ইতু ইত্তিলা: আমার মা একসময় বেশ কয়েকবছর ব্র্যাকের চাকরি করেছিল। সম্ভবত সেসব আরো ২০ বছর আগের কথা। তো ব্র্যাকে তাদের চাকরিতে অফিস থেকে সবাইকে একটি করে বাইক দেয়া হত। আমার মাও পেয়েছিল, আমার মাসহ তার আরও অনেক নারী সহকর্মীরা বাইক পেয়েছিল এবং তারাও বাইক চালাতো। বাইক চালিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গার ব্র্যাকের অধীনে থাকা স্কুলগুলো ভিজিট করতো।
তাদের বাইক চালাতে যেই সমস্যায় পড়তে হয়েছিল, সেটা হলো, রাস্তাঘাটে তো কোন মেয়ে সচরাচর বাইক চালাতে দেখা যায় না, এখনই দেখা যায় না, আরও বিশ বছর আগে তো সেটা কল্পনাই করা যায় না। তো রাস্তায় ঘাটে সবাই অবাক হতো, এসব মেয়েদের বাইক চালাতে দেখে। কেউ কেউ বাজে ভাবে তাকাতো, কেউ বাজে কথা বলতো, অঙ্গভঙ্গি করতো। এসব পাত্তা না দিয়েই তারা বাইক চালাতো। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর যেই কাজটি কিছু লোকে করতো, সেটা হলো, কিছু ট্রাক, বাস, ট্যাক্সির ড্রাইভার তাদের গাড়ি বাইকের দিকে চাপিয়ে দিতো, বাইকের গা ঘেঁষে যেতো, ফলে বাইক চালক মেয়েগুলো বিচলিত হয়ে পড়তো।
এভাবে বেশ কয়েকবার কয়েকজন অ্যাক্সিডেন্টও করেছে। এইভাবেই একবার সিরিয়াস অ্যাক্সিড্যান্ট করে তাদের সহকর্মী, সুচরিতা নামে একটা মেয়ে মারা যায়। সেই মেয়ের তখন বিয়ে ঠিক হয়েছিল, আশীর্বাদও নাকি হয়ছিল। মেয়ে মারা যাওয়ার পর, পাত্রপক্ষ এসে মেয়ের পরিবারের কাছে মেয়ে দাবি করা শুরু করল।
যেই মেয়ে মারা গেছে তাকে কিভাবে দিবে? এতো সম্ভব না। সেটা তো সবাই বুঝে, পাত্রপক্ষও বুঝে। তা হলে তাদের মেয়ে চাওয়ার কারণটা কি? তাদের মেয়ে চাওয়ার কারণ ছিল ভিন্ন। শেষ পর্যন্ত মেয়ে না দিতে পারলে, বিয়েতে যেসব যৌতুক দেয়ার কথা ছিল সেসব দিয়ে দিলে তারা আর ঝামেলা করবে না এই শর্তে তাদের লাখখানেক টাকাসহ আরও কিছু ঘর সাজানোর সরঞ্জাম (সোফা, টিভি ইত্যাদি…) দিয়ে দেয়া হল।
মৃত মেয়েটির বিয়ের যৌতুকের টাকা দিয়ে পাত্র তার ঘর সাজালো, টাকা ব্যবসায় খাটিয়ে ব্যবসার উন্নতি করল, ঢা ঢোল পিটিয়ে নতুন আরেকটি বিয়ে করল। এইদিকে মেয়ের পরিবার, মেয়ে হারালো, সাথে অর্থ সম্পদও।
এবার আপনি একবার ভাবুন তো, কি দোষে মেয়েটির প্রাণ হারাতে হলো, কি দোষ করেছিল? বাইক চালানো কি কোন অপরাধ? নিশ্চয়ই না। তবে কি অপরাধ তার? তার একটিই অপরাধ, সে মেয়ে। মেয়ে হয়ে পুরুষের মত বাইক চালায়, এর চেয়ে বড় অপরাধ আরেকটি আছে নাকি?
