অদ্ভুত আঁধার এক

Joy
রুহুল মাহফুজ জয়

রুহুল মাহফুজ জয়: একজন ধর্ষক কেমন, কত রকম তার চরিত্র তা ভাবছি। পয়লা বৈশাখের ঘটনা পুরুষ হিসাবে আমাকে, আপনাকে নিশ্চয়ই লজ্জিত করেছে। পুরুষ কতরূপেই না ধর্ষক হয়!

সাঁঝবাতির একটা কবিতা আছে সিম্পর-৪ নামে।

কবিতাটা এরকম, “অনেক দিলেন নাথ, অনেক দিলেন…/ হাতজোড়া ভরে গেল/ পেন ও পেনিসে।/ পদ্ম সহযোগে তিনি বরাভয় দিয়ে বললেন—/ বুঝেছ! এই দুনিয়ায়…/ স্টকার মাতাল খ্যাতি সাইকো মেন্টাল জ্ঞানী অসৎ কবিতা আঁতেল/থেকে দূরে থেকো, মা।/ আপনিই আমায় বাবা বলে ডাকতে দিলেন।/ আপনিই আমার ধর্ষক।/ বাড়িতে এসব কথা কাউকে বলি না ।/ শালা মিথ্যুক!”

একজন কবি যে এরকম একটা কবিতা লিখলেন, তার ভিত্তি নিশ্চয়ই আছে। সেই ভিত্তি কিন্তু পুরুষদের তৈরি। দেশে এমন একটা সময় চলছে যে, ভিড়ের ভেতর যৌন নিপীড়ন করে যদি কেউ বুঝতে পারে মেয়েটা তার বোন ছিল, সে একটুও লজ্জা পাবে না। বিবেক তাকে দংশন করবে না। সে যে বোনকে অপমান করল, সেটা ভুলে গিয়ে দোষ চাপাবে বোনের প্রেমিকের উপর। কেন প্রেমিক বোনকে ওই ভিড়ে নিয়ে গেছে, এটাই হবে দোষ! আর যদি বান্ধবীদের সঙ্গে যায়, তাহলে দোষ হবে বান্ধবীদের। নিপীড়নকারীদের চরিত্র এরকমই। এদের কাছে কোনো মেয়েই নিরাপদ না। পাঁচ বছরের শিশু বা ৫০ বছরের বৃদ্ধা, কেউ না। এমনকি তাদের মা-বোন-আত্মীয়াও না।

কবি জীবনানন্দ দাশের প্রতি ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক তাঁর ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতাটা একটু বদলে লিখতে ইচ্ছা করছে এভাবে, “অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ বাঙলায় আজ,/ যারা ধর্ষক সবচেয়ে বেশি আজ আলোচিত তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই/ বাঙলার মাটি অচল আজ তাদের কুকর্ম ছাড়া।”

কিন্তু এ অবস্থা সৃষ্টি হলো কেন? নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, একদিন-দুদিনে এই ধর্ষক মানসিকতা তৈরি হয়নি। ব্যাপারগুলো ব্যাখ্যার দাবি রাখে। ক্রিকেটার রুবেল হোসেনের সঙ্গে একজন উঠতি নায়িকার সম্পর্ক ছিল। এটা এখন সারা দুনিয়ার জানা। মিডিয়াতে সেই সম্পর্কটি এমনভাবে প্রকাশ হয়েছে যে, রুবেল-হ্যাপির যৌন সংসর্গ ছিল। এটা প্রায় সবাই ধরে নিয়েছে। সেই ধরে নেয়া থেকেই যত মজা আর ইঙ্গিতবাহী কথাবার্তা। রুবেল উইকেট পেলে বা কোনো কিছু করলেই টিপ্পনি কেটে ‘হ্যাপি’ নামটা উচ্চারণ হচ্ছে। তা অবচেতনেই। রুবেলকে মডেল বানিয়ে যে বিজ্ঞাপন বানানো হয়েছে, তার কপিরাইটের ভাষা ও প্রকাশ একই রকম। এই যে রুবেল-হ্যাপিকে নিয়ে বাড়াবাড়ি আচরণ—এসবের কারণ অবদমন। যেখানে যৌনতার গন্ধ আছে, তা নিয়ে টিপ্পনি কাটতে আমরা মজা পাই। এই যে বাঙালি যুব সমাজ ধর্ষক হয়ে যাচ্ছে, তার পেছনে প্রধান সমস্যাটা যৌন অবদমন বা সেক্সুয়াল রিপ্রেসন।

