শষ্য উৎপাদনে ব্যবহার করে কৃষিকাজ শুরু করি। অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতি বছর গড়ে ১৮ মণ ধান, ৭ মণ পাট, ৫ মণ করলা, ৩০ মণ চিচিঙ্গা, ৪০০ চাল কুমড়া উৎপাদিত হয়।

নিজের সংসারের চাহিদা মেটানোর পর বাকি উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে আমি যে টাকা আয় করি তা দিয়ে ছেলেমেয়ের পড়াশোনা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে আজ আমি সক্ষম। কৃষিকাজ শুরু করার আগে আমার বাড়িটি জীর্ণ ছিল, কিন্তু সেই জায়গায় আমার কাঠের বাড়ি উঠেছে। হালের গরু বিক্রি করে আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। আমার বড় মেয়ে এসএসসি পাশ করেছে এবং বড় ছেলে পড়ছে ক্লাস সিক্সে।

কৃষির মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের কথা শুনে উপজেলা কৃষি দপ্তর আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষি দপ্তর থেকে আমি ধান ও সবজি চাষের উপর প্রশিক্ষণ পেয়েছি এবং কৃষি দপ্তর থেকে আমার কঠোর পরিশ্রমের পুরষ্কার স্বরূপ একটি সেচ পাম্প পেয়েছি। আজ আমি নিজের প্রচেষ্টায় স্বাবলম্বী, নিজের উদ্যোগে ও সকলের সহায়তায় গড়া কৃষি ক্লাব আজ ৫০ জন কৃষক কৃষানির মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে।

দিনের বেশিরভাগ সময় আমাকে কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। আবার বাড়ি ফিরে সংসারের নানা কাজও করতে হয়। কুসংস্কার কে আমি পরোয়া করি না তবে শুরুতে আমার নিজ ভাইয়েরা আমার কৃষিকাজে সম্পৃক্ততা সহজভাবে নেয়নি। কোনরকম সহযোগিতা করেনি। আমার কৃষিকাজ করাকে এলাকার লোকজনও ভাল চোখে দেখেনি একসময়। তারা বিভিন্ন সময় আমাকে নিয়ে সমালোচনা করতো। তাছাড়া সৈয়দ বংশের মেয়ে হয়ে কৃষিকাজ করায় কিছুটা বংশ বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয় আমাকে যা আজকে অতীত।

আমার স্বামী এবং ছেলেমেয়ে আমার কাজে সহায়তা করে বলেই আমার পক্ষে সবকিছু সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। আমি কৃষি অফিসের সহায়তায় আমার এলাকার নারী কৃষকদের বিভিন্ন কৃষিকাজের উপরে প্রশিক্ষণ দেবো এবং কৃষি অফিস থেকে বীজ, সার ও কীটনাশক ঔষধ সংগ্রহ করবো সকলের মাঝে বিতরণ করার জন্য। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো আমি গ্রামের সকল নারী ও পুরুষ কৃষকদের সমন্বয়ে একটি সমবায় কৃষি খামার গড়ে তুলবো যাতে মাছ চাষ করা হবে এবং সেগুলো সমবায় ভিত্তিতে বাজারজাত করার ব্যবস্থা করা হবে।

আমি প্রত্যাশা করি ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা কৃষি অফিস, উপজেলা বন বিভাগ এবং উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে কৃষি বিষয়ক পরামর্শ ও সহযোগিতা সকল নারী কৃষকদের জন্য উন্মুক্ত হবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.