রায়হানা রহমান (নীলা): সাপ্তাহিক ছুটির অলসতায় আড়মোড়া ভাঙ্গা সকালটা শুরু হয়েছিল এককাপ চা আর পত্রিকা দিয়ে। পাতা ওলটাতে ওলটাতে একটা খবরে এসে চোখ আটকে গেল। গাজীপুরে মা-ভাইয়ের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ এবং এরপর মা-মেয়েকে কুপিয়ে হত্যা।
যাদের মেরে ফেলা হলো তাদের সাথে না আছে গ্রামের কোন শত্রুতা, না আছে তাদের জায়গা-জমি, না আছে টাকা-পয়সা। শুধুই একফোঁটা জমিতে মাটির ভিটেই সম্বল, যে ভিটের দেয়াল দরজা সবই নড়বড়ে। তারপরও সে ভিটের মেয়েকে ধর্ষিত হতে হলো মা ও ভাইদের চোখের সামনে। শুধু সেখানেই শেষ হলেও হতে পারতো, কিন্তু শেষ হয়নি সেখানে। রক্তের হোলিতে মেতেছিল নরখাদকেরা।
মেয়েটাকে কুপিয়েছে, মাকে কুপিয়েছে; যাতে পৃথিবীর কোন আলো-শব্দ তারা আর দেখতে বা শুনতে না পায়। জানিনা কি অপরাধ ছিল তাদের, শুধু জানলাম যে মেয়েটার প্রাণ নিয়ে নিলো, সে মেয়েটা বড় সাধারণ ছিল। একবেলা খেয়ে আর এক বেলা না খেয়ে দিন কাটাতো। কিন্তু তার মাঝেও শিক্ষায় পিছিয়ে ছিল না। টিউশনি করে নিজের বি.এ পড়ার খরচ যোগাত সেই সাধারণ মেয়ে। হয়তো বা পৃথিবীতে জন্মানোই তার ভুল ছিল। হয়তোবা লেখাপড়া শিখে একদিন মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে, দুবেলা খেতে পারবে সেই স্বপ্ন দেখাই তার ভুল ছিল। সেই ভুলের শাস্তি দিলো পৃথিবীর বুকে সগৌরবে বেঁচে থাকা কিছু কীট, যাদেরকে প্রতিরোধ করার কোন ঔষধই এই ভূ-খন্ডে কাজে লাগে না। যারা দিনের পর দিন আরো ফুলে ফেপে অস্থির হচ্ছে।
এসব কিছু যখন ভাবছি, তখন হঠাৎই দুলে উঠলো চারপাশটা। ভূমিকম্প। প্রথমে ভেবেছিলাম যেরকম হয় সবসময় সেরকমই হয়তো একটু দুলুনি দিয়ে থেমে যাবে। কিন্তু বেশ কিছুটা সময় ধরে স্থায়িত্বে ভয় জাগলো মনে। ঘরে বোনের দুই জমজ সন্তান খেলা করছিল। তাদের আর মা-বাবাকে নিয়ে নিচে নেমে গেলাম। কিছুক্ষণ পর সব যখন স্বাভাবিক হলো আবার ফিরে এলাম ঘরে।
মনে হলো, যাক এ যাত্রায় বেঁচে গেছি। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনের রশি টেনে ধরলো সেই মেয়েটা, যার স্বপ্নগুলো হাওয়ায় জড়িয়ে ঘুরে ঘুরে নেচে বেড়াচ্ছে তার এক টুকরো মাটির ঘরের চারপাশে। হয়তো আজও সে কলেজে যেতো ক্লাস করতে, হয়তো আর কিছুদিন পরেই বি.এ’র ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে একটা চাকরির জন্য নিজেকে যোগ্য করে তুলতে পারতো। হয়তো সে স্বপ্ন বুনেছিল বাড়ির সামনে একটি কৃষ্ণচূড়ার। কিন্তু কিছুই হলো না করা। দিনশেষে পড়ে রইলো কিছু ছেঁড়া পালক আর আলতা রাঙা পায়ের ছাপ, যা থেকে রক্তের গন্ধ বেরোয়।
হঠাৎই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো মন। তখনও জানি না পাশের দেশ নেপালে কী ভয়াবহ ক্ষতি হতে চলেছে আমাদের হঠাৎ এই দুলুনিতে। কিন্তু মনে হলো, এই দেশে হয়তো প্রয়োজন ছিল ভূমিকম্পটার আরো কিছু সময় স্থায়িত্বের। সব ভেঙ্গে চুরে যাওয়ার দরকার ছিল। তাতে সেই মেয়েটার স্বপ্নের সাথে সাথেই হয়তো অনেক স্বপ্ন চলে যেত, কিন্তু সেটা হতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে, কোন ধর্ষণ বা হত্যায় নয়। হয়তো মাটি ফুঁড়ে বেরোত অন্য এক নতুন ভূখণ্ড। যেখানে রবীন্দ্রনাথের সাধারণ মেয়েদের স্বপ্নগুলো ডানা মেলে ভেসে বেড়াতে পারতো। হয়তো এই ভূমিকম্পে নরকের কীটগুলো মাটির ভিতর চাপা পড়ে যেতে পারতো এক নিমেষেই। তাই এখানেও প্রয়োজন ছিল এরকম একটা শক্তিশালী ভূমিকম্পের।
সাধারণ মেয়ে, তোমার ভিটেয় যে কৃষ্ণচূড়ার স্বপ্ন তুমি দেখেছিলে সেই কৃষ্ণচূড়া সত্যিই একদিন বাতাসে দোল খাবে তুমি দেখো। তখন তুমি হয়তো স্বশরীরে সেই কৃষ্ণচূড়ার লাল মাখতে পারবে না তোমার কপোলে, কিন্তু সেই কৃষ্ণচূড়ার প্রতিটি লালে থাকবে তুমি।
হয়তো সেই কৃষ্ণচূড়ার জন্যই একটি ভূমিকম্পের প্রয়োজন।
২৫.০৪.২০১৫