প্রফেসর সিগমুন্ড ফ্রয়েড বহু আগেই বলে গেছেন, মানুষের প্রধান মানসিক সমস্যার সূত্রপাতগুলো হয় যৌন অবদমন থেকে। এ সময়ের মনোবিজ্ঞানীরা আরেকটু আগ বাড়িয়ে বলছেন, পৃথিবীর বেশিরভাগ সমস্যার মূল কারণ অবদমন। অবশ্যই তা যৌন অবদমন। আর এই অবদমন ব্যাপারটি এতটাই ভয়াবহ যে, একজন মানুষের ভেতর থেকে অপরাধবোধ, লজ্জা নামক ব্যাপারগুলো মুছে ফেলে। এমনকি নিজের গৌরবহানি হবার ভয়টুকুও চলে যায়। এই বক্তব্য আমার নয়, সেক্স অ্যাট ডন (Sex at Dawn) গ্রন্থের লেখক ড. ক্রিস্টোফার রায়ানের।

আমাদের পাশের দেশ ভারতে গত কয়েক বছরে ধর্ষণের হার মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এর মূল কারণ অবদমন। আমি মনে করি, বাংলাদেশে যে ধর্ষক চরিত্রের পুরুষের সংখ্যা বেড়ে গেল বা প্রকটভাবে প্রকাশ পাচ্ছে, তার মূলেও সেই যৌন অবদমন।

একটু ব্যাখ্যা করি। ‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে’ রবি ঠাকুরের এই গানটা শুনছিলাম আজ সকালে। এই গানে এরকম লাইন আছে, “দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায়/ সে মহাদানেরই যোগ্য করে/ অতি-ইচ্ছার সংকট হতে/ বাঁচায়ে মোরে।/….পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন/ তব মিলনেরই যোগ্য করে/ আধা-ইচ্ছার সংকট হতে/ বাঁচায়ে মোরে।” এই যে পূর্ণ-ইচ্ছা ও আধা-ইচ্ছা সংকট, এই সংকটটাই অবদমনের। নারীসঙ্গী দ্বারা যারা এই সংকট হতে মুক্তি পাচ্ছে, তারা ভাগ্যবান। আর যাদের মুক্তি ঘটছে না, তারা হয়ে যাচ্ছে বিকৃত যৌনরুচির মানসিক রোগী। যারা পথে-ঘাটে নারীকে আক্রমণ করে আনন্দ পাচ্ছে। আবার এটাও ভুলে গেলে চলবে না, সমাজে বিবাহিত ধর্ষকও আছে। তার মানে মানসিক বিকৃতি একবার কারো ভেতরে জন্মালে, তা থেকে বের হয়ে আসাও খুব কঠিন।

