শুচি সঞ্জীবিতা: মেয়েরা কত বোল্ড, কত সাহসী হয়, যত দেখি, ততই মুগ্ধ। একদিন আগেই একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখে এলাম চুনকাম করা মেয়েদের, নাভিতে পিয়ার্সিং করা, যতটা সম্ভব পুরুষকে আকৃষ্ট করার প্রবণতা। পেশাদারিত্ব সেখানে উধাও। অথচ মাত্র একদিনের ব্যবধানেই পরিচয় হলো অন্য একটি মেয়ের সাথে। মেয়েটি স্কুটি চালায়। বাংলাদেশ উইমেন রাইডার্স ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা। নাম ইশরাত খান মজলিশ।
প্রথম তাকে দেখি একটি ম্যাগাজিনের পাতায়, যেখানে ভুল করে তার নামের পাশে অন্য একটি মেয়ের ছবি ছাপা হয়েছিল। তারপর দেখি টিএসসিতে। বাংলা বর্ষবরণের দিনে মেয়েদের ওপর নিপীড়নের ঘটনার প্রতিবাদ সমাবেশে। মাথায় ঠিক হিজাব না, তবে ওড়নাটা আটসাঁট করে বাঁধা। হয়তো পর্দা, হয়তো চুল ঠিক রাখার জন্যই এই ব্যবস্থা। জিজ্ঞাসা করা হয়নি। সেদিন সে বাইক নিয়ে এসেছিল। আসার কথা ছিল আরও অনেকের, কিন্তু স্বল্প সময়ের নোটিশে চারজন ছাড়া কেউ আসতে পারেনি। সেখানেই প্রথম সামনাসামনি দেখি ইশরাতকে। কিন্তু কথা হয় না।
কাল (মঙ্গলবার) ওর সাথে বসে চুটিয়ে আড্ডা দেই বেঙ্গল ক্যাফেতে। আমি ওর কথা শুনি, আর ভিতরে ভিতরে প্রাণিত হই ওর বোল্ডনেস, ওর যুক্তির গভীরতা, ওর ক্ষোভ, ওর দ্রোহ-বিদ্রোহ দেখে। ভাবি, গত এক সপ্তাহে আমি যত মেয়ের সাথে কথা বলেছি, বা যারাই আমার সাথে যোগাযোগ করেছে, ভিতরে ভিতরে ফুঁসছে তারা। প্রত্যেকের ভিতরে একটা করে আগ্নেয়গিরি দেখেছি আমি। শুধু জ্বলে উঠার অপেক্ষায়।
নববর্ষ বা বিশাল জমায়েতে বা ফাঁকে-ফোকরে মেয়েদের শরীরে হাত দেয়ার ঘটনা সেই আদিকাল থেকেই হয়ে আসছে। আমার চেয়ে ১৬ বছরের বড় আমার বড়বোন সেদিন বলছিল, পাকিস্তান আমলে তারা যখন স্কুলে পড়তো, তখন বাবাকে রাজী করিয়ে তারা বন্ধুরা মিলে সিনেমা দেখতে যেতো। ফুরফুরে মন নিয়ে হল থেকে বেরিয়ে এসেই মুখটা মলিন হয়ে যেত বের হওয়ার রাস্তার দুদিকে ছেলেদের লাইন দেখে। সেখান থেকে কমই তারা ‘অক্ষত’ অবস্থায়, মানে শরীরে ‘টাচ’ ছাড়া বেরিয়ে আসতে পেরেছে। তো, গত ৪৫-৪৬ বছরেও সেই অবস্থার উন্নতি তো হয়ইনি, বরং বেড়েছে। এখন দলে দলে রীতিমতো উৎসব করে মেয়েদের ওপর হামলা হয়, জামা ছেঁড়া হয়, শাড়ি খুলে ফেলা হয়। ওদের ঔদ্ধত্য আমাদের মতো মেয়েদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
ইশরাত কথায় কথায় জানালো, কিভাবে সে বাইক রাইডার্স ক্লাব গড়ে তুলেছে, কতটা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, কিন্তু এটাও জানালো যে, এখন আর তত প্রতিকূল নয় পরিবেশ। আগে রাস্তায় বাইক নিয়ে বের হওয়া মানেই হাজারটা চাহনি, হাজারটা কটাক্ষ ছিল। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে, মানুষের চোখ সয়ে গেছে।
বাসে চলাফেরা করতে গিয়ে নানারকম ঘটনা নিজ চোখে দেখেছেন, কিছু নিজের ক্ষেত্রেও হয়েছে। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেন, আর নয়। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। তিনি তার লাইফ পার্টনারকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে স্কুটি কেনেন, তার কাছেই হাতেখড়িও পান। প্রথমদিকে টিকাটুলির মাঠে চালানো শিখতে গিয়ে কতবার হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন, আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। মাসখানেকের মধ্যেই একেবারে ঝানু বাইকার হয়ে উঠেন ইশরাত। স্কুটার হাঁকিয়েই প্রতিদিন টিকাটুলি থেকে বারিধারায় অফিস করেন। নিজের প্রয়োজনে কোথাও বের হলে বা বেড়াতে গেলে, এমনকি বাজার-ঘাট করাও স্কুটি চালিয়েই। স্কুটি এখন তার নিত্যসঙ্গী, নির্ভরতার বাহন।
