কষ্টিপাথরে সোনা যাচাই

Canada Tribalsরওশন আরা বেগম: আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে সুমাইয়া বেগম স্বামী-সংসার নিয়ে টরন্টো শহরে অভিবাসন নেয়। বড় কোন চাকুরী নয়, আহামরি কোন ব্যবসাও নয়- দুজনে গায়ে-গতরে খেটে ভবিষ্যত সাচ্ছন্দের আশায় দীর্ঘ আট বছরের সাধনায় তারা বেশ কিছু অর্থ জড়ো করতে সক্ষম হয়। তারপরে এক সময় সেই অর্থ বিনিয়োগের জন্যে দেশে ফেরার পালা।

সেই মতে টাকা পয়সা নিয়ে স্বামী রওনা হয় দেশে নিরাপদ বিনিয়োগের আশায়। সিদ্ধান্ত মতো একটা বাড়ী কেনা হয় সেখানে। ব্যাঙ্কে স্থায়ী আমানতও কিছু জমা করা হয়, যা দিয়ে সুমাইয়া পরিবারের বাকী দিনগুলো কেটে যেতে পারতো মসৃনভাবে। কিন্তু বিধি বাম। স্বদেশে ফিরে স্বামীপ্রবর নতুন করে ঘর বাঁধে, যেখানে সুমাইয়া বেগমের প্রবেশ চিরকালের জন্যে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে এই টরন্টো শহরে দুই সন্তান নিয়ে সে একা, সঙ্গীহীন। দীর্ঘ সংসার জীবনে তাদের ভিতরে বিশ্বাসের কোন ঘাটতি ছিল বলে মনে হয় না। তারপরেও কি এক যাদু বলে এমন হৃদয় বিদারক কাহিনীর জন্ম হলো সেকথা জানা এই অধমের পক্ষে দুঃসাধ্য।

পশ্চিমের কোন কোন দেশে ভাগ্যান্বেষণে অভিবাসী হওয়া বাঙালীদের ভিতরে শুধু এক সুমাইয়া না, আরো বহু সুমাইয়ার কান্না ঝরা বিমর্ষ কাহিনী অন্ধকারে পথ খুঁজে মরে। স্বামী হারাবার পরে এক এক করে সুমাইয়ার জীবন থেকে আট বছর কেটে গেছে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে নিজের দুর্বিষহ নিঃসঙ্গতা ঘোচাবার। কিন্তু বারবার অবিশ্বাসের অপছায়া তাকে আশাহত করে ফিরিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তিগত যোগাযোগের অভাবে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, ফেসবুক-টুইটারের আশ্রয় নিয়েছে কখনও।

দৃশ্যমান মুক্তচিন্তক স্বদেশীদের সাথে সেখানে পরিচিত হয়েছে বেশুমার। তাদের ভিতর থেকে কাউকে না কাউকে তাকে বেছে নিতে হয়েছে অস্থায়ী সম্পর্কের ডোরে- স্থায়ী সম্পর্ক তৈরীর প্রত্যাশায়। নিঃসঙ্গতার ঘায়ে জর্জরিত হয়ে নিজ সংস্কৃতি বহির্ভুত অস্থায়ী সম্পর্ককে মেনে নিতে হয়েছে। কিন্তু তার পক্ষে স্থায়ী সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব হয়নি আজও। অবিশ্বাসের নানামুখী ঘাত-প্রতিঘাত এসে তাকে ফেলে দিয়েছে বিশ্বাসহীনতার অন্ধকার গর্তে। খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাছে থেকে মুক্ত চিন্তার মানুষের ভিতরে সে খুঁজে পেয়েছে চিন্তার বদ্ধ জলাশয়।

সুমাইয়া বেগম তার প্রাক্তন স্বামীর কাছ থেকে যে প্রতারণা পেয়েছে তাকে হয়তো বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কিন্তু সেই ব্যাখ্যাই কি সব? সব মানুষই কি সেই ব্যাখ্যার পথ ধরে চলে? সংখ্যালঘু হলেও কিছু কিছু মানুষ এই ব্যাখ্যার বাইরে থেকে যায়, কারণ মানুষের ক্ষমতা কোন সীমারেখা মানে না। এরাই চিন্তাকে মুক্ত করে স্বাধীন নীলিমায় ছেড়ে দিতে পারে মুক্ত বিহঙ্গের মতন। এরাই মুক্ত চিন্তক। অনেক মুক্ত চিন্তকের ভীড়ে সুমাইয়া বেগম যাদের খুঁজে পেলো তারা মেকি, ভুয়া দার্শনিক।

বিস্ময়ের কিছু নেই, এই কাট-পেস্টের যুগে এই প্রসাধন সর্বস্ব মুক্তচিন্তকের সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। তারাই ক্রমাগত চেষ্টা করেছে সুমাইয়ার জীবনে স্থায়ী সম্পর্কের প্রতারনার ডালা সাজিয়ে অস্থায়ী সম্পর্কের সুযোগটা নিতে। এমন সব প্রতারণায় সাড়া দিয়ে সে নিঃস্ব হয়েছে, হয়েছে অন্তরাহত। মুখোশ পরা এইসব মুক্তচিন্তকদের মুখোশটা খুলে দিনের আলোকে নিয়ে আসতে পারলে শেষ বিচারে সবারই লাভ।

সুমাইয়া বেগমদের বেশী কিছু চাওয়ার নেই। একটুখানি বিশ্বাস রাখার মতন জায়গা তাদের জন্যে যথেষ্ট। একজন সাধারণ মানুষও আস্থার এই জায়গাটা তৈরি করে দিতে পারে। তার জন্যে এত বড় গালভরা নামের মুক্তচিন্তক হবার দরকার হয় না। কারণ বৃক্ষের পরিচয় ফলে। সুমাইয়া বেগমদের উচিত অন্তরের কষ্টিপাথর দিয়ে সহজ মানুষদের ভিতর থেকে আস্থার মানুষ খুঁজে বের করা। শুদ্ধির প্রয়োজনে বারবার লালনের স্মরণাপন্ন হই।

সহজ মানুষ-

ভজে দেখনারে মন,

দিব্য জ্ঞানে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.