সঙ্গীতশিল্পী আঁখি আলমগীরের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ধর্ষকের রূপ কী? তিনি উত্তর দিয়েছেন, সত্যিকার পুরুষ কখনো ধর্ষক হতে পারে না। দুর্বল বা মানসিক বিকারগ্রস্তরাই এমনটা করতে পারে। এটা একটা রোগ। কঠোরতর শাস্তির মাধ্যমে এদের দমন করা যেতে পারে। আঁখির সঙ্গে এ বিষয়ে সহমত পোষণ করি। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে সমস্যাটা বিষবৃক্ষ হয়ে গেছে।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, সব মানুষের ভেতরেই একটা ধর্ষক চরিত্র বসবাস করে। যারা প্রাপ্ত বয়স্ক হবার সাথে সাথে বা যৌবনের সঠিক সময়ে নারীসঙ্গী খুঁজে পান বা বিয়ে করেন, তাদের ভেতর অবদমনটা কাজ করে না। বাংলাদেশে নারীসঙ্গ পাওয়া সহজ নয়। প্রেমের সম্পর্ক হলেও অনেক সময় যৌন বাসনা অপূর্ণ থেকে যায়। একটা সামাজিক দেয়াল তুলে রাখা আছে নারী-পুরুষের মধ্যে। তার উপর আবার এদেশে প্রতিষ্ঠা পাওয়া খুব কঠিন। একজন যুবক পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পেতে পেতে ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়স পার করে ফেলে। বিয়ে করতে করতে ত্রিশ পার হয়ে যায়। কিন্তু জৈবিক নিয়মেই তার তো যৌনক্ষুধা আছে শরীরে। সেটা তো পূর্ণ হচ্ছে না। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সে হস্তমৈথুন করছে। তাতে ক্ষণিকের তৃপ্তি মিলছে, কিন্তু অবদমন তো কমছে না।

১৮৫০ সালে New Orleans Medical & Surgical Journal ঘোষণা করেছে, হস্তমৈথুন পৃথিবীর প্রধান জনশত্রু। সেখানে সতর্কবার্তা হিসাবে লেখা হয়, একদিন প্লেগ, যুদ্ধ, বসন্তরোগ, শয়তান মানুষের যূথবদ্ধতার চেয়েও মানবতার ধ্বংসকারী হবে হস্তমৈথুনের অভ্যাস। এটি সভ্য সমাজ ধ্বংসকারী উপাদান। যে দেশের যুবকদের যৌবনের প্রলয়ংকরী সময়টা কাটে হস্তমৈথুন করে, যৌন অবদমন যাদের পারিবারিক ও সামাজিক সঙ্গী, তারা যৌন নিপীড়ক হবে না তো কারা হবে? ১৬৫ বছর আগের সেই ভবিষ্যৎবাণী মিলে যাচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, তা আমাদেরই দেশ বাংলাদেশে।

র‌্যাডিক্যাল ফেমিনিজম ব্যাপারটা ঠিকমতো না বুঝেই তা চর্চা হচ্ছে বাংলাদেশে। নারীর ইজ্জত রক্ষার নাম করে নারীকে ‘নারী’ করে রাখা হয়েছে

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যে দেশে যৌন অবদমন কম সেখানকার গবেষকরা এই একবিংশ শতাব্দীতেও বলছেন, ধর্ষণ, অযাচার, শিশুনিপীড়ন, নরহত্যা এবং আত্মহত্যা বেড়ে চলার প্রধান কারণ সেক্সুয়াল রিপ্রেসন। আকাশ-সংস্কৃতির এই যুগে ঘরে বসে বিদেশি চ্যানেলে সফটকোর যৌন দৃশ্য দেখছে উঠতি বয়সের ছেলেটি, যুবকটি, প্রৌঢ়টি। ইন্টারনেটে সার্চ দিলেই পাওয়া যাচ্ছে শত শত পর্ন সাইট। যেখানে নানা কুরূচিপূর্ণ ভিডিও, ছবি, গল্পের অভাব নেই।

বাংলাদেশে যৌনতা অপরাধ বা নিষিদ্ধ জিনিস। সেই নিষিদ্ধতা বা ট্যাবু বহাল আছে। কিন্তু পর্ন তো নিষিদ্ধ না। স্বাভাবিকভাবেই শরীরে যে যৌন উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে, তা পূরণ করতে হস্তমৈথুন করতে হচ্ছে। অবদমনের কারণে মানুষটার চরিত্র হয়ে যাচ্ছে কলুষিত, মানসিকতা হয়ে যাচ্ছে নোংরা। সেই ছেলেটি বা লোকটি যখন তার সামনে যে নারীকে পাচ্ছে, তাকেই ভাবছে ভোগ্যপণ্য। তাই জোর করতেও দ্বিধা করছে না।