বলছিলেন, আগে স্কুটি নিয়ে রাস্তায় নামলে বাস-পিকআপ ইচ্ছে করেই লাগিয়েই দিতো, বিভিন্ন মন্তব্য ছুঁড়ে দিতো। কিন্তু এখন অনেক মেয়েই স্কুটি চালায়। ফলে চোখ-সওয়া হয়ে গেছে। এখন রাস্তায় ছেলেরাও সাথে সাথে চালায়, এমনকি বলেও ফেলে যে, ‘আপা তো খুব ভালো চালান’। মাঝে মাঝে প্রতিযোগিতাও হয়ে যায় ছোটখাটো।
ক্লাবের প্রসঙ্গে ইশরাত জানান, ইন্টারনেটে তিনি এরকম কোনো ক্লাব আছে কিনা খুঁজছিলেন। পুরুষদের বাইক ক্লাব আছে, কিন্তু মেয়েদের না পেয়ে হতাশ হোন। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবেন, নিজেই একটা গড়ে নেন না কেন! যেই কথা সেই কাজ। নেটে নারী বাইকারদের খোঁজার অভিযানে নামেন। প্রথমে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নেন তার প্রস্তাবে। মাত্র দুজন সদস্য নিয়ে ২০১৪ সালের ১ মে যাত্রা শুরু করে ক্লাবটি। প্রথমদিকে অনেকেই তার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ পোষণ করলেও এখন প্রায় চল্লিশজন সদস্য এই ক্লাবে। সানিয়া সাবরিনা, খুকুমনি, নিলুফা ইয়াসমিন শিলা, মাহিনুর আক্তার নিপা, অর্পিতা রায়, তাসলিমা মুরসালিনসহ আরও অনেকেই এখন এই ক্লাবের নিয়মিত সদস্য।
বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিতে শুরু করে এই ক্লাবটি। ২০১৪ সালের ৫ ডিসেম্বর নারী-শিশুর উপর সহিংসতা বন্ধের দাবিতে ক্লাবের সদস্যরা বাইক নিয়ে রাস্তায় নামেন। সহিংসতাবিরোধী নানা ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে সমাবেশ করেন। এতে অংশ নেন প্রায় একশজন।
বাইকাররা রাস্তায় কোনো সমস্যায় পড়লে ঝটপট গ্রুপ পোস্ট দিয়ে জানিয়ে দিলে অন্যরা এগিয়ে যান, পরামর্শ দেন। এছাড়া রাইডিং টিপস, নতুনরা কীভাবে বাইক চালানো শিখবে, টুকটাক মেইনটেন্যান্স বিয়ে গ্রুপের ধারণা দেয়া হয়। বাইকিং বিষয়ে আন্তর্জাতিক মাধ্যমে প্রকাশিক আর্টিকেল, ইউটিউব থেকে প্রয়োজনীয় টিউটোরিয়াল পোস্ট করা হয়। ইশরাত আবার এককাঠি এগিয়ে থাকেন বাইক চালানোয় আগ্রহীদের ব্যাপারে। কেউ চালানো শিখতে চাইলে সে যে দূরত্বেই থাকুক না কেন, বাসায় গিয়ে শিখিয়ে আসেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেয়ে বাইকারদের ক্লাবের সাথেও যোগাযোগ করেছেন ইশরাত। তারা তাকে নিয়মিত আপডেট রাখেন, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য ডাকেন। এখানেই সমস্যাটা হয়। দেশে এখনও নারী বাইকারদের স্পন্সর করার মতো কর্পোরেট মানসিকতার অভাব আছে। ফলে তাদের অংশগ্রহণ করা আর হয় না। তবে বিশ্বের নারী বাইকারদের নিয়ে গঠিত ওয়ার্ল্ড উইমেন অ্যাসোসিয়েশন সদস্য হয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে আবেদন করেছে ক্লাবটি। তারা এখন সেসব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের স্বপ্ন দেখছেন। আশা করছেন তাদের দেখাদেখি আরও অনেক মেয়ে এগিয়ে আসবে বাইক চালানোয়।
বর্তমানে পহেলা বৈশাখে নারীদের ওপর যে যৌন নিপীড়ন হয়েছে, মোটামুটি সবগুলো প্রতিবাদ সমাবেশেই যোগ দিচ্ছেন এই বাইকাররা। তবে তাদের অন্য একটি পরিকল্পনার কথা জানান। তারা এরকম ঘটনা শুধুমাত্র প্রতিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান না। তারা চান প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। মেয়েদেরকে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপগুলো শেখাতে।
আর সেজন্যই আগামী ২৫শে এপ্রিল, শনিবার সকাল ১১টায় টিএসসির সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্যের পাদদেশে আয়োজন করেছেন মানব বন্ধন ও প্রতিবাদ রালী এবং নারীদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধের কৌশল (SADP) উপর বিশেষ কর্মশালা। এই কর্মশালাটি তারা ছড়িয়ে দিতে চান স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের মধ্যে। এটাই এই মূহূর্তের স্বপ্ন ইশরাতদের।