পুরুষেরা আসলে নারীদের কিভাবে দেখতে চায়? তারা চায় মেয়েরা সবসময় এমনভাবে থাকুক যাতে মেয়েদের নিয়ে তারা হাসাহাসি করে পুরুষ বলে নিজেদের নিয়ে গর্ব করতে পারে। যেমন ধরুন, ছেলেদের মধ্যে বন্ধুরা কাউকে হেয় করতে চাইলে বলে, ‘ব্যাটা, তুই একটা লেডিস’ কিংবা বলে, ‘মেয়েদের মত করছিস কেন?’
ছেলেদের মধ্যে কাউকে মেয়েদের সাথে তুলনা করা হলে সেটা হয় তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি অপমানের। কেউ কোন কাজ না পারলে, বলে, ‘তোমার দ্বারা এসব হবে না, যাও ঘরে গিয়ে চুড়ি পরে বসে থাকো’। তার মানে যাদের দ্বারা কোন কাজ হয় না তারাই চুড়ি পরে।
ছেলেদের মধ্যে কেউ ক্রিকেট ফুটবল ভাল খেলতে না পারলে বা হেরে গেলে, তারা বলে, ‘যাও তুমি গিয়ে কুতকুত খেলো গিয়ে, ক্রিকেট ফুটবল তোমার জন্য না’। মানে হল, ক্রিকেট ফুটবল বীরপুরুষদের খেলা। মেয়েদের খেলা নয়। মেয়েরা কুতকুত খেলবে, তাদের এই খেলা নিয়ে ছেলেরা ব্যঙ্গ করবে, হাসাহাসি করবে।
আচ্ছা কোন মেয়ে যদি বলে, আমি চুড়ি পরে ঘরে বসে থাকবো না, আমি কুতকুত না ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলব, তবে কি পুরুষেরা খুশি হবে? মোটেই না, পুরো সমাজ মেয়েটির খেলা বন্ধ করতে, মেয়েটিকে চুড়ি পরিয়ে রাখতে উঠে পরে লাগবে। সুচরিতা নামের সেই মেয়েটিকে যেমন মেয়ে হয়ে বাইক চালানোর অপরাধে প্রাণ হারাতে হয়েছে……….।
নারী অক্ষম, নারী পারে না এবং নানান কাজে নারী পুরুষের তুলনা দিয়ে বিতর্ক টেনে নারীকে তারা পদানত করে রাখতে চায়। যারা এই ধরনের তুলনামূলক বিশ্লেষণগুলো করে, তাদের চিন্তা-চেতনায় চরম পুরুষতন্ত্র ছাড়া আর কিছু নেই। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, অনেক প্রগতিশীলও এই বৈষম্যমূলক মানসিকতা থেকে মুক্ত নয়। এসব প্রগতিশীল পুরুষের যাবতীয় প্রগতিশীলতা শুধুমাত্রই পুরুষদের জন্য।
পুরুষরা শক্তির সব কাজগুলো দখলে নিয়ে নিজেরা শক্তির চর্চা করে নিজেদের শক্তিশালী করে, নারীকে দুর্বল করে রাখে যাতে নারীর দুর্বলতা নিয়ে তারা হাসাহাসি করতে পারে, নারী যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারে, পুরুষ ছাড়া যেন চলতে না পারে। যাতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ টিকে থাকে যুগ যুগ ধরে। পুরুষের এই ষড়যন্ত্র সব নারীর বুঝতে আর কতকাল লাগবে?
নারীর সচেতন হবার এখনই সময়, ধর্মের দোহাই দিয়ে, শালীনতার দোহাই দিয়ে নারীর পথচলা তারা প্রতিনিয়ত থামিয়ে দিতে চায়। নারীর শালীনতা নিয়ে পুরুষের এত মাথা ব্যথা। পুরুষের শালীনতা তবে কিসে? ধর্মের নিয়ম কি শুধুই নারীর জন্য? ধর্ম যে পুরুষের তৈরি, পিতৃতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার একটি হাতিয়ার, নারীরা এসব কবে বুঝবে?