আরেকটা বড় কারণ ভুল নারীবাদের শিক্ষা। র‌্যাডিক্যাল ফেমিনিজম ব্যাপারটা ঠিকমতো না বুঝেই তা চর্চা হচ্ছে বাংলাদেশে। নারীর ইজ্জত রক্ষার নাম করে নারীকে ‘নারী’ করে রাখা হয়েছে। মানুষ হতে দিচ্ছে না। পুরুষটি যে খারাপ কাজটি করল, সেই পুরুষের ইজ্জত না গিয়ে শুধু নারীরই ইজ্জত যায়। এমন ভাবনাও ক্ষতিকর। তবে ধর্ষণের শিকার শুধু নারীই হয়; পুরুষ না। টেলিভিশনে আমরা টয়লেট্রিজ পণ্যের বিজ্ঞাপনেই দেখি নারী মডেলটিকে উপস্থাপন করা হচ্ছে সমাজের ছোট স্তরের মানুষ হিসাবে। অমুক রঙফর্সাকারী ক্রিম না মাখলে, তমুক সাবান দিয়ে গোসল না করলে ভাল বিয়ে হবে না, ছেলেদের নজরে আসবে না…এসব দেখিয়ে নারীকে আরো ছোট করা হয়। পুরুষ ভাবে নারীর সঙ্গে এভাবেই বুঝি ট্রিট করতে হয়। তাছাড়া পর্ন ছবিতেও তো নায়িকাদের সঙ্গে দাসীর মতো আচরণ করা হয়। সেসব দেখেও মেয়েদের ‘সেক্স স্লেভ’ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না প্রজন্ম।

সামাজিক আর পারিবারিক মূল্যবোধের অভাবটাও বাংলাদেশের পুরুষকে ধর্ষক করে তুলছে। তাছাড়া বিদেশী সংস্কৃতির ভালো-মন্দ না বুঝে তা গ্রহণ করাটা খুব ভয়ংকর। ইন্টারেনেট আর নানা মাধ্যমে বিদেশী সংস্কৃতি এদেশে বিস্তার লাভ করছে। ভালোটা যেমন নেয়া হচ্ছে, খারাপটা নেয়া হচ্ছে হয়তো তারও বেশি। মানুষের হাতে হাতে ক্যামেরা মোবাইল। পর্ন ছড়িয়ে পড়ছে তা দিয়েও। “দেশের পুরুষদের ধর্ষক চরিত্র প্রকটভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। এর কারণ কী মনে হয়?”

আমার চার নারী বন্ধুকে প্রশ্ন করে উত্তর পেয়েছি এরকম : “১.ধর্ষক সব সময়ই ছিল। কিন্তু তখন তারা ভয় পেত। বছরের পর বছর যখন ধর্ষকেরা বিনা শাস্তিতে পার পেয়ে গেছে , তাই এখন আর তারা ভয় পায় না । কারণ তারা এটাই বিশ্বাস করে যে তাদের কোন শাস্তি হবে না। এরা সংঘবদ্ধ । বাসা থেকেই মেয়েদের সম্মান জিনিসটা শিখে বড় হয় নি । এদের ম্যাক্সিমাম এর বাসায় হয়তো দেখেছে মাকে বাবার হাতে মার খেতে। মা-ও কোনদিন প্রতিবাদ করে নি । তাই তারা এটাই শিখে বড় হয়েছে, মেয়েদের গায়ে হাত তোলা সহজ এবং স্বাভাবিক। ২. ঘটনাগুলো অনেক বেশি রাজনৈতিক। রাজনীতির শিকার হিসাবে নারীদের মূল্য চুকাতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপি নারীদের পণ্য বানানোর প্রতিজ্ঞাতে দুর্বল পুরুষ আর কী করতে পারে..জোর করা! ধর্ষণ করা!! ৩. কারণটা হয়তো মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া। যারা এসব করছে, তারা ভাবছে মেয়েরা বাইরে কেন! একজনকে ধর্ষণ করা মানে কয়েকজন ভয় পাবে। ৪. পুরুষ ধর্ষকের চরিত্র আরো সামনে আসছে, কারণ রাজনীতিগত, নীতিগত, মানবতা ও শিক্ষার অভাব (শিক্ষা ও ডিগ্রিকে গুলিয়ে ফেলবেন না, দুটি আলাদা বিষয়)। রাজনীতিগত দুর্বলতা/একতার অভাব/সঠিক আইন এবং যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থার অভাব, পাশ্চাত্য কু-শিক্ষা ও বলিউড ফলো করার টেন্ডেন্সি ও অ্যাড করতে পারি (যেমন কিছু গানের প্রবল আপত্তিকর লিরিক, সেগুলো বলা ও সেই মতো কাজকর্ম করা খুব হিরোয়িক ও কুক ডুডের নমুনা)।”

আমার এই বন্ধুরা কিন্তু বেশ কটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা তুলে এনেছেন। পরিবারের শিক্ষাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক গবেষণা তাই বলে। সাংবাদিক হারুন উর রশীদের একটা লেখায় পড়লাম, ধর্ষক বা নিপীড়ক জিনের মাধ্যমেও হয়! তিনি উল্লেখ করেছেন,‘স্টকহোমের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের সাইকিয়াট্রিক এপিডেমিয়োলজির অধ্যাপক নিকোলাস ল্যাঙসট্রম এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন। তিনি বলেন, “পুরুষদের মধ্যে যৌন নিপীড়নের স্বভাব থাকবে কি থাকবে না, তার ৪০ শতাংশই ঠিক করে দেয় জিন। পরিবারের পূর্বপুরুষদের মানসিকতায় যদি নির্যাতন থাকে, তাহলে নতুন প্রজন্মের মধ্যেও সেই মানসিকতার প্রভাব পড়ে। একজন যৌন নিপীড়ক পুরুষের আত্মীয়, সন্তানেরাও এমন নিপীড়কের ভূমিকায় নামতে পারেন।”‘

গবেষণাটিতে ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সুইডেনে যৌন অপরাধের জন্য দোষী প্রমাণিত হওয়া ২১ হাজার ৫৬৬ জন পুরুষের নানা তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে । দেখা গেছে, যৌন অপরাধে দোষী প্রমাণিত হওয়া ওই পুরুষদের ভাই বা বাবাদের মধ্যে ২.৫ শতাংশ নিজেরাও এমন অপরাধে দোষী প্রমাণিত হয়েছেন। ধর্ষণ এবং শিশু নিপীড়নের মতো দুই ধরনের যৌন অপরাধের ক্ষেত্রেই এই প্রবণতা একই রকম বলে দেখতে পেয়েছেন গবেষকেরা।

বাংলাদেশে পুরুষদের ধর্ষক চরিত্র প্রকট হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হয়তো ধর্মীয় বেড়াজাল। যা থেকে অবদমনের সূত্রপাত। ধর্মীয় ব্যাপারটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাখা করি। একটা চক্র অনেক বছর ধরে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ও মফস্বলে ধর্মভীরু সরল মানুষগুলোকে বোঝাতে শুরু করে শাকরাইন, নববর্ষ উদযাপন, মেলা করা, গান-বাজনা করা এসব হিন্দুদের রীতি। মুসলমানরা এসব করলে পাপ, দোযখ নিশ্চিত। সেই প্রচারণা চালাতে তারা প্রথমে হাত করেছে ছাত্র-ছাত্রীদের। এরপর অভিভাবকদের। পাড়ায়-মহল্লায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে সেই চক্র ছড়িয়ে পড়েছে।

ছোটবেলায় দেখেছি জাতীয় দিবসগুলোতে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়েও ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হতো। রাত থেকে মাইকে গান বাজানো হতো। পাড়ায় পাড়ায় ছিলো সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ক্লাব। আমাদের ক্লাবের নাম ছিলো ‘সোনার তরী’। সত্তর দশকে এই ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিল তখনকার তরুণরা। সেই ক্লাব বিলুপ্ত হয়েছে বছর পনের আগে।

ওদের শেকড়-বাকড় যে বহুদূর বিস্তৃত হয়েছে তার আরেক প্রমাণ, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়া। গ্রামে গ্রামে বাঙালিয়ানার যেসব উৎসব হতো, তাও উদযাপন প্রায় হয় না বললেই চলে। ছোটবেলায় দেখতাম ‘এক দিলের গান’। কোথাও কোথাও তা আলকাপ গান নামে পরিচিত। নাটকের মতো করে বিভিন্ন রূপকথা আর কিসসা গান গায় সেসব গানের দল। নারী চরিত্রে অভিনয় করে পুরুষরা; নারী সেজে। সেই এক দিলের গান প্রায় হারিয়ে গেছে। পুঁথিপাঠ হারিয়ে গেছে তো অনেক আগেই।

বাংলার আবহমান উৎসবগুলো, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাগুলো স্তিমিত করার কাজে গ্রাম আর মফস্বলে ওরা ইতোমধ্যেই সফল। এরপর প্রবেশ করেছে রাজধানীসহ বড় নগরগুলোতে। সেই প্রবেশও সম্ভবত ১৪/১৫ বছর হয়ে গেল। ২০০১ সালে (১৪০৮ বঙ্গাব্দ) পয়লা বৈশাখে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। ওটাই হয়তো রাজধানীতে ওদের আগমনবার্তা ঘোষণা করেছিল। ‘বিধর্মীদের উৎসব’ প্রচারণা করেও বসন্ত উৎসব বা বাংলা নববর্ষ উদযাপন বন্ধ করা যায়নি। বন্ধ করা যায় নি মেয়েদের রঙিন সাজ-পোশাক। বোরখার সঙ্গে পর্দার সম্পর্ক আছে। তবে কে পর্দা করবে বা করবে না, সেটা তো তার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ। আর বোরখা পড়লেই কোন নারী অপমান বা ধর্ষণের শিকার হবে না, সেই গ্যারান্টি কে দিলো! সারা দেশে এখন মেয়েরা বোরখা পড়ে। ধর্ষণ কি কমেছে? সমস্যাটা পোষাকে নয়, চরিত্র আর মানসিকতায়।

‘মেয়ে’ মানেই স্পর্শকাতর ইস্যু। একবার যদি অভিভাবক আর নারী সমাজে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া যায় যে, এসব উৎসব নারীদের জন্য নিরাপদ নয়; তাহলে মেয়েরা আসবে না। অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের ঘর থেকে বের হতে দেবে না। তখন বসন্ত উৎসব বা বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানগুলো রঙ হারাবে। রঙ হারালেই উৎসব নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমে আসবে। অবদমন, সাংস্কৃতিক-সামাজিক কারণে যেসব ধর্ষক বেড়ে উঠেছে, তাদের সঙ্গে হয়তো মিশে গেছে সেই অপশক্তি। বেছে নিয়েছে নতুন কৌশল।

সব কিছুর পরেও বাঙালি কি ধর্ষকের জাতি, বাংলাদেশ কি ধর্ষণের দেশে পরিণত হবে? এই প্রশ্ন করছি নিজেকে। উত্তর পাচ্ছি—মোটেই না। কেননা, মেয়েরা এখন প্রতিবাদ করতে শিখেছে। তাদের সঙ্গে আছে সচেতন পুরুষও। আচ্ছা, কোন জাতীয় উৎসব কি সত্যিই নির্দিষ্ট ধর্মকে ধারণ করে? করে না। ধারণ করে ওই দেশ বা জাতিকে। শান্তি আর মানবতার ধর্ম ইসলামের সঙ্গেও কি কোন দেশের জাতীয় উৎসব সাংঘর্ষিক? অবশ্যই না। নবী করিম (স:) তো ধর্ম প্রচারকালে কোন জাতির নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিতে বলেন নি। নারীকে কখনো অপমান করেন নি। বরং ইসলাম নারীকে সম্মান দেয় সবচে বেশি। তাঁর স্ত্রী ছিলেন ব্যবসায়ী। ধর্ম আর দেশের জাতীয় সংস্কৃতি আলাদা বিষয়। কয়েকটা উদাহরণ দেই। নওরুজ (Nowruz) যার অর্থ ‘নতুন দিন’ ইরানের নববর্ষ উদযাপন উৎসব। প্রতি বছর ২০ মার্চ থেকে পনের দিনব্যাপি এ উৎসব চলে।

শুধু ইরান নয় নওরুজ পালিত হয় আরো বেশ কটি দেশে। তুরস্ক ও আজারবাইজান তার মধ্যে অন্যতম। এই উৎসবেও মানুষ মানুষের কাছে যায়, নাচ-গানের অনুষ্ঠান করে, বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় অনুষ্ঠান হয়। ইরানের আরেক জনপ্রিয় উৎসবের নাম ‘চাহার সানবে সুরি’ বা ‘আগুনের উৎসব’। ডিসেম্বরের শেষ বুধবার সারা ইরানে আগুন উৎসবের আয়োজন হয়।

তাদের বিশ্বাস, বছরের শেষ দিনগুলিতে পূর্বপুরুষের আত্মা ঘুরতে আসে। বিভিন্ন পার্ক বা যেখানে জনসমাগম বেশি হয়, সেসব স্থানে আগুন জ্বালানো হয়। তরুণ-তরুণীরা লাফিয়ে সেই অগ্নিকুণ্ডলি পার হয়; এবং প্রার্থনা করে, “তুমি তোমার গাঢ় লাল আমাকে দিয়ে বিবর্ণতা ফিরিয়ে নাও।”

ইরান পৃথিবীর অন্যতম শরীয়া আইনের দেশ। মুসলিম অধ্যুষিত এই দেশে নববর্ষের নওরুজ উৎসব বা আগুন উৎসব নিয়ে তো মওলানাদের মাথাব্যথা নেই। জানি কেউ কেউ শিয়া-সুন্নি টেনে আনবেন! দুটি উৎসবই ইরানের জাতীয়, সম্পূর্ণই নিজস্ব সংস্কৃতির। আগুন উৎসব যদি বাংলাদেশে হতো, ‘আগুনের পূজা করা হচ্ছে! এটা বিধর্মীদের বেলেল্লাপনা’ বলে এতদিনে তা বন্ধ হয়ে যেত হয়তো। ইরানে এ উৎসব পালন করে মুসলিমরাই। তারা কি আমাদের চেয়ে কম মুসলিম? মোটেই তা নয়।

সারা পৃথিবীতে প্রতিটি জাতির নিজস্বতা আঁকড়ে থাকার যে গৌরব, তা ওরাও লালন-পালন করে। বাংলা নববর্ষের মতো জাতীয় উৎসব কোনো ধর্মের জন্য সমস্যা নয়। সমস্যাটা দৃষ্টিভঙ্গি ও গোড়ামির। ফতোয়া জারি করে, বিশৃঙ্খলা করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার রাজনীতিও হয়তো। আর সেই রাজনীতির পুঁজি ‘নারী অপমান’। তবে মূল কারণ যে যৌন অবদমন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ।

লেখক: সাংবাদিক
২১.০৪.২০১৫
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.